Search
Close this search box.

জঙ্গিদের অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের আদ্যোপান্ত

জঙ্গিদের অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রমের আদ্যোপান্ত

মনিরা নাজমী জাহান

সম্প্রতি জঙ্গি তৎপরতা নিয়ে বেশ সংবাদ প্রকাশিত হচ্ছে। তরুণরা নিখোঁজ হচ্ছে। এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কয়েকজনকে গ্রেফতার করেছে। মে মাসে প্রকাশিত আইএস-এর সঙ্গে যুক্ত ‘দ্য সাপোর্টারস সিকিউরিটি’ নামে একটি সাইবার সিকিউরিটি ম্যাগাজিনে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কী করে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে ফাঁকি দেওয়া যায়, তার পথ বাতলে দেওয়া হয়েছে সেখানে। ২৪ পৃষ্ঠার ওই ম্যাগাজিন স্মার্টফোন এবং কম্পিউটার ব্যবহার করার সময় কীভাবে সতর্ক হতে হবে, তাও বলা আছে। বিষয়টি শুধু উদ্বেগজনক নয়, চরম উৎকণ্ঠারও বটে। কারণ, জঙ্গিবাদ একটি বৈশ্বিক সমস্যা। যখন পৃথিবীর কোনও একটি প্রান্ত আক্রান্ত হয় তখন তা পৃথিবীর অন্য প্রান্তগুলোকেও নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ফেলে দেয়। পৃথিবীকে করে তোলে অস্থির।

তবে এই অনলাইন জঙ্গি নিয়োগকে কেন্দ্র করে কয়েকটি বিষয় জানা প্রয়োজন। তার মধ্যে সর্বপ্রথম যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হলো এই মহামারি চলাকালে জঙ্গিগোষ্ঠী কি হঠাৎ করে অনলাইন কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করলো? এই মহামারি চলাকালীন তাদের কোনও কার্যক্রম ছিল কি? এই প্রশ্নের উত্তরে বলতে হয়, এই মহামারি চলাকালে জঙ্গিগোষ্ঠী যথেষ্ট সক্রিয় ছিল। মহামারি শুরুর দিকে নিজেদের ম্যাগাজিন আল নাবাতে কোভিড-১৯’কে খ্রিস্টান দেশগুলোর জন্য সাজা হিসেবে উল্লেখ করে প্রচারণা চালিয়েছিল আইএস। করোনা নিয়ে বেসামাল থাকা পশ্চিমা বিশ্বে হামলা চালাতে অনুসারীদের আহ্বান জানিয়েছিল তারা। সাম্প্রতিক তাদের প্রকাশিত নিবন্ধগুলোতে করোনা পরিস্থিতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করতে দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রে নাস্তিকতা ও অনৈতিকতার যে জোয়ার চলছে তার শাস্তি হিসেবে বিশ্বব্যাপী এ মহামারি পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অপরদিকে আরেকটি আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা কোভিড-১৯ নিয়ে ছয় পৃষ্ঠার একটি নির্দেশনা ও বিবৃতি প্রকাশ করেছে।

নাইজেরিয়ার জঙ্গিগোষ্ঠী বোকো হারামের এক অডিওতে দাবি করা হয়, বোকো হারাম যে নৃশংস পদ্ধতি অবলম্বন করে সেটাই হলো অ্যান্টিভাইরাস। সেই অডিও বার্তায় সামাজিক দূরত্বের কথা বলে মসজিদ বন্ধ করে দেওয়াকে ইসলামের ওপর আঘাত বলে উল্লেখ করেছে বোকো হারাম নেতা আবুবকর শেকাউ।

দ্বিতীয় যে বিষয়টি জানা প্রয়োজন তা হলো, জঙ্গিগোষ্ঠীর এই অনলাইনভিত্তিক কার্যক্রম কী একেবারেই নতুন নাকি তারা আগেই অনলাইন দুনিয়াকে ব্যবহার করে জঙ্গিভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হলে একটু অতীতে ফিরে যেতে হবে। যদিও ৯/১১ টুইন টাওয়ার আক্রমণের আগে জঙ্গিগোষ্ঠী বিচ্ছিনভাবে অনলাইনে কার্যক্রম চালাতো, তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং সাংগঠনিকভাবে অনলাইনে কার্যক্রম শুরু করে ৯/১১ টুইন টাওয়ার আক্রমণের পর। আফগানিস্তানে আমেরিকার আক্রমণের পর জঙ্গিদের একটা বিশাল অংশ আশ্রয় নেয় পাকিস্তান এবং সৌদি আরবে। বাকিরা বিচ্ছিন্নভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আশ্রয় নেয়। যেহেতু সেই সময় তাদের নির্দিষ্ট ক্যাম্প ছিল না তাই ওই সময় আল কায়েদা তাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য প্রথম সাংগঠনিকভাবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার শুরু করে। সেই সময়ে তাদের কাজ ছিল অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে নিয়োগ কার্যক্রম চালানো এবং নিজেদের কলাকৌশল সম্পর্কে সদস্যদের ধারণা দেওয়া। পরবর্তী সময়ে তারা এই প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে শুধু নিজেদের সদস্যদের মধ্যে যোগাযোগ নয়; বরং সমমনা অন্যান্য গ্রুপ যেমন Al-Shabab in Somalia, Al-Qaeda in Iraq, Al qaeda in arabian peninsula প্রভৃতি সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করে। এছাড়াও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ তারা করে। তা হলো জঙ্গি কর্মকাণ্ডে অর্থ সংগ্রহ। ২০০১-০২ সালে আল কায়েদা ওয়েবসাইট ডেভেলপ করে যেখানে তাদের যোগাযোগের মাধ্যম ছিল মেসেজ বোর্ড। আল কায়েদা তাদের প্রথম তৈরি মেসেজ বোর্ডের নাম দেয় আনসার মেসেজ বোর্ড।

