মতামত: গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারি শেখ হাসিনা সরকার উৎখাত হবার পর এখন চলছে আলোচনা- একটি অন্তর্বর্তী( ইনটেরিম) সরকার গঠনের লক্ষ্যে। দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যারা শিক্ষার্থীদের ‘বৈষম্যহীন কোটা সংস্কার’ আন্দোলনে সঙ্গে জড়িত বা সমর্থন দিয়ে রাজপথে এসেছিলেন, তাদের ডাকা হয়েছে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে বসে এর কাঠামো গড়ে তোলার আলোচনায়। ওই বৈঠকে ৬ সমন্বয়কারীকেও ডেকেছেন রাষ্ট্রপতি। মাঝখানে আছেন সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনী প্রধানগণ।তাদেরই প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় শেখ হাসিনার দাম্ভিক আচরণের সর্বশেষ কাজ পদত্যাগ যেমন হয়েছে তেমনি তারা তাকে সেইফ ইক্সজিটও দিয়েছেন।
শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন পারিবারিক স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে।তিনি ও তার পারিবারিক স্টেকহোল্ডারগণ (পারিবারিক অংশীজন, যারা হাসিনার অবৈধ ক্ষমতার ও লুটের ভাগিদার) এখন ভারতের একটি জায়গায় অপেক্ষা করছেন, কোন দেশ তাদের আশ্রয় দেবে সেই জন্য। ইতোমধ্যেই তাদের আশ্রয়ের আবেদন ব্রিটিশ সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। টিভির নিউজের স্ক্রলে সেই খবর আমরা দেখলাম।
একটি অসাধারণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমাদের সেনাবাহিনী। গণঅভ্যুত্থানকে রক্তপাতহীন করতে তাদের সামরিক শক্তির ভূমিকা বিশেষ অবদান রেখেছে। অনেকেই ভেবেছিলেন যে, সামরিক শাসন জারি হবে এবং তারাই ক্ষমতায় আসবে। অতীত অভিজ্ঞতা সেই কথাই আমাদের শুনিয়েছে। কিন্তু আমাদের সেনাবাহিনী ওই দখলের মধ্যে না গিয়ে জনগণের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং দেশপ্রেমিক ও সংস্কারপন্থী শিক্ষার্থীদের অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। এই সংস্কার কেবল সরকারি চাকরির কোটা সংস্কার নিয়ে শুরু হলেও এর ভেতরে ছিলো এবং আছে গোটা রাষ্ট্রব্যবস্থার ঘুণে খাওয়া অংশগুলোর সংস্কার চেতনা ও প্রত্যাশা। ওই প্রত্যাশাই যাতে রাষ্ট্রসংস্কারকে অর্থবহ ও সংস্কৃত করে তোলা যায়, যা আমাদের দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনীও ভেতরে ভেতরে লালন করছিলেন, তারই বহির্প্রকাশ পেলো তাদের পদক্ষেপে। চাইলে সেনাবাহিনী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে সামরিক শাসন চাপিয়ে দিতে পারতো। এ-রকমটাই আমরা গত ৫৩ বছর ধরে দেখে আসছি। কিন্তু আজকের সেনাবাহিনী সেই রিগেসি গ্রহণ না করে জনগণের প্রতি তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি ও দায়িত্ব কর্তব্য পালনে দৃঢ়তা দেখালো। সামরিক আইন জারি না করেও যে ছাত্র-জনতার দাবি আদায়ে অনন্যসাধারণ পদক্ষেপ নেয়া যায়, বর্তমান সেনাপ্রধান ওয়াকারউজ্জামান সেটা প্রমাণ করেছেন।
এখন, কোনো সরকার নেই বললেই চলে। সব অফিস আদালত খুলে দেয়ায় জনমনেও একটা স্বস্তি এসেছে। সেই স্বস্তি আর রাজনৈতিক অস্তস্তির \ফোকড় গলিয়ে কিছু খারাপ লোক নানা গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলা করবার চেষ্টা চালাচ্ছে। সচিবালয়ে একধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। যেহেতু তারা বিগত হাসিনা সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন, ফলে তাদের ওপর কিছু মানুষের রোষ চেপেছে। আমরা লক্ষ্য করেছি বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর আবেদন হচ্ছে কোনো রকম প্রতিশোধ নয়, কোনো রকম হিংস্রতা নয় ভালোবাসা দিয়েই তাদের বিগত কাজগুলোকে ঢেকে দিতে হবে। কোনো রকম ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ নয়, প্রতিহিসাংত্মক আচরণ নয়, গণঅভ্যুত্থাণে অর্জিত বিজয়কে সুসংহত করতে তাদেরকে সর্বাত্মক সহযোতা দিতে হবে। আর সেটা হচ্ছে এককেন্দ্রিক শাসন ব্যবস্থাকে বহুদলীয়, বহুপক্ষীয় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে পাকাপোক্ত করা যায়, সেই লক্ষ্যে কাজ করা। