স্টাফ রিপোর্টার- প্রতি বছরের মতো এবারও ফায়ার সার্ভিস সপ্তাহ উদযাপন করা হচ্ছে। সারাদেশে অগ্নিনিরাপত্তা জোরদার করতে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কার্যক্রমে জনসম্পৃক্ততা বাড়ানোর লক্ষ্যে এ ফায়ার সার্ভিস সপ্তাহ উদযাপন করা হয়।
মঙ্গলবার সারা দেশে এক যোগে শুরু হয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ ২০২২। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন।
উদ্ভোধনী অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং কমপ্লেক্সে অনুষ্ঠিত মুল আয়োজনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সপ্তাহ-২০২২ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে বলেন, অগ্নিনির্বাপণকারীরা দুঃসময়ের বন্ধু। তাঁর সরকার ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সকে পূর্ণ সক্ষমতার সর্বোচ্চ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সকে সম্পূর্ণ সক্ষমতার সাথে সর্বোচ্চ সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যবস্থা নিচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা, সেবার ক্ষেত্র এবং কর্তব্যরতদের মর্যাদাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। কারণ আগুন লাগলে বা কোন দুর্ঘটনা বা ভূমিকম্প বা কোন কিছু ঘটলে অথবা কোন ভবন ধসে গেলে ফায়ার সার্ভিসই সকলের আগে ছুটে যায়। এমনকি কোন জাহাজ বা লঞ্চ যখন দুর্ঘটনায় পড়ে তখনও এই ফায়ার সার্ভিসকেই আমরা পাই। তাই তাদেরকে আরো যুগোপযোগী করা একান্ত প্রয়োজন। আর সেই পদক্ষেপই আমরা নিয়েছি। এর সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং সেবার ক্ষেত্র আরো সম্প্রসারণে বিভিন্ন পদক্ষেপও আমরা গ্রহণ করেছি।
তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিস সম্পূর্ণ সক্ষমতার উচ্চ ক্ষমতার সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে যাতে রূপান্তরিত হয় সেই ব্যবস্থাই আমরা গ্রহণ করেছি। প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস প্রতিষ্ঠার যে ঘোষণা আমরা দিয়েছিলাম তা এখন শেষ পর্যায়ে। যারা এই কাজে সম্পৃক্ত তারা যেন উন্নত মানের প্রশিক্ষণ ও যন্ত্রপাতি পান সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বঙ্গবন্ধু ফায়ার একাডেমী প্রতিষ্ঠারও উদ্যোগ নিয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী সীতাকুন্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে সাম্প্রতিক বিধ্বংসী অগ্নিকান্ডে কর্তব্যপালনকালে নিহত ৩০ জন অগ্নিনির্বাপণ কর্মীকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। তিনি তাঁদের আত্মার শান্তি কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স এর সেবার সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিপুল পরিমাণ উন্নত, আধুনিক, প্রযুক্তি সুবিধা সম্বলিত বিশ্বমানের অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সরঞ্জাম সংগ্রহ করেছি। সর্বশেষ আমরা বিশ্বের সর্বাধিক উচ্চতার ৬৮ মিটারের লেডার সম্বলিত টিটিএল গাড়ি ফায়ার সার্ভিসের বহরে যোগ করেছি। ৬৮ মিটারের ৫টি গাড়ি ক্রয় করা হয়েছে। এছাড়া এ অর্থবছরেই ১১টি টার্নটেবল লেডার (টিটিএল) ক্রয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ২টি রিমোট কন্ট্রোল ফায়ার ফাইটিং ভেহিক্যাল দেয়া হয়েছে। নদী পথে সক্ষমতা বাড়াতে ২৪টি রেসকিউ বোট ও ১০টি ফায়ার ফ্লোট কেনা হয়েছে।
সরকার প্রধান বলেন, লিঙ্গ সমতা দূর করতে ফায়ারম্যান পদের নাম ফায়ার ফাইটার করা হয়েছে। পরিদর্শকের সংখ্যা ৫০ থেকে ২৬৮, ডুবুরির সংখ্যা ২৫ থেকে ৮৫, অ্যাম্বুলেন্স সংখ্যা ৫০ থেকে ১৯২, আগুন নেভানোর পানিবাহী গাড়ি ২২৭ থেকে ৬১৭ এবং ফায়ার পাম্প ৪৫০ থেকে ১ হাজার ৫৪৬টিতে উন্নীত করা হয়েছে। তিনি বলেন, আগে ফায়ার সার্ভিসের কেমিক্যাল টেন্ডার, ব্রিদিং টেন্ডার, ফোম টেন্ডার, হ্যাজমেট টেন্ডারের মত বিশেষ ধরণের কোনো গাড়ি ছিল না। আমরা এ ধরণের ৩৫টি বিশেষায়িত গাড়ি প্রদান করেছি। যুগের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে একসময়ের অবহেলিত এই প্রতিষ্ঠানটিকে আমরা একটি সম্মানজনক স্থানে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা (ফায়ার ফাইটার) নিজেদের জীবনবাজি রেখে মানুষের কল্যাণ করে মানুষকে উদ্ধার করে। একটি মহৎ কাজে তারা নিয়োজিত রয়েছেন। কাজেই ফায়ার সার্ভিসের প্রতিটি সদস্যই দু:সময়ের বন্ধু হিসেবে মানুষের কাছে প্রতীয়মান। তাই ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমরা বিদেশী সহায়তাও কাজে লাগিয়েছি।
