স্টাফ রিপোর্টার- দেশের পোল্ট্রি শিল্প মালিকরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে বলে মন্তব্য করেছেন ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন। তিনি বলেছেন, ‘এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। এক মাসে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ১০০ টাকা কীভাবে বাড়ে। এটা শুধু আমার প্রশ্ন নয়, দেশের সব মানুষের প্রশ্ন। এভাবে চলতে পারে না। পোল্ট্রি শিল্পমালিকরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা যদি তাদের প্রতারণা বন্ধ না করে, তাহলে তাদের সুরক্ষা দেয়া বন্ধ করে দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে উন্মুক্ত করে দিতে হবে মাংস ও ডিম আমদানি।’
রাজধানীর মতিঝিলে এফবিসিসিআই কার্যালয়ে বিভিন্ন বাজার কমিটি ও পণ্যভিত্তিক ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন জসিম উদ্দিন। যদিও সভায় পোল্ট্রি শিল্প প্রতিষ্ঠানের কোনো মালিক বা ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা উপস্থিত ছিলেন না।
অসাধু ব্যবসায়ীদের দায় এফবিসিসিআই নেবে না ঘোষণা দিয়ে ব্যবসায়ীদের জসিম উদ্দিন বলেন, ‘পোল্ট্রি শিল্পের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে আমরা কথা বলব। তাদের যদি উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়, তাহলে আমরা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে কয়েক মাসের জন্য মাংস ও ডিম আমদানির সুযোগ দেয়ার অনুরোধ করব। তত দিনে দেশে দাম কমে আসবে।
সভায় গরুর মাংসের দাম নিয়েও কথা বলেন এফবিসিসিআই সভাপতি। বলেন, দুবাইয়ে গরুর মাংসের দাম ৫০০ টাকা। তারা ব্রাজিলসহ অন্য দেশ থেকে আমদানি করে। তাদের (দুবাই) নিজের দেশে কোনো গরুর খামার নেই। আর আমাদের এখানে এখন সাড়ে সাত শ থেকে আট শ টাকা কেজিতে গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে। ভোক্তাদের সুরক্ষা দিতে প্রয়োজনে গরুর মাংসও আমদানি করা যেতে পারে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এফবিসিসিআই’র এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, রমজান মাসে ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলাসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে খুচরা ও পাইকারি ব্যবাসয়ী, উৎপাদনকারী, আমদানিকারক এবং বাজার কমিটিগুলোকে আহ্বান জানিয়েছে এফবিসিসিআই। বৃহস্পতিবার রমজান উপলক্ষ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি, মজুত, সরবরাহ, বাজার পরিস্থিতি ও বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এ আহ্বান জানান এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন।
এ সময় তিনি বলেন, বাজার স্থিতিশীল রাখতে ইতোমধ্যে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভোক্তা এবং ব্যবসায়ীদেরও দায়িত্বশীল হতে হবে। ভোক্তাদের যেমন প্রয়োজনের অতিরিক্ত কেনাকাটা থেকে বিরত থাকতে হবে, ব্যবসায়ীদেরও অতি মুনাফা করা থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনো ব্যবসায়ী যেন ভোক্তাদের কাছ থেকে পণ্যের অযৌক্তি দাম আদায় করতে না পারে, সে বিষয়ে বাজার কমিটিগুলোকে তৎপর থাকার আহ্বান জানান জসিম উদ্দিন।
তিনি বলেন, আমরা চাই না ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ব্যবসায়ীদের হেনস্তা করুক। পণ্য ক্রয়-বিক্রয় ও মজুত বিষয়ে সরকারের নিয়ম-নীতি রয়েছে। এসব বিষয়ে সাধারণ ব্যবসায়ীদের সচেতন করতে বাজার কমিটিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কোনো পণ্যের সরবরাহ বিঘ্নিত হলে আমাদের জানান, আমরা সহযোগিতা করব।
কোনো বাজারে অযৌক্তিক মূল্যে পণ্য ক্রয়-বিক্রয় হলে এবং এ বিষয়ে বাজার কমিটির উদাসীনতা দেখা গেলে সরকার কমিটির লাইসেন্স বাতিল করবে জানিয়ে সবাইকে সতর্ক করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
অসাধু ব্যবসায়ীদের দায় এফবিসিসিআই নেবে না বলেও পরিস্কার জানিয়ে দেন এফবিসিসিআই সভাপতি।
