আন্তর্জাতিক ডেস্ক – রাজমুকুট পরার মধ্য দিয়ে রাজা হিসেবে অভিষিক্ত হলেন রাজা তৃতীয় চার্লস। গত বছর সেপ্টেম্বরে ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যুর পর তার বড় ছেলে যুবরাজ চার্লস উত্তরাধিকার হিসেবে তাৎক্ষণিকভাবে রাজা তৃতীয় চার্লস হিসেবে পরিচিত হন। রাজা হিসেবে স্বীকৃতি পেলেও রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা সে সময় হয়নি। কয়েক মাসের বিস্তারিত প্রস্তুতি শেষে তৃতীয় চার্লসকে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজমুকুট পরিয়ে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে অভিষিক্ত করা হলো।
শনিবার ধর্মীয় অনুশাসন আর ব্রিটিশ কেতা মেনে লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে অভ্যাগত ও রাজপারিষদদের সামনে ব্রিটেনের রাজা হিসেবে আনুষ্ঠানিক অভিষেক হলো তৃতীয় চার্লসের। গত ৭০ বছর ধরে ব্রিটেনের রাজমুকুটের উত্তরাধিকারী হিসেবে জীবন কাটিয়ে অবশেষে মুকুট পরেন চার্লস। এই অভিষেক অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবিতে কয়েক হাজার অতিথির পাশাপাশি আশপাশে সেন্ট্রাল লন্ডনের রাস্তাগুলোতে উপস্থিত থাকেন প্রজারা।
রানী দ্বিতীয় এলিবেথের মৃত্যুর পরপরই উত্তরাধিকার সূত্রে ব্রিটেনের রাজা হয়েছেন তৃতীয় চার্লস। স্বাভাবিকভাবেই সেটা ছিল রাজ পরিবার এবং দেশের জন্য শোকের সময়। ব্রিটেন সর্বোচ্চ সময় ধরে সিংহাসনে থাকা সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী শাসককে বিদায় জানিয়েছে।
আট মাস পরে সময় বদলেছে, রাজ্যাভিষেকের অনুষ্ঠানও তাই ভিন্ন আমেজ বয়ে আনে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অতিথিরা যান এই জাঁকজমকপূর্ণ রাজ্যাভিষেক অনুষ্ঠানে অংশ নিতে এবং কোটি কোটি মানুষ সরাসরি এই রাজ্যাভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা দেখেন। বাংলাদেশ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন।
ইংরেজি ‘করোনেশন’ বা ‘রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়া’র শব্দটি ল্যাটিন শব্দ ‘করোনা’ থেকে এসেছে যার অর্থ ‘ক্রাউন’ বা ‘মুকুট’। তবে এর ব্যপ্তি শুধু শাব্দিক অর্থেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এই ‘করোনেশন’ হচ্ছে একটি ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে রাজ্য, গির্জা ও রাজ পরিবারের একত্রিত হওয়ার উপলক্ষ, যেখানে রাজা ঈশ্বর ও দেশের সেবা করার শপথ নেন।
শুধু ইংল্যান্ডের ক্যান্টরবুরির আর্চবিশপই ব্রিটেনের রাজা বা রানির অভিষেকের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার অধিকার রাখেন। সে অনুযায়ী বর্তমান আর্চবিশপ জাস্টিন ওয়েলবি এ আনুষ্ঠানিকতা পরিচালনা করেন। ধর্মীয় এই আচার-অনুষ্ঠান কয়েকটি ধাপে বিভক্ত থাকে। স্বীকৃতি, শপথ, পবিত্র তেলে সিক্ত করা, সিংহাসনে আরোহন, রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়া ও সংবর্ধনা বা রাজার প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন। এরপর রাজাকে স্বীকৃতি দানের পালা। এবার শুধু প্রিন্স উইলিয়ামই একমাত্র রয়্যাল ডিউক হিসেবে হাঁটু গেড়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। অভিষেকে রাজার হাতে তুলে দেওয়া হয় রাজ্যের শাসনভারের বিভিন্ন প্রতীক।
এসব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাজা ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবির থিয়েটারে গিয়ে দাঁড়ান এবং জনগণের সামনে নিজেকে উপস্থাপন করেন। এবারই প্রথম স্বজনদের পরিবর্তে আর্চবিশপ অব ক্যান্টরবুরি অতিথিদের অ্যাবিতে আমন্ত্রণ জানান।
