পর্যায়ক্রমে ৬-৭ ধাপে চলবে তাদের আপারেশন * এই জমজের অস্ত্রোপচার আশাবাদী চিকিৎসকরা * মেয়েদের সুস্থতার আশায় দিন গুনছে তার পরিবার
শাহনাজ পারভীন এলিস- ফুটফুটে দুই জমজ কন্যা নুহা ও নাবা। হাসছে, খেলছে- মায়ের কণ্ঠ শুনে বা অন্যদের আহবানে সাড়াও দিচ্ছে। স্পর্শ করলে প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। কিন্তু জন্ম থেকেই তাদের শরীরের পেছনের মেরুদণ্ডের নিচের অংশ জোড়ালাগা। অপরেশনের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সি-ব্লকের তৃতীয় তলায় নিউরোসার্জারি বিভাগে তাদের রাখা হয়েছে।
হাসপাতালে বেডে থাকা এই দুই শিশুর মায়াবি জ্বলজ্বলে চোখে এই পৃথিবীর আলো-বাতাসে বাঁচার আকুতি। তারা কুড়িগ্রামের পরিবহন শ্রমিক আলমগীর হোসেন রানা ও নাসরিন আক্তার দম্পতির কন্যা। ৮ বছর বয়সী ছেলের পর চলতি বছরের গত ২১ মার্চ স্থানীয় একটি হাসপাতালে তাদের জন্ম হয় নুহা ও নাবা’র। জন্মের সময় তাদের ওজন ছিল ৮ দশমিক ৫ কেজি। চিকিৎসার জন্য তাদের বিএসএমএমইউ’তে আনা হয় গত ৪ এপ্রিল। দেশে মেরুদণ্ডে জোড়ালাগা প্রথম শিশু হিসেবে তাদের শিশুর অস্ত্রোপচারের প্রস্তুতি নিচ্ছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডা. শারফুদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, ‘এই দুই শিশু হলো দেশে মেরুদণ্ডে জোড়ালাগা প্রথম জমজ। তাদের অপারেশন তাই জটিল, অত্যন্ত স্পর্শকাতর ও সময় সাপেক্ষ। তারপরও নুহা ও নাবা’কে আলাদা করতে সর্বোচ্চ সতর্কতার সাথে সফল অস্ত্রোপচারের সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের চিকিৎসার সার্বিক খরচের দায়িত্ব নেয়ায় এখন আর আর্থিক কোন সমস্যা নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই শিশুদের সার্বক্ষণিক খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। তাদের চিকিৎসার প্রয়োজনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের কারো সহযোগিতা লাগলে তাদেরও ডাকা হবে।
আশা করছি, আগামী ১৫ দিনের মধ্যেই তাদের প্রাথমিক অপারেশন কার্যক্রম শুরু করা হবে। দু-তিন দিনের মধ্যেই জানিয়ে দেয়া হবে অপারেশনের নির্ধারিত দিন-ক্ষণ। অপারেশনে নিউরোসার্জন, ইউরোলজিস্টস, শিশু সার্জন, বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জন, এনেসথেসিয়া বিশেষজ্ঞ ও শিশু পুষ্টিবিদসহ বিভিন্ন বিভাগের চিকিৎসকের দরকার হবে। আমরা ধারণা করছি, আলাদা করার পরও এই শিশুদের সুস্থ করে তুলতে তাদের ছয় থেকে সাতটি অপরেশন লাগতে পারে।’
গত মঙ্গলবার বিএসএমএমইউতে যমজ শিশুর চিকিৎসা সংক্রান্ত এক সভায় নুহা ও নাবা’র অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসার জন্য ১৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। পেডিয়াটিক মেডিসিন, ভাসকুলা সার্জারি, অ্যানেসথেশিয়া, ট্রান্সফিউশন মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকসহ এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন নিউরোসার্জারি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন। সংবাদ সারাবেলাকে তিনি জানিয়েছেন, ওই শিশুদের অপারেশনের জন্য দেশি-বিদেশি ডিভাইস সংগ্রহসহ সার্বিক প্রস্তুতি চলছে। মেরুদণ্ড ও স্পাইন জোড়া লাগা এই শিশুদের অস্ত্রোপচার অত্যন্ত জটিল ও স্পর্শকাতর; তবে আমরা আশাবাদী। এই অপারেশন সফল হলে এদেশের শৈল্য চিকিৎসা ব্যবস্থা আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। এটা দেশের জন্য মাইল ফলক বলে বলেও মনে করেন এই চিকিৎসক।
ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, এই জমজের অপারেশনে পর্যায়ক্রমে ৬ থেকে ৭টি ধাপে অস্ত্রোপচারের দরকার হতে পারে। কারণ এই জমজের মূত্রনালী পৃথক হলেও তাদের মলদ্বার সংযুক্ত, দুজনের একটিমাত্র সেক্স অর্গান। তবে উভয়েই শব্দ ও স্পর্শে সংবেদনশীল। তাদের যকৃত, গলব্লাডার, প্লীহা, অগ্ন্যাশয়, কিডনি এবং ইউরেটার্স স্বাভাবিক রয়েছে। সব ঠিক থাকলে এ মাসের মাঝামাঝিতে অর্থাৎ আগামী ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে আমরা তাদের প্রাথমিক অস্ত্রোপচার শুরু করবো। প্রথম পর্যায়ে টিস্যু এক্সপাইন্ডার দিয়ে শুরু হবে কার্যক্রম। তারপর ওই শিশুদের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার-নীরিক্ষার পর পর্যায়ক্রমে চলবে অপারেশন।
ডা. মোহাম্মদ হোসেন আরও জানান, জমজশিশু নুহা ও নাবা’র বয়স এখন সাড়ে ৮ মাস। শিশুদের মায়ের অতীতে তার কোন খারাপ প্রসূতি ইতিহাস ছিল না, অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা ছিল না, জন্মগত অসঙ্গতির কোন পারিবারিক ইতিহাসও নেই। প্রসবপূর্ব ২০ সপ্তাহে গর্ভাবস্থায় যমজ দেখা যায়। তবে গর্ভাবস্থার ২৬ সপ্তাহে করা অ্যানোমলি স্ক্যানে তাদের কোন জন্মগত অসঙ্গতি দেখা যায়নি। গর্ভাবস্থার বাকি সময়টা ছিল অস্বাভাবিক। গর্ভাবস্থার ৩৫ সপ্তাহে সিজারের মাধ্যমে তাদের প্রসব করানো হয়।
ডা. মোহাম্মদ হোসেন বলেন, পাঁচ মাস আগে তিনি চিকিৎসকদের একটি অনুষ্ঠানে অংশ নিতে কুড়িগ্রামে যান। সেখানে চিকিৎসকরা মেরুদণ্ডে জোড়ালাগা এই নবজাতকের বিষয়টি তাকে জানান। এরপর তিনি শিশুদের দেখতে যান। পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাদের ঢাকার বিএসএমএমইউতে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জনকে অনুরোধ করেন।
হাসপাতালের ওই বিভাগে গিয়ে কথা হয় নুহা ও নাবা’র বাবা আলমগীর হোসেনের সাথে। তিনি জানান, মেয়েদের সুস্থ করে বাসায় নিয়ে যাওয়ার আশায় দিন গুনছেন। নুহা ও নাবা’র চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। প্রধানমন্ত্রী পাশে না দাঁড়ালে তার মতো সাধারণ এক পরিবহন শ্রমিকের পক্ষে মেয়েদের ব্যয়বহুল এই চিকিৎসা করা সম্ভব ছিলো না। জানান, গেলো ৮ মাস ধরে মেয়েদের চিকিৎসার জন্য সময় দিতে গিয়ে এরই মধ্যে কাজও হারিয়েছেন। কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন এম মোরশেদ এবং অধ্যাপক ডা. মোহাম্মাদ হোসেনের সহায়তায় মেয়েদের কুড়িগ্রাম থেকে এই হাসাপতালে নিয়ে আসতে পারা এবং ভর্তি করার পর চিকিৎসকসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষে আন্তরিকতায় তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন আলমগীর।