এরপর জঙ্গিগোষ্ঠী মেসেজ বোর্ড থেকে ফোরামভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে। তারপর জঙ্গি গোষ্ঠী Ansar Al Mujahideen নামে ফোরামভিত্তিক কার্যক্রম চালু করে, যেখানে তারা প্রথম paltalk সেশন চালু করে। এই সেশনের উদ্দেশ্য ছিল ব্যক্তিপর্যায়ে যোগাযোগ বৃদ্ধি। এই সেশনে মূলত নতুন সদস্যদের জিহাদভিত্তিক বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হতো। এর পরের পর্যায়ে জঙ্গিগোষ্ঠী Bulletin পদ্ধতির প্রচলন করে। সেই পদ্ধতির সুবিধা ছিল সেই পদ্ধতি সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল না, সেইmB vBulletin যোগ দেওয়ার জন্য রেজিস্ট্রেশন এবং পাসওয়ার্ডের প্রয়োজন হতো। যার কারণে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চাইলেই তাদের কাজের ওপর খবরদারি করার সুযোগ অনেকাংশে কমে যায়।

তবে অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারে আমূল পরিবর্তন আনেন জঙ্গি আবু মুসাব আল জারকাবি। জারকাবি মূলত ছিলেন মিডিয়াবিমুখ একজন ব্যক্তি। তিনি অন্যান্য জঙ্গির মতো আল জাজিরা মুখী ছিলেন না। বরং তিনি তার নৃশংসা কর্মকাণ্ড অনলাইন প্লাটফর্মে প্রচার করেন। যেহেতু জারকাবি প্রচারের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত মিডিয়াকে ব্যবহার না করে অনলাইন প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছিলেন। ফলে জঙ্গিগোষ্ঠীর কাছে অহংধৎ অষ গঁলধযরফববহ ফোরাম দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং এই ফোরামের মেম্বার হওয়ার হিড়িক পড়ে যায়। ২০০৫ সালের বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী বিভিন্ন মেসেজ বোর্ডের ব্যবহার শুরু করে। যা দ্রুতই জঙ্গিদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এই মেসেজ বোর্ডের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল Al qaeda military section। যেখানে সেই সময় আত্মঘাতী বোমাসহ জঙ্গিবাদের অন্যান্য কলাকৌশল সম্পর্কে ধারণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে এই মেসেজ বোর্ডগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ভার্চুয়াল গ্রুপের আবির্ভাব ঘটে, যাদের কাজ ছিল মেসেজ বোর্ডের মেসেজগুলোকে বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে দেওয়া। পরবর্তীকালে আল কায়েদা ইংরেজিতে INSPIRE নামের একটি ম্যাগাজিন Arabian peninsula থেকে প্রকাশ করে। এখনে উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে Boston Marathon যে বোমাবাজির ঘটনা ঘটে সেই ঘটনার তদন্তে জানা যায় যে তৎকালীন জঙ্গিগোষ্ঠী বোমাবাজির কৌশল ওঘঝচওজঊ নামের ম্যাগাজিন থেকেই রপ্ত করেছিল।

তবে এত তুলনামূলক গোপন এবং নিরাপদ ফোরাম থাকা সত্ত্বেও জঙ্গিগোষ্ঠী ওপেন ফোরাম অর্থাৎ সামাজিক গণমাধ্যমের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিশেষ করে টুইটার অনেক বেশি জনপ্রিয় হয় জঙ্গিগোষ্ঠীর মধ্যে। তবে এর অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় খুব সহজে অধিক মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছানো সম্ভব। আরেকটি কারণ হচ্ছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে, Jabhat al-Nusra  একটি সিরিয়াভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন। যাদের একবার মনে হলো Shumukh al-Islam নামক ফোরামে তাদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না, বরং সেই ফোরামে গুরুত্ব পাচ্ছে আল কায়েদা ইরাকের মতামত। তখন তারা সেই ফোরামের পক্ষপাতদুষ্টের অভিযোগ এনে ফোরাম ত্যাগ করে। এরকম বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠী মত প্রকাশে গুরুত্ব না পাওয়ায় বিভিন্ন ফোরাম ত্যাগ করে এবং পরবর্তীকালে ওপেন ফোরাম অর্থাৎ সামাজিক গণমাধ্যম বিশেষ করে টুইটারের দিকে ঝুঁকে পড়ে।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, ইন্টারনেটের কোনও নির্দিষ্ট সীমানা, ক্ষেত্র বা বিস্তৃতি নেই। তাই এই ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে বসে অন্য প্রান্তকে খুব সহজেই প্রভাবিত করা সম্ভব। সেই সুযোগটি জঙ্গিগোষ্ঠী বারবার নেওয়ার চেষ্টা করে। কাজেই জঙ্গিগোষ্ঠীর এই অসাধু প্রচেষ্টাকে মাথায় রেখেই আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পর্যাপ্ত এবং যুগোপযোগী প্রশিক্ষণে প্রশিক্ষিত করে এই অনলাইন জগতকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। নিঃসন্দেহে এই বিষয়ে বিন্দুমাত্র হেলা ফেলা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াবে।

লেখক: শিক্ষক, আইন বিভাগ, ইস্টওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