এর আগে করোনেশনের শপথ হয়, আইন অনুযায়ী দেশ শাসন, দয়া ও ক্ষমার মাধ্যমে বিচার করা এবং চার্চ অব ইংল্যান্ডকে সমুন্নত রাখার শপথ নেন রাজা। শপথের পর আর্চবিশপ রাজাকে পবিত্র তেলে সিক্ত করেন। এই পবিত্র তেলে সিক্ত করার মুহূর্তটিকে রাজ্যাভিষেকের সবচেয়ে পবিত্র মুহূর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং ১৯৫৩ সালে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের অভিষেকের সময় ওই মুহূর্তটি টিভিতে দেখানো হয়নি।
আনুষ্ঠানিকতার শেষ পর্যায়ে সেইন্ট এডওয়ার্ডের রাজমুকুট রাজার মাথায় পরিয়ে দেওয়া হয় এবং এরপর রাজপুত্ররা ও রাজপরিবারের সদস্যরা নতুন রাজার প্রতি তাদের আনুগত্য প্রদর্শন করেন।
রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেকের সময় ১৯০২ সাল থেকে এটা এক ধরনের রীতি হিসেবে প্রচলিত হয়ে গেছে যে বাকিংহাম প্রাসাদের সামনে মলে উপস্থিত জনগণকে প্রাসাদের বারান্দা থেকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাবেন সদ্য অভিষিক্ত রাজা বা রানি।
১৯৫৩ সালে অভিষেকের দিনে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ তার মা ও স্বামী-সন্তান-পরিজনদের নিয়ে বারান্দায় উপস্থিত ছিলেন এবং সামরিক বিমানের ফ্লাইপাস্ট উপভোগ করেন। রাজা চার্লস এবং তার স্ত্রী ক্যামিলাও এই রীতি বজায় রাখেন।
রাজার সিংহাসন আরোহণের আনুষ্ঠানিতা শেষ হওয়ার পর রানিকে পবিত্র তেল দিয়ে সিক্ত করা হয় এবং এর পর তাকেও রাজমুকুট পরিয়ে দেওয়া হয়। এর আগের তিনজন কুইন কনসোর্ট – রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের স্ত্রী আলেকজান্দ্রা; রাজা পঞ্চম জর্জের স্ত্রী মেরি এবং রাজা চতুর্থ জর্জের স্ত্রী এলিজাবেথের মত চার্লসের স্ত্রী ক্যামিলার জন্য আলাদা করে কোনো মুকুট বানানো হয়নি। বরং তিনি রানি মেরির রাজমুকুট পরবেন। ১৯১১ সালে এই রৌপ্য মুকুট গড়েছিলেন রানি মেরি। তার উদ্দেশ্য ছিল পরবর্তী কুইন কনসোর্টদের জন্য একটি স্থায়ী রাজমুকুট গড়া।
প্রাসাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ক্যামিলা নিজেই এই রাজমুকুট বাছাই করেছেন, তবে মুকুটে সামান্য কিছু পরিবর্তনও করছেন তিনি। প্রয়াত রানীর প্রতি সম্মান জানিয়ে এবং তাকে স্মরণে রাখতে তার ব্যক্তিগত সংগ্রহে থাকা কালিনান থ্রি, ফোর ও ফাইভ নামের হীরাগুলো মুকুটে যুক্ত করছেন ক্যামিলা। শপথ অনুষ্ঠানে বিশ্বের প্রায় ১০০টি রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান উপস্থিত হন। উপস্থিতিদের জন্য সেন্ট্রাল লন্ডনে ছিল ব্যাপক নিরাপত্তা। অভিষেক অনুষ্ঠানে প্রিন্স হ্যারি, ডিউক অফ সাসেক্স, যিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে শুক্রবার একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে এসে পৌঁছেছেন। টনি ব্লেয়ার, লিজ ট্রাস, বরিস জনসনসহ বেশ কয়েকজন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ওয়েস্টমিনস্টার অ্যাবেতে উপস্থিত হয়েছেন।
রাজা তৃতীয় চার্লস এবং রানি ক্যামিলার ঐতিহাসিক রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে অভিনন্দন জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্রিটেনের নতুন রাজা এবং রানির আনুষ্ঠানিক রাজ্যাভিষেক উপলক্ষ্যে শুভেচ্ছা বার্তায় গ্রেট ব্রিটেন ও উত্তর আয়ারল্যান্ডের নতুন রাজা এবং কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে তৃতীয় চার্লসকে আন্তরিক সমর্থন জানান শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি নিশ্চিত, দূরদর্শী এবং জ্ঞানী নতুন রাজার রাজত্বকালে যুক্তরাজ্যের জনগণ শান্তি ও সমৃদ্ধ একটি উন্নত ভবিষ্যৎ উপভোগ করতে পারবেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আগামীদিনে কমনওয়েলথভুক্ত দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্ব আরো শক্তিশালী করতে আপনার (রাজা) সঙ্গে কাজ করতে পারা আমার জন্য সম্মানের।
রাজা তৃতীয় চার্লস এবং রানি ক্যামিলার সুস্বাস্থ্য, সুখ ও দীর্ঘায়ু এবং যুক্তরাজ্যের বন্ধুত্বপূর্ণ জনগণের শান্তি অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।