ছাত্র আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে যাদের গীতি-কবিতা
পৃথিবীর ইতিহাসে যুদ্ধ কিংবা বিপ্লবে কবিতা-গানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। যুগ যুগ ধরে যেসব কথামালা শিল্পীর কণ্ঠে গীত হতে থাকে, তার পেছনে বিশাল অবদান রাখেন গীতিকার কিংবা কবিরা। তবে তারা অনেকটা থেকে যান আড়ালে। তবে ইতিহাসে তার নামটি জ্বলজ্বল করে স্বর্ণাক্ষরে। আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা দিয়েছিল বহু গান। স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারিত সেসব গান আজ ইতিহাসের অংশ। কালজয়ী সেসব গানের স্রষ্টারাও অমর হয়ে আছেন। মুক্তিযুদ্ধের পর এবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও প্রেরণা জুগিয়েছে বেশকিছু গান। তারমধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মোহিনী চৌধুরী, কাজী নজরুল ইসলাম, প্রিন্স মাহমুদ, হায়দার হোসেন, ইথুন বাবু, ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান প্রমুখদের লেখা গান আলোচিত হয়েছে। অফলাইন-অনলাইন এবং আন্দোলনের মাঠে এই গান উদ্দীপ্ত করেছে। সমবেত কণ্ঠে গেয়েছেন আন্দোলনকারীরা। ইউটিউব, ফেসবুক, টিকটকে মিলিয়ন-বিলিয়ন ভিউ পেয়েছে গানের ভিডিওগুলো।
আন্দোলনকারীদের কণ্ঠে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ গানটি আবেগাপ্লুত করেছে সবাইকে। কেননা দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের গানটি। দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (১৯ জুলাই ১৮৬৩-১৭ মে ১৯১৩) ছিলেন বিশিষ্ট কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা। তিনি ‘ডিএল রায়’ নামেও পরিচিত ছিলেন। প্রায় ৫০০ গান রচনা করেন এই গুণী গীতিকবি। গানগুলো বাংলা সংগীত জগতে ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ নামে পরিচিত। তার বিখ্যাত গান ‘ধনধান্য পুষ্প ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’, ‘বঙ্গ আমার! জননী আমার! ধাত্রী আমার! আমার দেশ’ ইত্যাদি আজও জনপ্রিয়। বাংলা ভাষায় রচিত ও সুরারোপিত গানটি কালজয়ী দেশাত্মবোধক গান হিসেবে এখনো ব্যাপক জনপ্রিয়।
কাজী নজরুল ইসলামের ঝুমুর তালে লেখা ‘কারার ঐ লৌহ-কপাট’ গানটিও এবারের ছাত্র আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। হাসিনা সরকারের হাতে বন্দি আন্দোলনকারীদের মুক্ত করতেই গানটি উপস্থাপন করেন ছাত্র-জনতা। কাজী নজরুল ইসলাম (২৪ মে ১৮৯৯-২৯ আগস্ট ১৯৭৬) বিদ্রোহী কবি হিসেবেই বহুল পরিচিত। তাঁর বিদ্রোহী কবিতাই তাঁকে এই অভিধা এনে দিয়েছে। ফলে নজরুল ইসলামের গীতি কবিতায় বা গানেও বিদ্রোহ ধরা দিয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম বিংশ শতাব্দীর প্রধান বাঙালি কবি ও সংগীতকার। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে সৃষ্টির প্রাচুর্য তুলনা করার মতো নয়। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। এই গান ছাড়াও এবারের আন্দোলনে কাজী নজরুল ইসলামের ‘এই শিকল পরা ছল’ গেয়েছেন শেখ ইশতিয়াক, শাকিব চৌধুরী, রায়েফ আল হাসান রাফা, প্রবর রিপন ও জামশেদ চৌধুরী। গানগুলোর মাধ্যমে শিল্পীরা কনসার্টের আয়োজন করে আন্দোলনে উৎসাহ জুগিয়েছেন।
