স্টাফ রিপোর্টার-মাউন হোসেন সাব্বির। পেশায় একজন ঔষধ ব্যবসায়ী। কিন্তু এই পেশার আড়ালে সে গড়ে তুলেছেন জাল নোট তৈরির কারখানা। গত এক বছরে প্রায় দুই কোটি সমমানের জালনোট তৈরি করে বাজারে ছড়িয়েছে সে। অবশেষে র্যাবের হাতে তিন সহযোগীসহ আটক হলেন মাউন।
রবিবার কারওায়ান বাজার র্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইং এর পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
তিনি জানান, প্রায় কোটি টাকার মূল্যের জাল নোটসহ জাল টাকা তৈরি চক্রের অন্যতম হোতা মোঃ মাউন হোসেন সাব্বির ও তার সহযোগীকে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব-৪ এর একাধিক আভিযানিক দল রাজধানীর চকবাজার থানার মিটফোর্ড এলাকা, সিরাজগঞ্জ সদর এবং খুলনা জেলার খালিশপুর থানা এলাকায় পৃথক অভিযান পরিচালনা করে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন মোঃ মাউন হোসেন সাব্বির (২১), মোঃ পারভেজ (২০), মোঃ তারেক (২০), মোঃ শিহাব উদ্দিন (২০)।
এসময় তাদের নিকট থেকে প্রায় ১ কোটি টাকার সম মূল্যের জাল নোট যার মধ্যে ১০০০, ৫০০, এবং ১০০ টাকার সমমানের জাল নোট, ১টি ল্যাপটপ, ১টি প্রিন্টার, ১টি পেনড্রাইভ, এন্টি কাটার ১টি, টাকার পাঞ্চিং ১ রোল, জিলেটিং ৫০০ গ্রাম, প্রিন্টারে ব্যবহৃত কালির খালি বোতল ১২টি, গালা ৫০০ গ্রাম, স্পিরিট ০৬ বোতল, ফেবিকল আঠা ৬ বোতলসহ জালনোট তৈরীর বিপুল পরিমান সরঞ্জামাদি জব্দ করে র্যাব সদস্যরা।
কমান্ডার মঈন জানান, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃতরা জানিয়েছে, তারা পরষ্পর যোগসাজশে প্রায় এক বছর যাবৎ ঢাকা, খুলনা ও যশোরসহ বিভিন্ন এলাকায় জাল নোট তৈরী করে স্বল্প মূল্যে বিক্রি করত। এছাড়াও এ চক্রের সদস্যরা নিজেরাও বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং দোকান, মাছের আড়ৎসহ জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় জাল নোট ব্যবহার করত। এ চক্রটির অন্যতম হোতা গ্রেফতারকৃত মাউন হোসেন সাব্বির এবং এই চক্রের সাথে আরও ১৫-২০ জন সদস্য জড়িত রয়েছে ।
তারা কম সময়ে অল্প পুঁজিতে ধনী হওয়ার জন্য এই প্রতারণার আশ্রয় গ্রহন করে। জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, তারা ইউটিউব এবং ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে এই ধরণের জাল টাকা তৈরি ও ব্যবসার প্রতি তারা আকৃষ্ট হয়। চক্রের অন্যতম হোতা সাব্বির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক পেইজে পরিচালিত একটি গ্রুপ “জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোষ্ট” এর মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত অপর সদস্যদের সাথে তার পরিচয় হয়। পরবর্তীতে সে জাল নোটের খুচরা ব্যবসা করার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করে । সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমফেসবুকে অপর একটি জাল নোট তৈরি চক্রের সাথে তার পরিচয় হয়।
ওই চক্রটির নিকট থেকে সে তিন লক্ষ টাকার জাল নোট কেনার জন্য মোবাইল ব্যাংকিং এর মাধ্যমে এক ব্যক্তিকে ৩৫,০০০/- টাকা প্রেরণ করে। জাল নোট ক্রয়ের জন্য সে অর্থ প্রদান করলেও চক্রটি তাকে কোন জাল নোট প্রদান করেনি।
পরিচালক আরও জানান, চক্রটির কাছ থেকে সে জাল নোট না পেয়ে নিজেই জাল নোট তৈরির জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তারা প্রথমে মেসেঞ্জার এ X-MAN নামে একটি গ্রুপ খুলে জাল টাকা তৈরী-ব্যবসার বিষয়ে তথ্য আদান-প্রদান করে। এই গ্রুপের এ্যাডমিন হিসেবে শিহাব কাজ করত। শিহাবের মাধ্যমে গ্রেফতারকৃত অপর দুই সদস্য পারভেজ এবং তারেক এর সাথে তার পরিচয় হয়।
পরবর্তীতে সে ইউটিউব, ফেসবুক এবং গুগল ঘেটে জাল নোট তৈরির বিভিন্ন বিষয়ে কারিগরি জ্ঞান অর্জন করে এবং বিভিন্ন সময়ে জমানো অর্থ দিয়ে জাল নোট তৈরির জন্য ল্যাপটপ, প্রিন্টার, প্রিন্টিং ডাইস, পেনড্রাইভ, কাগজ, টিস্যু পেপার ও প্রিন্টারের কালিসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি ক্রয় করে।
