রাজধানীর দক্ষিণ কেরানীগঞ্জে ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামকে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও চোখ উপড়ে হত্যার আলোচিত ঘটনায় মূল পরিকল্পনাকারী রাজনসহ সরাসরি জড়িত সাতজনকে গ্রেফতার করেছে র্যাব। আসামিরা মাদকসহ নানা অপরাধে জড়িত। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিয়ে সহায়তা করতেন সাইফুল। এজন্য তাকে উচিত শিক্ষা দিতে গিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন আসামিরা।
মঙ্গলবার (১ আগস্ট) দুপুরে রাজধানী কাওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান এলিট ফোর্সের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল-মঈন।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, গত ৩০ জুলাই দিবাগত রাতে ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের খেজুরবাগ সাতপাখি এলাকায় সাইফুল ইসলাম নামে এক পোশাক ব্যবসায়ীকে কয়েকজন দুর্বৃত্ত দেশীয় ধারালো অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে হত্যা করে। ওই হত্যার ঘটনায় নিহতের বড় বোন বাদী হয়ে রাজধানীর কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। যার মামলা নং-০১।
আল মঈন বলেন, গত রাতে র্যাব সদর দফতরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-১০ এর একটি আভিযানিক দল রাজধানীর শাহবাগ এলাকায় অভিযান চালিয়ে চাঞ্চল্যকর সাইফুল হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী মো. রাজন হোসেন (৩১), জানে আলম (৩৬), সুমন ওরফে গর্দা সুমন (২৫), লিটন হোসেন (২৬), মো. দিপু (২৩), সরোয়ার আকন্দ (২৬) ও সজীবকে (২৯) গ্রেফতার করা হয়। উদ্ধার করা হয় হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত সূচালো লোহার রড, একটি ভাঙা ক্রিকেট ব্যাট, একটি ব্যাটন ও ছয়টি মোবাইল ফোন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার ব্যক্তিরা এই হত্যার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেন।
র্যার কর্মকর্তা বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ভিকটিম সাইফুল খেজুরবাগ সাতপাখি এলাকায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন। সেখানে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে কাপড়ের ব্যবসা করতেন। গ্রেফতার আসামিরাও ওই এলাকার। সাইফুল ছিলেন এলাকায় সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসার বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদী কণ্ঠ। মাদক ও সন্ত্রাসমুক্ত সমাজ গঠনে তিনি বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতেন। বিভিন্ন সময় সন্ত্রাসী ও মাদক ব্যবসা সম্পর্কে তথ্য দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও সহায়তা করতেন। এ কারণে স্থানীয় মাদক কারবারি ও অন্যান্য অপরাধীরা সাইফুলের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করে।
আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, গ্রেফতার রাজন গত ২৮ জুন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন এবং তিনি ধারণা করেন, তার এই গ্রেফতারের পেছনে সাইফুলের হাত রয়েছে। এছাড়া জানে আলম, সুমন ও তার মা ইতঃপূর্বে বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতারের পেছনেও সাইফুলের হাত রয়েছে বলে তারা ধারণা করেন। গ্রেফতার রাজন গত ১৯ জুলাই জামিনে মুক্তি পেয়ে জানে আলম, সুমন ও অন্যান্য সহযোগীদের নিয়ে সাইফুলকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন। তারা জানতে পারেন, সাইফুল চাকরির উদ্দেশে সম্প্রতি পাশ্চাত্যের একটি দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। ভিকটিমের বিদেশের যাওয়ার বিষয়টি গ্রেফতার ব্যক্তিরা বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারেন। এজন্য তাড়াহুড়ো করে