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে প্রয়োজন ন্যায় ও কল্যাণবোধের উদ্ধোধন। ছাত্রজনতা, রাজনৈতিক দলগুলো এবং দেশের বৃদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মহীরূহগণকে একটি প্লাটফর্মে এনে জাতীয় বা অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো গড়ে তালাই হবে যুক্তিযুক্ত। আমরা বিবেচনা করি, সামরিক বাহিনী যখন ক্ষমতা দখল না করে একটি স্বাভাবিক গণপরিবেশজাত কাঠামো গড়ে তোলার আয়োজনে ভূমিকা রাখছে, তাই তাদেরকেও এই অন্তর্বর্তী সরকারে রাখলে ভালো কিছু অর্জিত হবে। কারণ তারা কেবল শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিতই নন, তাদের রয়েছে বিশেষ রাজনৈতিক চেতনার পরিশীলিত ও সামরিক চেতনার সমন্বিত রূপ। তারা আমাদেরই ভাই-বন্ধু বা সন্তান। তারা আমাদেরই সমাজের সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে উঠেছেন। তারা আমাদের গণতান্ত্রিকতার মূল্য উপলব্ধি করতে পারবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যতটা না মিল-মহব্বত আছে, তার চেয়ে আছে দ্বিমত নিজেদের সামনে তুলে আনার একগুঁয়েমিও। এই ধরনের গোয়ার্তুমি পরিহার করে, সবাই মিলে যদি অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামো গড়ে তোলা যায়, তাহলে ভবিষ্যতে রাষ্ট্রকাঠামো সংস্কারে রাজনীতকগণ নতুন প্রেরণা পাবেন। আমি ছোট করে এই কাঠামোর একটি রূপ বলতে চাই।
ছয়জন সমন্বয়কসহ গণঅভ্যুত্থানের অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে একটি সুপ্রিম অথোরিটি কমিটি বা কাউন্সিল সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কাঠামো গঠন করা যেতে পারে। সরকারের যারা থাকবেন তারা যে সব বড় কাজের সিদ্ধান্ত নেবেন, তা সুপ্রিম অথোরিটির অনুমোদন পেলেই তা বাস্তবায়িত হবে। সুপ্রিম অথোরিটির সদস্য সংখ্যা বেজোড় সংখ্যায় রাখা যেতে পারে।সুপ্রিম অথোরিটির সদস্যগণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভোটাভুটির মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে।
দুই. জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েই ওই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে হবে।
তিন.নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে।
চার.তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন দিয়ে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করা যেতে পারে।
পাচ. নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রসংস্কারসহ শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পরিপূর্ণ করবেন।
ছয়. নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে করার আইনি ব্যবস্থা করতে হবে, যা কখনোই বাতিল করা যাবে না। কেবল খাতা কলমে নয়, নির্বাচনকে রিগিংমুক্ত করতে হলে আইনের ব্যবহার করা জরুরি। জনবিরোধী ও দেশের ক্ষতি হয় এমন আইন ও মানবাধিকার কর্ব বা লঙ্ঘন হয় এমন আইন বা কাজ করা যাবে না।
সাত. গণমানুষের প্রতি ন্যায় ও সমমযর্দা রক্ষা ও কায়েমের জন্য পুলিশের নৈতিক উন্নতির চর্চা এবং তাদের মানসিক চেতনার বিকাশ অতি জরুরি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সরকারের অন্যায় ও দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করা যাবে না। বর্ডার গার্ডকে ভিন্ন মত দমনে রাজধানীসহ কোনো শহরেই আনা যাবে না।
সামাজিক ন্যায় কায়েম করতে হলে প্রশাসনের গলদ ও মানসিকতারও পরিবর্তন করার পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। কারণ, আমরা দেখেছি রাজনৈতিক সরকার দলীয় পেটোয়া প্রশাসন গড়ে তুলে অন্যায়কে ন্যায় হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দেশ ও জনগণের ক্ষতি করছেন।
এছাড়াও বহু স্পর্শকাতর বিষয় অনুল্লেখ রাখা হলো যা দুর্নীতিকে পল্লবিত করতে সহায়ক। সেগুলোর মূল উপড়ে ফেলতে হবে।
লেখক: কবি, সাংবাদিক, কলামিস্ট।