রাকিব হাসান: পথচারীর পকেটে মাদক দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টায় গ্রেফতার পল্লবী থানার এএসআই মাহবুবুল আলমসহ তিনজনের জামিন নামঞ্জুর করেছেন আদালত। ঢাকা মহানগর হাকিম আতাউল্লাহের আদালত শুনানি শেষে তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানো হয়। কারাগারে যাওয়া অন্য আসামিরা হলো মো. রুবেল ও মো. সোহেল রানা।
রবিবার দুইদিনের রিমান্ড শেষে আসামিদের আদালতে হাজির করা হয়। এরপর মামলার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ক্যান্টনমেন্ট থানার উপপরিদর্শক মো. আনোয়ার হোসেন। এ সময় আসামিপক্ষে তাদের আইনজীবী জামিন চেয়ে আবেদন করেন। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ জামিনের বিরোধিতা করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত তাদের জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এর আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর আদালত এ তিন আসামির দুদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
মামলা সূত্রে জানা যায়, আসামি এএসআই মাহবুবুল আলম একজন সোর্সের কাছ থেকে ইয়াবার প্যাকেট নিয়ে পথচারী খলিলুর রহমানের পকেটে ঢুকিয়ে দেয় এবং তাকে প্রকাশ্যে মারধর করে সিএনজিতে তুলে নেয়। পরে ওই পথচারীর বিরুদ্ধে পল্লবী থানা থেকে মাদক মামলা দায়ের করা হয়।
পরবর্তীকালে পথচারীর পকেটে মাদক ঢুকিয়ে দেওয়ার ভিডিও একটি বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এ ঘটনায় পল্লবী থানার উপপরিদর্শক খালিদ হাসান তন্ময় বাদী হয়ে রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় এএসআই মাহবুবুল আলমসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন।
বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারিত খবর সূত্রে জানা যায়, গত মঙ্গলবার দুপুরে সাদাপোশাকে এএসআই মাহবুব সোর্স রুবেলের কাছ থেকে এক প্যাকেট ইয়াবা এনে তা খলিলুর রহমান নামের এক পথচারীর পকেটে ঢুকিয়ে দেন। পরে তাকে মাদক রাখার অভিযোগে আটক করে মারধর করেন। একপর্যায়ে মাহবুব পথচারী খলিলুরকে একটি ভাড়া করা অটোরিকশায় তুলে পল্লবী থানায় নিয়ে যান। সেখানে খলিলুরের বিরুদ্ধে মাদকের মামলা করেন তিনি। মামলায় খলিলুর বর্তমানে কারাগারে আছেন।
পরবর্তীতে, টিভিতে প্রচারের বিষয়টি কর্তৃপক্ষের নজরে আসলে বুধবার রাতেই পল্লবী থানার ওই এএসআইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। রাতেই পল্লবী থানা পুলিশ বরখাস্ত এএসআই মাহবুব সোর্স সোহেল ও রুবেলকে গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্ট থানায় সোপর্দ করে। গত ৮ সেপ্টেম্বর ক্যান্টনমেন্ট থানায় দায়েরকৃত মামলায় তাদের আদালতে হাজির করে আসামীদের রিমান্ডের আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালত তিনজন আসামীর দুইদিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এ ঘটনার পরদিন পল্লবী জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) আরিফুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবসে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
সাদা পোশাকে কোনো মাদক বিরোধী অভিযানে অংশ নিতে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কিছু কিছু অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা সেই নিষেধাজ্ঞা মানতে নারাজ। সে কারনেই কিছু অনাকাঙ্খিত ঘটনা পুলিশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুন্ন করছে বলে মতামত বিশেষজ্ঞদের।
গতকয়েক দিনে বেশ কয়েকটি অসুসন্ধানী সংবাদ সংস্থার প্রতিবেদনে উঠে এসেছে সেই এএসআই মাহবুবের মাদক মামলার নেপথ্য কাহিনী। জানা গেছে,পুলিশের ওই সোর্সের সাথে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে পল্লবী থানা এলাকার বাইরে গিয়ে খিলক্ষেত থানা এলাকায় সোর্সদের সহযোগিতায় সাদা পোশাক পরিহিত পল্লবী থানার এএসআই মাহবুব খলিলুর রহমান নামে এক পথচারীর পকেটে কথিত ইয়াবা ট্যাবলেট ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে গ্রেফতার করেন। অথচ এক থানা এলাকা থেকে অন্য থানা এলাকায় অভিযান করতে চাইলে সিনিয়র অফিসারদের অবহিত করে অনুমতি নেয়া ও সংশ্লিষ্ট থানার দায়িত্ব প্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অবহিত করার বিধান রয়েছে ডিএমপি অধ্যাদেশে। অথচ কোন নিয়ম কানুনই পালন করেননি এএসআই মাহবুব। সোর্সদের সাথে নিয়েই অভিযানে চলে গেছেন। টিভিতে প্রচারিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে “সে পোষাক পরিহিত না থাকলেও তার হাতে সরকারী ওয়্যারলেস সেট“ । তাহলে কি সিনিয়র অফিসাররা তাদের অধীনস্তদের ঠিকমত তদারকী করছেন না?? নাকী তারাই এসবের মদদ দিচ্ছেন,প্রশ্ন উঠেছে জনমনে।