গ্রেফতারকৃত সাব্বির জালনোট তৈরির সার্বিক বিষয়ে দক্ষ হওয়ায় সবকিছু সে নিজেই পরিচালনা করত। যখন জাল নোটের ব্যবসা রমরমা থাকে তখন চক্রটি দৈনিক ০২ লক্ষাধিক টাকা মূল্যমানের জাল নোট তৈরি করত। মূলত তারা একটি অভিনব কায়দায় জাল নোটগুলো বিক্রয় করত। তারা তাদের পূর্বের ফেসবুক গ্রুপ “জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী পোষ্ট”থেকে কমেন্টস দেখে তাদের সাথে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাটিং এর মাধ্যমে ক্লাইন্ট তৈরী করে জাল টাকার ব্যবসা করত।
পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চক্রের সদস্যেদের মাধ্যমে ঢাকাসহ সিরাজগঞ্জ, খুলনা, যশোর এলাকায় সরবরাহ করত।
তারা কখনো সরাসরি জাল নোটগুলো ক্লাইন্টকে দেখাত না। গ্রুপ থেকে ক্লাইন্টদেরকে সিলেক্ট করে তাদের সাথে ম্যাসেঞ্জার গ্রুপের মাধ্যমে কথাবার্তা বলে তাদের কাছ থেকে অগ্রীম টাকা নিয়ে নিত। তারা প্রতি ১ লক্ষ টাকা মূল্যের জাল নোট ১৫-২০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করত।
চক্রটি মূলত জাল নোট তৈরি ও বাজারজাত করণের জন্য ঢাকাকে নিরাপদ ও সহজ স্থান বলে মনে করত। চক্রটি সাধারণত বিভিন্ন মেলা, উৎসব, পূজা, ঈদে পশুর হাটে ও অধিক জনসমাগম অনুষ্ঠানে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে জাল নোট ব্যবহার করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে জালনোট প্রিন্টিং এর সময় কাগজের অব্যবহৃত ও নষ্ট অংশগুলো পুড়িয়ে ফেলত।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে তাদের কাজ পরিচালনা করত। এ পর্যন্ত চক্রটি বিভিন্ন সময়ে প্রায় ০২ কোটি মূল্যমানের জাল নোটের ব্যবসা করেছে বলে জানা যায়।
র্যাব জানায়, গ্রেফতারকৃত সাব্বির বগুড়া থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ২০১৯ সালের শেষের দিকে ঢাকায় এসে মিটফোর্ডে তার দুঃসম্পর্কের মামার ঔষুধের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করার পাশাপাশি ঢাকাতে অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যায়নরত। সে তার নিজ পেশার আড়ালে জাল নোট তৈরি চক্রটির অন্যতম হোতা হিসেবে প্রায় এক বছর যাবৎ চক্রটি পরিচালনা করছিল ।
গ্রেফতারকৃত শিহাব স্থানীয় একটি কলেজে ডিগ্রী প্রথম বর্ষে অধ্যয়নরত। সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপে জাল নোট ব্যবসার সংবাদ দেখে জাল টাকার ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরবর্তীতে“জাল টাকা প্রতারক চক্র বিরোধী” ফেসবুক গ্রুপের মাধ্যমে সাব্বিরের সাথে পরিচয়ের সূত্রে এই চক্রের সাথে সে জড়িত হয়। সে ইউটিউব দেখে জাল নোট প্রিন্ট করার ধারণা নেয়। চক্রটিতে সে জাল টাকা প্রিন্টিং, কাটিং এবং বান্ডিলিংসহ প্যাকিং এর কাজ করত। সে প্রায় এক বছর যাবৎ এই চক্রটির সাথে জড়িত রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত মোঃ পারভেজ ২০২০ সালে স্থানীয় একটি কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত। সে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের বিভিন্ন পেইজ ও গ্রুপে জাল নোট ব্যবসার সংবাদ দেখে জাল টাকার ব্যবসার প্রতি আকৃষ্ট হয়। পরবর্তীতে শিহাবের মাধ্যমে সাব্বিরের সাথে তার পরিচয় হয়। সাব্বির এর সাথে পরিচয়ের সূত্রে সে চক্রটির সাথে জড়িত হয়। সে ইউটিউব এ ভিডিও দেখে জাল টাকা তৈরি করা সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে। চক্রটিতে সে কম্পিউটারে গ্রাফিক্স এর মাধ্যমে জাল নোট তৈরি এবং প্রিন্টিং এর কাজ করত। সে প্রায় এক বছর যাবৎ এই চক্রটির সাথে জড়িত ।
গ্রেফতারকৃত তারেক স্থানীয় একটি কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে অধ্যয়নরত। শিহাবের মাধ্যমে সাব্বিরের সাথে তার পরিচয় হয়। সাব্বির এর সাথে পরিচয়ের সূত্রে সে চক্রটির সাথে জড়িত হয়। সে স্থানীয় বাজার হতে জাল নোট তৈরির প্রয়োজনীয় উপকরণ ক্রয় করত। সে প্রায় এক বছর যাবৎ এই চক্রটির সাথে জড়িত।