রাজনের নেতৃত্বে জানে আলম, সুমন, লিটন, দিপু, সরোয়ার ও সজীবসহ ১০-১২ জনের একটি দল গত ৩০ জুলাই সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় সাইফুলকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করেন। সাইফুল দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে গ্রেফতার ব্যক্তিরা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী খেজুরবাগ স্কুল রোডে ওঁৎ পেতে থাকেন। পরে সাইফুল দোকান বন্ধ করে রাত সাড়ে ১০টায় খেজুরবাগ স্কুল রোডে এসে পৌঁছালে গ্রেফতার ব্যক্তিরা তার পথরোধ করে ক্রিকেট ব্যাট, ব্যাটন, লোহার রড ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দিয়ে নৃশংসভাবে মাথা ও শরীরের বিভিন্ন স্থানে এলোপাথাড়ি আঘাত করতে থাকেন।
একপর্যায়ে ভিকটিম মাটিতে পড়ে গেলে গ্রেফতার রাজন পাশের একটি দোকান থেকে চামচ নিয়ে এসে ভিকটিমের চোখ নৃশংসভাবে উপড়ে ফেলেন। সাইফুলের চিৎকারে স্থানীয়রা এগিয়ে এলে গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে ফেলে আসামিরা ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায়। পরে স্থানীয়রা ভিকটিমকে উদ্ধার করে রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
গ্রেফতার আসামিরা হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর এলাকা থেকে পালিয়ে কেরানীগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে হত্যার ঘটনাটি প্রকাশিত হলে তারা আত্মগোপনের উদ্দেশে রাজধানীর বাইরে চলে যাওয়ার প্রস্তুতিকালে রাজধানীর শাহবাগ এলাকা থেকে র্যাবের হাতে গ্রেফতার হন।
গ্রেফতার আসামিরা এলাকায় মাদক ব্যবসা ও অর্থের বিনিময়ে সন্ত্রাসীসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতেন। এর মধ্যে রাজন স্থানীয় একটি রিকশা গ্যারেজ চালাতেন। পাশাপাশি এলাকায় মাদক, ছিনতাই, ডাকাতি, গাড়ি চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়। ওই হত্যাকাণ্ডটি তার নেতৃত্বে সংঘটিত হয় এবং হত্যাকাণ্ডের সময় তিনি দেশীয় অস্ত্র দিয়ে সাইফুলকে উপর্যুপরি আঘাত করেন এবং চামচ দিয়ে নৃশংসভাবে চোখ উপড়ে ফেলেন। রাজনের বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, বিস্ফোরক দ্রব্য ও চুরিসহ পাঁচটির বেশি মামলা রয়েছে বলে জানা যায়।
গ্রেফতার জানে আলম রাজমিস্ত্রির কাজ করতেন। পাশাপাশি তিনি এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সাইফুল হত্যাকাণ্ডে তিনি রাজনের অন্যতম সহযোগী। হত্যার সময় জানে আলম সাইফুলকে ব্যাটন দিয়ে উপর্যুপরি আঘাত করেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, বিস্ফোরক দ্রব্য ও চুরিসহ চারটির বেশি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতার সুমন কাঠ কাটা শ্রমিকের কাজ করতেন। পাশাপাশি তিনি এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত বলে জানা যায়। তিনি এই হত্যাকাণ্ডে রাজনের অন্যতম সহযোগী ছিলেন। সুমন সাইফুলকে ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে মাথায় গুরুতর জখম করেন। তার বিরুদ্ধে অস্ত্র, মাদক, ডাকাতি ও মারামারিসহ বিভিন্ন অপরাধে চারটির বেশি মামলা রয়েছে।
গ্রেফতার লিটন, দিপু, সরোয়ার ও সজীব সাইফুল হত্যাকাণ্ডে রাজনের সহযোগী ছিলেন। লিটন মুদ্রাক্ষরিক, দিপু ও সজীব জাহাজ ভাঙার শ্রমিক এবং সরোয়ার রংমিস্ত্রির কাজ করতেন। এছাড়াও তারা গ্রেফতার রাজনের নেতৃত্বে এলাকায় মাদক, ছিনতাই, চুরিসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করতেন বলে জানা যায়। হত্যাকাণ্ডের সময় গ্রেফতার লিটন, দিপু, সরোয়ার ও সজীব লাঠি ও অন্যান্য দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ভিকটিমকে এলোপাথাড়িভাবে আঘাত করে গুরুতর জখম করেন। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধে একাধিক মামলা রয়েছে বলে জানান র্যার কর্মকর্তা।