আরবান বিল্ডিং সেফটি প্রকল্পের আওতায় জাইকার অর্থায়নে ফায়ার সার্ভিসের জন্য বহুতলবিশিষ্ট সদর দপ্তর ভবন নির্মাণ, বিভিন্ন ফায়ার স্টেশন পুনর্র্নিমাণ ও রেট্রোফিটিং এবং উঁচু মইয়ের গাড়ি ও বিশেষ পানিবাহী গাড়ি সংগ্রহ করা হচ্ছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। এছাড়া কোরিয়ান কো-অপারেশন এজেন্সির সহায়তায় সদর দপ্তরে একটি ইমাজেন্সি রেসপন্স কন্ট্রোল সেন্টার স্থাপন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সেবার মানোন্নয়নের পাশাপাশি তাঁর সরকার এ সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুবিধা বৃদ্ধির জন্যও কাজ করেছে। এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের পূর্ণাঙ্গ রেশন ও ঝুঁঁকিভাতা দেয়া হয়েছে। অপারেশনাল কর্মীদের জন্য ৩ রঙের মর্যাদাপূর্ণ কমব্যাট পোশাক প্রবর্তন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পদকের সংখ্যা ও সম্মানী বৃদ্ধি করা হয়েছে। উদ্ধার কাজের সুবিধার্থে জার্মানির তৈরি ৩টি জাম্বু কুশন হস্তান্তর করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টে আমরা ২০ কোটি টাকা অনুদান দিয়েছি। আরো ২০ কোটি টাকা এই ট্রাস্ট ফান্ডে অনুদান দেবেন বলেও অনুষ্ঠানে ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী।
শেখ হাসিনা বলেন, গত ১০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যগণ ১ লাখ ৯২ হাজার ৮৭টি অগ্নি দুর্ঘটনায় অংশ নিয়ে ১৬ হাজার ৩০৩ কোটি ৬০ লাখ টাকার সম্পদ রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। একই সময়ে এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীগণ ১ লাখ ২৯ হাজার ৭৯৯টি অ্যাম্বুলেন্স কলের মাধ্যমে ১ লাখ ২৬ হাজার ৮৩৯ জন রোগী হাসপাতালে স্থানান্তর করেছেন। ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬ লাখ ১৩ হাজার ৬১ জন শিক্ষার্থীকে অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ে মৌলিক প্রশিক্ষণ এবং পোশাক শিল্প প্রতিষ্ঠানের ৯ লাখ ২৫ হাজার ২৪০ জন কর্মীকে ২ দিনব্যাপী অগ্নি নিরাপত্তা বিষয়ক প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। এছাড়া ভূমিকম্পের মতো বড় দুর্যোগ প্রতিরোধে হেলপিং ফোর্স হিসেবে তারা ৬২ হাজার ভলান্টিয়ার তৈরির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে এখন পর্যন্ত ৪৯ হাজার ৪৪৯ জনকে ৩ দিনব্যাপী স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি, সারা জীবন আগুন ও ধোঁয়ায় কাজ করতে হয় বিধায় এই প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের অনেকেই অবসর বয়সে নানা রকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এ কারণে আমরা ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের আজীবন রেশন দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছি। এছাড়া এই প্রতিষ্ঠানের জনবল ৩০ হাজারে উন্নীত করার কাজও হাতে নেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করেছি। আর এই সময়ই আমরা উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাই। এই মর্যাদাকে ধরে রেখেই আমরা ২০৪১ সালে সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। এটাই আমাদের প্রত্যয় এবং লক্ষ্য।
তিনি বলেন, এরই ধারাবাহিকতায় যেকোন ঝুঁকি হ্রাস করা, মানুষের নিরাপত্তা দেয়া সেই সাথে উন্নয়নের কাজগুলো দ্রুত এবং ত্বরান্বিত করা এবং মানসম্মত করাই আমাদের সকলের প্রচেষ্টা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এদেশের প্রতিটি ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষকে বিনা পয়সায় ঘর তৈরী ও জীবন-জীবিকার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সরকারের লক্ষ্য একটি মানুষও ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবেনা,’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা সকল ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়টা হলো আমাদের উন্নয়নের গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হয়ে গিয়েছে। করোনা ভাইরাসের অভিঘাত, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ এবং স্যাংশন, কাউন্টার স্যাংশনের ফলে বিশ^ব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। এই মন্দা মোকাবেলায় এখন থেকেই আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন। তাঁর দেশের প্রতিটি মানুষ সুন্দর ভাবে বাঁচবে, উন্নত জীবন পাবে, শিক্ষা-দীক্ষায় উন্নত হবে- সেই লক্ষ্য ইনশাল্লাহ আমরা বাস্তবায়ন করবো।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও নিরাপত্তা সেবা বিভাগের সচিব আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন। স্বাগত বক্তব্য দেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন।
প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সীতাকুন্ডে সাম্প্রতিক বিএম কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকান্ডে নিহত ১৩ জন অগ্নি বীরের পরিবার সহ ৪৫ জন দমকল কর্মীর হাতে ৪টি কাটাগরিতে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স পদক-২০২২ তুলে দেন। প্রধানমন্ত্রী বাহিনীর কুচকাওয়াজ প্রত্যক্ষ করেন এবং রাষ্ট্রীয় সালাম গ্রহণ করেন।
মঙ্গলবার রাজধানীর মিরপুরস্থ ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কমপ্লেক্সের প্যারেড গ্রাউন্ডে সকাল ১০টায় ফায়ার সপ্তাহ উপলক্ষে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল্লাহ আল মাসুদ চৌধুরী। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করছেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকাসহ সব বিভাগ ও প্রতিটি জেলায় বেলা ১১টায় ফায়ার সার্ভিস সপ্তাহের উদ্বোধন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।