ঘটনা সূত্রে জানা গেছে,পল্লবী থানার এএসআই মাহবুবের সোর্স রুবেলকে ব্যবহার করে দীর্ঘদিন যাবৎ এধরনের অপরকর্মের মাধ্যমে টার্গেটকৃতদের পকেটে অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য ঢুকিয়ে ব্ল্যাকমেইল করে মামলার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকে অর্থ হাতিয়ে নিতেন তারা। এএসআই মাহবুব তার কোনো উর্ধতন কর্মকর্তাকে কিছু না জানিয়ে কর্মস্থল পল্লবী থানা থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে মাদক বিরোধী অভিযান পরিচালনা করতে যাবার পক্ষে কোনো ইতিবাচক যুক্তি খুঁজে পাচ্ছেননা কেউই।
স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শী ও মামলা সূত্রে জানা গেছে,ঘটনার সময় এএসআই মাহবুব ১৩৫ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেটসহ অভিযুক্ত খলিলুর রহমানকে আটক করেছেন বলে ঘটনাস্থলে উপস্থিত জনসাধারণকে দেখান। সেখান থেকে সিনজিতে চড়ে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে পল্লবী থানায় পৌছে এজহার লেখা পর্যন্ত সময়টুকুর ব্যবধানেই অদৃশ্য কারণে গায়েব হয়ে যায় পয়ত্রিশ পিছ কথিত ইয়াবা ট্যাবলেট। হারিয়ে যাওয়া ৩৫ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেটগুলো অনেক খোঁজাখুঁজি করেও সেগুলি না পেয়ে বাধ্য হয়ে একশ পিছ ইয়াবা ট্যাবলেট উদ্ধার দেখিয়েই মামলাটি দায়ের করা হয় বলে জানা গেছে।
পুলিশ বাহিনীতে এমন ঘটনা নতুন নয়। গত ১৮ আগষ্ট রাজধানীর মিরপুরের গাবতলীতে ৩৮ ভরি স্বর্ণ লুটের ঘটনায় এএসআই জাহিদ নামে রূপনগর থানার এক এএসআই আটক হওয়ার পর তার ভয়ঙ্কর রূপ বেরিয়ে এসেছিলো। তল্লাশির নামে নিরীহ মানুষকে ফাঁসিয়ে টাকা আদায়সহ বেশ কিছু অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। পুলিশের মিরপুর বিভাগের ডিসি অফিসে তার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি লিখিত অভিযোগও আছে।
জানা যায়, স্থানীয়রা এই জাহিদের নাম শুনলেই আতঙ্কিত হয়ে উঠতেন। চলতি বছর ১ মার্চ এই এএসআই জাহিদের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মিথ্যা মাদক মামলা দেওয়ায় রুপনগর এলাকার বাসিন্দা ও একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী রাসেল নামে এক ব্যক্তি মিরপুর বিভাগের ডিসির কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরার সময় মিরপুর-৭ নম্বর মিল্ক ভিটার সামনে পৌঁছালে তার কাছে ইয়াবার ট্যাবলেট রয়েছে বলে তার দেহ তল্লাশি করেন জাহিদ। কোনো মাদক না পেলেও রাসেলকে থানায় নিয়ে গাঁজা রাখার অভিযোগে মামলা দেয় পুলিশ। মূলত জাহিদের সোর্স আলামিনের সঙ্গে বিরোধ থাকায় পুলিশ তাকে আটক করে মামলা দিয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে ওই অভিযোগে।
গত বছর ১৯ আগষ্ট আগস্ট রাশিদা নামে ক্যান্সার রোগী এক নারীর বাসায় তল্লাশির নামে নগদ আড়াই লাখ টাকা লুট করে নেয়ার দাবি জানিয়ে ২১ আগষ্ট রূপনগর থানার এসআই মাসুদ ও এএসআই জাহিদের বিরুদ্ধে ডিএমপি কমিশনারের বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগে তিনি আরো জানান, চলে যাওয়ার সময় পুলিশ তাকে এও বলে যায়, টাকার কথা কাউকে জানালে ৫০ পিস ইয়াবাসহ কোর্টে চালান দেওয়া হবে তাকে। এএসআই জাহিদের আল আমিন, অপু, সোহেল ও আল ইসলাম নামে কয়েকজন সোর্স রয়েছে। এই সোর্সদের ব্যবহার করে ফাঁদ পেতে টাকা আদায় করেন জাহিদ। ডিবি পুলিশ পরিচয়ে গাবতলী থেকে ৩৮ ভরি স্বর্ণালঙ্কার লুটের ঘটনায় দারুসসালাম থানার দায়েরকৃত মামলায় রিমান্ড শেষে বর্তমানে কারাগারে আছে জাহিদ।
পুলিশের এসব অসৎ সদস্যদের এহেন কর্মকান্ডের দায় গোটা পুলিশ বাহিনীর নয় বলে জানিয়েছেন ডিএমপি মিডিয়া এন্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো: ফারুখ হোসেন। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তির কৃতকর্মের দায় কোন ভাবেই গোটা বাহিনীর হতে পারে না। এর দায়দায়িত্ব তাদেরকেই নিতে হবে। তিনি আরও জানান,পল্লবীর ঘটনায় অলরেডি মামলা হয়েছে ,তদন্তে যা বেরিয়ে আসবে সেই অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আইন অনুযায়ী যা যা করা দরকার আমরা করব। অপকর্মকারীদের পুলিশ বাহিনীতে কোন স্থান হবেনা বলে উল্লেখ করেন পুলিশের এই উর্ধতন কর্মকর্তা।