গীতিকার মোহিনী চৌধুরীর লেখা ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ গানটি সমবেত কণ্ঠে প্রেরণার বাতিঘর হয়ে ধরা দিয়েছে। শাহবাগ চত্বর, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসব গান শিল্পীর কণ্ঠে বারুদ হয়ে জ্বলে উঠেছে। মোহিনী চৌধুরী (৫ সেপ্টেম্বর ১৯২০-২১ মে ১৯৮৭) একজন বাঙালি কবি, গীতিকার ও চিত্র পরিচালক। তাঁর জন্ম বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলার কোটালিপাড়া উপজেলায়। তবে কলকাতার রিপন স্কুল থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সাথে ম্যাট্রিক পাস করেন। সেখান থেকেই আইএসসি পাস করে বিএসসিতে ভর্তি হন। গানের প্রতি নেশায় বিএসসি পরীক্ষা অসমাপ্ত রেখে গান লেখার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৪০ সালে কলকাতা জিপিওতে চাকরিতে যোগ দেন। আট বছর এ চাকরি করেছিলেন। ১৯৪৩ সাল থেকে গ্রামোফোন রেডিওতে সিনেমার গীতিকার হিসেবে কর্মজীবন শুরু হয়। তাঁর জনপ্রিয় গানের মধ্যে ‘মুক্তির মন্দির সোপানতলে’ অন্যতম। দেশাত্মবোধক গানটির জন্য তিনি খ্যাতি ও সুনামের অধিকারী হয়েছিলেন। গানটির সুরকার ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র দে।
একই সঙ্গে প্রিন্স মাহমুদের কথায় নগর বাউল খ্যাত জেমসের গাওয়া ‘বাংলাদেশ’ গানটি আগুনের ফুলকি হয়ে আলো ছড়িয়েছে। তারুণ্যের প্রতীক এই গানটি তরুণরা মন্ত্রের মতো গেঁথে নিয়েছিলেন অন্তরে। গানটির গীতিকার প্রিন্স মাহমুদ (জন্ম ১৭ জুলাই) বাংলাদেশের জনপ্রিয় গীতিকার, সুরকার, সংগীতশিল্পী ও সংগীত পরিচালক। গীতিকার হিসেবে তিনি ৯০ দশক থেকে বাংলাদেশে ব্যান্ডশিল্পীদের একক এবং যৌথ অ্যালবামের গান লেখা, সুর করা এবং সংগীতায়োজনের কাজ করেছেন। তার লেখা ও সুর করা একাধিক গান ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। ১৯৯৫ সালে ‘শক্তি’ অ্যালবামের মধ্য দিয়ে মিশ্র শিল্পীর গানের অ্যালবাম প্রকাশ শুরু করেন তিনি। একক, দ্বৈত ও মিক্সড মিলিয়ে প্রিন্স মাহমুদের ৪০তম অ্যালবাম ‘নিমন্ত্রণ’।
চিরায়ত গানের পরই ব্যান্ডের গান তরুণদের বুকে বিপ্লবের মশাল জ্বালিয়েছে। সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে ওয়ারফেজের ‘জনস্রোত’ গানটি। গানটি রচনা ও সুর করেছেন শামস। ব্যান্ডদল ওয়ারফেজের ‘সত্য’ অ্যালবামে গানটি প্রথম প্রকাশিত হয়। গানের কথা এরকম, ‘সবাই বলে, আর তুমি বলো/ আর তুমি বলো, আর তুমি বলো, বলো?/ সে পথ জনস্রোত করেছে অবরোধ/ সেই পথ এখনও কি লাগছে ভালো?/ কি লাগছে ভালো, বলো?’
অপরদিকে ভিজ্যুয়াল মাধ্যমে বিভিন্ন ভিডিওর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিল্পী হায়দার হোসেনের ‘স্বাধীনতা’ গানটি। এ শিল্পীর গাওয়া ‘তিরিশ বছর পরও আমি স্বাধীনতাটাকে খুঁজছি’ গানটি আবহ সংগীত হিসেবে চোখের জল ফেলেছে দর্শকের। হায়দার হোসেন একজন জনপ্রিয় বাংলাদেশি কণ্ঠশিল্পী, গীতিকার, সুরকার, গিটারবাদক এবং কী-বোর্ড বাদক। তিনি মূলত সমাজ, মানবতা ও দেশের প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে গান করে থাকেন। তার ‘চিৎকার করে কাঁদিতে চাহিয়াও করিতে পারিনি চিৎকার’ গানটিও আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল।
যুদ্ধংদেহী গানের জন্য ব্যান্ডের কোনো বিকল্প নেই, এ কথা অকপটেই বলা যায়। তাই তো ব্যান্ডশিল্পী মাকসুদের ‘আবার যুদ্ধে যেতে হবে’ গানটিও উদ্বুদ্ধ করেছে ছাত্র-জনতাকে। গানটির কথা লিখেছেন মাকসুদুল হক। ব্যান্ডদলের নাম মাকসুদ ও ঢাকা। গানটি ‘প্রাপ্ত বয়ষ্কদের জন্য নিষিদ্ধ’ অ্যালবামে প্রথম প্রকাশিত হয়। গানের কথা হলো, ‘পৃথিবীতে বেড়াতে আসিনি এসেছি অনেক কাজ নিয়ে/ শঙ্কাহীন মনের অধিকার দিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা নিজে।/ ক্ষমতালোভী আর ক্ষমতাভোগীদের যুক্তিতে লড়তে হবে/ লক্ষ লক্ষ লোক শহীদ হয়নি এই ঠকবাজি মেনে নিতে।/ এই ইন্টারনেটের যুগে মরণ মানসিকতা এখনি রুখতে হবে/ বাকস্বাধীনতা মুক্ত চিন্তা সংস্কৃতি গড়তে হবে।’
