ফিরোজ মান্না :
পদ্মা সেতু এখন পুরো প্রস্তুত। ৪ শ’ ১৫ টি ল্যাম্পপোস্ট রাতে আলো জলছে। এ আলো যেন পদ্মা নদীর গলার মালা। সেতুর সৌন্দর্য দিনে এক রকম আর রাতে অন্য রকম। সেতুর সৌন্দর্য দেখতে প্রতিদিন দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার মানুষ ঘুরে বেড়িয়ে যাচ্ছেন। তবে তারা মূল সেতু পর্যন্ত যেতে পারছেন না সরকারি বাধানিষেধের কারণে। সেতুতে ‘আর্কিটেকচারাল লাইট’ জ্বালানো হবে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস, ঈদ ও পূজাসহ নানা উৎসবের নকশা করা হয়েছে। পিলারের পানির অংশ থেকে রোডওয়ে স্লাব পর্যন্ত সেতু ও ভায়াডাক্টে লাইট জলবে। অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে লাইট গুলো জ্বালানো হবে। সেতু চালু হওয়ার পরে কোরবানির ঈদের আগে আর্কিটেকচারাল লাইটিংয়ের কাজ শেষ করা হবে বলে জানিয়েছে সেতু বিভাগ।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সেতুর সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ–সংযোগ দেয়া হয়েছে। ল্যাম্পপোস্টে কেবল সংযোগের কাজ শেষ। পরীক্ষামূলকভাবে প্রতিদিনই সেতুতে লাইট জালানো হচ্ছে। যানবাহন চলাচলের জন্য সেতুটি এখন প্রস্তুত। সেতুর সম্পূর্ণ কাজ প্রায় শেষ। এখন শুধু পরীস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ চলছে। ২৫ জুন সেতু আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধনের জন্য ‘আর্কিটেকচারাল লাইট’ জ্বালানো হবে ও ফলক নির্মাণের কাজও শেষ প্রান্তে। মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ম্যূরাল স্থাপনের কাজও শেষ হবে দু’একদিনের মধ্যে। ওই দিনই ‘আর্কিটেকচারাল লাইট’ জ্বালানো হবে ।
সেতু এলাকায় মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টির ফোয়ারা ও ইলিশের ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে আমূল পরিবর্তন ঘটবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায়। এজন্য সেতুটিকে ঘিরে তৈরি করা হয়েছে প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রিত মহাসড়ক (এক্সপ্রেস)। গড়ে তোলা হচ্ছে নতুন ব্রড গেজ রেললাইন। সেতুর সংযোগ সড়কের পাশাপাশি সার্ভিস এলাকায় তৈরি করা হয়েছে বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। সেতুতে রাখা হয়েছে ফাইবার অপটিক্যাল ও টেলিফোন ডাক্ট, গ্যাস সঞ্চালন লাইন, সেতুর ভাটিতে তৈরি হচ্ছে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ লাইন। ৪২টি পিয়ারের ওপর ৪১ টি স্প্যান বসিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সেতু। দ্বিতল সেতুর আপার ডেকে চার লেনের সড়ক, যার প্রস্থ ২২ মিটার। লোয়ার ডেকে থাকবে ব্রড গেজ সিঙ্গেল লাইন রেলপথ। মাওয়া প্রান্তে সেতুর সঙ্গে তৈরি করা হয়েছে ১ দশমিক ৪৭ কিলোমিটার উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট)। জাজিরা প্রান্তে তৈরি করা উড়ালপথের দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ৬৭ কিলোমিটার। দুই পাশের ভায়াডাক্টসহ পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার। সেতুতে রেলপথের জন্যও তৈরি করা হয়েছে ৫৩২ মিটার উড়ালপথ।
সেতু কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, পদ্মা সেতুর মাওয়া প্রান্তে তৈরি করা হয়েছে ২ দশমিক ১৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। টোল প্লাজা, পুলিশ স্টেশন, সার্ভিস এরিয়া-১, ওজন স্টেশন, জরুরি সহায়তা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো। জাজিরায় তৈরি করা হয়েছে সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক। এ সড়কের জন্য পাঁচটি সেতু, ২০টি বক্স কালভার্ট ও ১২টি আন্ডারপাস তৈরি করা হয়েছে। মাওয়ার মতো জাজির তেও টোলপ্লাজা, পুলিশ স্টেশন, সার্ভিস এরিয়া-১, ওজন স্টেশন, জরুরি সহায়তা কেন্দ্রসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে চলবে যানবাহন। নিচে স্প্যানের ভেতর দিয়ে ট্রেন চলবে। এজন্য ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে ১৬৯ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রড গেজ রেলপথ। এতে খরচ হচ্ছে ৩৯ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। অন্যদিকে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে মাওয়া হয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত তৈরি করা হয়েছে ৫৫ কিলোমিটার এক্সপ্রেসওয়ে। ২০২০ সালের মার্চে উদ্বোধন করা হয়েছে। সড়কটি নির্মাণে খরচ হয়েছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। শরীয়তপুরের নাওডোবা
এলাকায় তৈরি করা হয়েছে সার্ভিস এরিয়া-২। এখানে অফিস, ল্যাবরেটরি, মসজিদ, মোটেল, মেস, রিসোর্ট, ৩০টি ডুপ্লেক্স বাড়ি, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন, ফায়ার ডিটেকশন ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেমসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর স্প্যানের ভেতর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ৭৬০ মিলিমিটারের গ্যাস সঞ্চালন লাইন। ১৫০ মিলিমিটার অপটিক্যাল ও টেলিফোন ডাক্ট নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এর বাইরে পদ্মা সেতুর দুই কিলোমিটার ভাটিতে হাই ভোল্টেজ বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হয়েছে। এজন্য নদীতে সাতটি বিদ্যুতের খুঁটি তৈরি করা হয়েছে।
সেতু বিভাগ জানিয়েছে, ২৫ জুন উদ্বোধন হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত পদ্মা সেতু। উদ্বোধন উপলক্ষে জমকালো অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার। এজন্য গঠন করা হয়েছে একাধিক উপকমিটি। আর এগুলোর কার্যক্রম সমন্বয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরকে উপদেষ্টা করে গঠন করা হয়েছে একটি কমিটি। সেতু বিভাগের সচিব কমিটির আহ্বায়ক। এ কমিটি পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সুষ্ঠুভাবে আয়োজনে গঠিত সব উপকমিটির কার্যক্রম সমন্বয় ও সার্বিক দিকনির্দেশনা দেবে।