এ সময় এফবিসিসিআইর জ্যেষ্ঠ সহ-সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বলেন, চলমান বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে দ্রব্যমূল্য যা বৃদ্ধি পাওয়ার পেয়েছে। রমজানকে কেন্দ্র করে এই দাম যেন নতুন করে না বাড়ে। আমরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জেনেছি চিনি, ভোজ্যতেলসহ অন্যান্য নিত্য পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। পাইপলাইনেও (আমদানি পর্যায়ে) যথেষ্ট পণ্য রয়েছে। গত বছর ঈদের আগে বাজারে যে বিশৃঙ্খলা হয়েছিল, এবার যেন তার পুনরাবৃত্তি না হয়।
ব্রয়লার মুরগি, গরুর মাংস এবং ডিমের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে সরকার মাংস ও ডিম আমদানির চিন্তাও করতে পারে। এতে করে স্থানীয় শিল্প হুমকিতে পড়বে।
সভায় ভোজ্যতেল এবং চিনি উৎপাদনকারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা জানান, রমজনে চাহিদার বিপরীতে দেশে পণ্য দুটির পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। কারখানা পর্যায়ে জ্বালানি সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে এসব পণ্যের কোনো ঘাটতি হবে না। এ সময় ব্যবসায়ীরা অভিযোগ করেন, নিত্যপণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে পাইকারি বাজার কিংবা মিলগেট থেকে রশিদ প্রদান না করায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের জরিমানার মুখে পড়তে হচ্ছে তাদের।
আড়ত ও মিলগেটে পণ্য কেনা-বেচার ক্ষেত্রে রশিদ বাধ্যতামূলক করার বিষয়টি বাস্তবায়নে সরকারের সঙ্গে জোরালোভাবে কাজ করা হবে বলে জানান এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন এফবিসিসিআই সহ-সভাপতি এম এম মোমেন, আমিন হেলালী, পরিচালক এম জি আর নাসির মজুমদার, বিজয় কুমার কেজরিওয়াল, হাফেজ হারুন, মোহাম্মদ বজলুর রহমান, আবু হোসেন ভূইয়াঁ রানু, আক্কাস মাহমুদ, বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিনসহ ব্যবসায়ী নেতারা।
এদিকে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমানোর অঙ্গীকার করেছে এ খাতে দেশের চার প্রধান প্রতিষ্ঠান কাজী ফার্মস, প্যারাগন পোল্ট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি, আফতাব বহুমুখী ফার্মস এবং সিপি বাংলাদেশ। আগামীকাল শুক্রবার থেকে এ চারটি কোম্পানি নতুন দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করবে বলে জানিয়েছে তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভোক্ত পর্যায়ে ব্রয়লারের দাম কমবে বলে আশা করছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান। দুপুরে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান তিনি।
এর আগে বেশি দামে ব্রয়লার মুরগি বিক্রির কারণ জানতে কাজী ফার্মস, আফতাব বহুমুখী ফার্মস, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারির মালিকদের তলব করে ভোক্তা অধিদপ্তর। চার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকের পর সফিকুজ্জামান বলেন, চারটি করপোরেট প্রতিষ্ঠান পাইকারি পর্যায়ে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকায় ব্রয়লার মুরগি বিক্রি করতে রাজি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে এই চারটি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে কাজী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কাজী জাহেদুল হাসান বলেন, আমরা পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ২২০ টাকায় বিক্রি করতাম। আলোচনার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছে পাইকারি পর্যায়ে এই দাম হবে ১৯০ থেকে ১৯৫ টাকা। ভোক্তা পর্যায়ে সেই দাম কত হবে তা সরকারের বিভিন্ন দপ্তর নির্ধারণ করবে।
জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো যখন ২২০ টাকায় ব্রয়লার বিক্রি করছে, তখন ভোক্তা পর্যায়ে এই দাম হচ্ছে প্রতি কেজি ২৬০ থেকে ২৭০ টাকা। যেহেতু করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এখন ১৯০ টাকায় বিক্রি করবে, তার মানে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি কেজিতে ৩০ থেকে ৪০ টাকা কমবে।
এর আগে গত ৯ মার্চ ভোক্তা অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির উৎপাদনে খরচ হয় করপোরেট পর্যায়ে ১৩০ থেকে ১৪০ টাকা। তবে খুচরা খামারি পর্যায়ে এই খরচ হয় ১৫০ থেকে ১৬০ টাকা।