এ ছাড়া শূন্য ব্যান্ডের ‘শোনো মহাজন’, সোহেল আরমানের লেখা হাবীব ওয়াহিদ, আরফিন রুমি ও প্রদীপ কুমারের গাওয়া ‘হৃদয় আমার বাংলাদেশ’ গানগুলোও গীত হয়েছে এই আন্দোলনে। বিশেষ করে ইথুন বাবুর লেখা ও মৌসুমীর গাওয়া ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গানটি রক্তে আগুন লাগা ক্ষণ উপহার দিয়েছে। কেননা বাংলাদেশের সংগীতের স্বর্ণালি সময়ের একজন সংগীতযোদ্ধা বলা হয় ইথুন বাবুকে। শুরুর দিকে শিল্পী হলেও পরে হয়ে ওঠেন বাংলা গানের অন্যতম জনপ্রিয় গীতিকার ও সুরকার! তার লেখা অসংখ্য গান আলোড়ন তুলেছে দেশব্যাপী। তার লেখা, সুর ও সংগীত পরিচালনায় সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছে আসিফ আকবরের কণ্ঠে ‘ও প্রিয়া তুমি কোথায়’। তারপর এবারই বহুল আলোচিত ও দর্শক-শ্রোতাপ্রিয় হয় ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গানটি।
সমকালীন বাংলা গানের ভুবনে ভিন্নধারার কথা নিয়ে হাজির হন সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্যে তার ‘ভয় বাংলায়’ গানটি ছাত্র-জনতার হৃদয় স্পর্শ করেছে। খুব সহজ-সরল ভাষায় হৃদয় স্পর্শ করা গান রচনা করেন তিনি। মানুষটি সবার কাছে ‘সায়ান’ নামেই পরিচিত। ১৯৭৬ সালের ২ সেপ্টেম্বর কানাডার মন্ট্রিলে জন্ম নেওয়া সায়ান মাত্র সাত মাস বয়সেই বাবা-মায়ের সঙ্গে ফিরে আসেন বাংলাদেশে। বেড়ে ওঠা ঢাকায়। বাবা মো. খসরু ওয়াহিদ আধুনিক বাংলা গানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মা নাজমা বানু সরাসরি জড়িত না থাকলেও আত্মিকভাবে যুক্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা না থাকলেও ছোটবেলা থেকেই ঘরোয়াভাবে সাংস্কৃতিক পরিবেশে বেড়ে ওঠা। দাদা ওয়াহিদ উদ্দিন আহমদ শিল্প, কলা ও সংস্কৃতির নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। তাঁরই ছত্রছায়ায় ১০-১২ বছর বয়সেই গানের সঙ্গে পথচলা শুরু। তার চাচা ফেরদৌস ওয়াহিদ এবং চাচাতো ভাই হাবিব ওয়াহিদ। তবে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার পথকেই বেছে নেন তিনি। ভিন্ন বক্তব্যকেন্দ্রিক গানকে জীবনমুখী গান বলে আখ্যায়িত করতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন সায়ান। প্রতিটি গানের রচনা থেকে শুরু করে সুর দেওয়া এবং গায়কীতে নিজেই থাকেন। নিজের অভিজ্ঞতাকেই গানে ফুটিয়ে তোলেন।
এমনকি ছাত্র আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রচিত হয়েছে কিছু গান। অনি হাসান প্রকাশ করেছেন ‘আমরা বীর’। শহরতলী ব্যান্ডের ভোকালিস্ট সোহাগ গেয়েছেন ‘ও প্রধান’। তরুণ গায়িকা পারশা মাহজাবীনের ‘চলো ভুলে যাই’ গানটিও ভাইরাল হয়েছিল। এমনকি র্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ এবং র্যাপার হান্নান হোসাইনের ‘আওয়াজ উডা’ গান দুটিও আন্দোলনে সাহস জুগিয়েছে। তাদের লেখা ও কণ্ঠ দেওয়া এই গানের জন্য তারা আটক হয়েছেন। অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। একই সঙ্গে আন্দোলনকে উজ্জীবিত করেছে ‘বাংলা মা’, ‘বায়ান্ন’, ‘দেশ সংস্কার’, ‘স্বাধীনতার গন্ধ’, ‘ছাত্র’, ‘স্লোগান’, ‘অধিকার’, ‘দেশ কার’, ‘আবু সাঈদ’, ‘রক্ত’, ‘দেশ কারও বাপের না’, ‘জবাব দে’, ‘জয় বাংলা’, ‘কত খাবি’, ‘শকুনের চোখ’ গানগুলো। ফলে বোঝাই যায়, যুগে যুগে আন্দোলন-সংগ্রামে গানের ভূমিকা অপরিসীম। তাই ইতিহাসে স্থান করে নেয় গানগুলো। অমর এই গানের গীতিকাররা বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন যুগের পর যুগ।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ
লেখক ও সাংবাদিক