মিথুন আশরাফ – কিছু চাইনা, শুধু পেট ভরে খেতে চাই। খাবারের কষ্টে ফুটবল খেলা শুরু করা অদম্য মেয়েরা এখন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্রকে আরও গর্বিত করছে। বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ফুটবল টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু। কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের ছোট্ট মেয়েদের সাফল্য দিয়ে শুরু। আজ নারী ফুটবলাররা সাফ চ্যাম্পিয়ন। দক্ষিণ এশিয়ার সেরা দল। অথচ কেউ বাবাকে হারিয়ে, কেউবা মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, আবার কেউ বোনের অলংকার বিক্রি করে কিংবা কেউ আবার পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ খেলতে যান। আর সাথে নারী ফুটবলার হওয়াতে এলাকাবাসীর তিরস্কার তো ছিলই। ফেডারেশন থেকেও যে খুব বেশি সুবিধা পেয়েছেন তাও নয়। অবহেলিতই থেকেছেন। আর বেতন বৈষম্যতো লেগেই ছিল। এমন অবস্থা থেকে সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়ে জীবনযুদ্ধ জিতেছেন সাবিনা, মারিয়া, কৃষ্ণা, সানজিদারা।
বাংলাদেশের ফুটবল তথা ক্রীড়াঙ্গনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকছে সোমবার, ১৯ সেপ্টেম্বর দিনটি। এই দিনেই যে ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এ দেশের ১৬ কোটি মানুষকে উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছেন নারী ফুটবলাররা। সাফ উইমেনস চ্যাম্পিয়নশিপের ২২ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো শিরোপা জিতে নিয়েছে লাল-সবুজের দল। দক্ষিণ এশিয়ার নারী ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্ব এখন অদম্য সাবিনা, মারিয়া, কৃষ্ণা, সানজিদাদের। অবিস্মরণীয় এ অর্জনের পথে অবশ্য বন্ধুর এক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে নারী ফুটবলারদের।
ফেসবুকে একরাশ কষ্ট বুকে নিয়ে এক পোস্টে সানজিদা আক্তার লিখেছিলেন, ‘পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আছে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত।’ জীবনের পরতে পরতে নানা বাধার শিকল ভেঙে আজ সাফল্যের চূঁড়ায় তারা।
শিরোপা জয়ের আগে বাংলাদেশ ফুটবল টিমের সানজিদা আখতার ফেসবুক স্ট্যাটাসে আরও লিখেছিলেন, ‘ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনী কে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরও নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে।’ শিরোপা জয়ের আশা পূরণ হয়েছে। এখন ছাদখোলা সংবর্ধনাও পাবেন নারী ফুটবলাররা।
এখন সময় এসেছে সব বদলে ফেলার। নারী ফুটবলারদের নিয়ে বিশেষভাবে ভাবার। সাফল্য যে তারাই দিচ্ছেন। শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকতে হয়। নারী ফুটবলারদের জন্য এবার ফুটবল নিয়ে ভাবতে হবে। যে কিশোরীরা শিরোপা জিতল, তাদের কারও বাবা কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী বা সামান্য মাইনের চাকুরে। কর্তাব্যক্তিরা এবার হয়তো আরেকটু উদার ও মনোযোগী হবেন। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পরিচর্যার পাশাপাশি পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা পেলে আরও এগিয়ে যাবে নারীরা। এগিয়ে যাবে লাল সবুজের আমাদের প্রিয় সুন্দর দেশটিও।
কয়েক বছর আগেও জাতীয় নারী দলের প্রতি কর্তৃপক্ষের অনাদর বুঝিয়েছে। জাতীয় দলের মেয়েদের ডায়েট, ট্রেনিং, কিটস সবকিছুতেই কার্পণ্যের শেষ নেই। কোনও বাণিজ্যিক সংস্থা মেয়েদের জার্সিটি পর্যন্ত স্পনসর করত না। ফেডারেশন একটা ব্র্যান্ডেড কোম্পানি থেকে সরাসরি কিনে দিত মেয়েদের। জাতীয় পুরুষ দলের বিলাসের পাশে মেয়েদের ফুটবলের প্রতি এই অবহেলা এখন ঘোচানোর সময় এসেছে। সাবিনারা দেখিয়ে দিয়েছেন, তারা আরও সুবিধা পেলে আরও বড় কিছু উপহার দিতে পারবেন।
বাংলাদেশের মেয়েদের দাপুটে এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে আসলে বঙ্গমাতা ফজিলাতুন নেছা ফুটবল টুর্নামেন্টের। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েই মূলত আয়োজিত হয় এ টুর্নামেন্ট। একেবারে শৈশব থেকেই মেয়েদের পায়ে ফুটবল তুলে দেয়ার সেই তো শুরু। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ২০১০ সালে যাত্রা শুরু করে ছেলেদের বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট। মেয়েদের বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন নেসা মুজিব গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্টের যাত্রা তার পরের বছর। এই টুর্নামেন্ট দিয়েই প্রতিবছর প্রচুর সংখ্যক নারী ফুটবলার উঠে আসছে।
দেশের ফুটবলে মেয়েদের এমন সাফল্যের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে ময়মনসিংহের ধোবাউরা উপজেলার কলসিন্দুর বিদ্যালয়ের। এই এক স্কুল থেকেই প্রায় ১২-১৩ জন খেলোয়াড় খেলছেন জাতীয় নারী ফুটবল দলের বয়সভিত্তিক বিভিন্ন দলে। এ ছাড়া প্রতিবছরই নতুন করে আরও অনেকে যুক্ত হচ্ছেন। যেন নারী ফুটবলার তৈরির আস্ত কারখানা। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, একটা গ্রাম থেকে, একটা স্কুল থেকে বছরের পর বছর এত নারী ফুটবলার উঠে আসছে কীভাবে! তাদের ইতিহাস ঘাঁটলে জানা যায়, প্রথমে ২০০৯ সালে কলসিন্দুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মেয়েরা ফজিলাতুন নেছা কাপের জন্য দল গঠন করে। যদিও প্রথম দুই বছর তারা চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। পরে আরও কঠোর পরিশ্রম আর অনুশীলনের মাধ্যমে তারা জাতীয় পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করেন। ওই মেয়েরা বড় হয়ে কলসিন্দুর উচ্চবিদ্যালয়ে যায়। তারপর একে একে যোগ দেন জাতীয় দলে। অথচ ওদের প্রায় সবারই অভাবের সংসার। কারও মা রাস্তায় কাজ করেন। কারও বাবা রিকশা চালান। কারও বা আবার শ্রমজীবী পরিবার। সে সময় যদি তাদের জিজ্ঞাসা করা হতো, তারা কী চায়, উত্তর পাওয়া যেত, পেট ভরে খেতে চাই। বেশি করে খাবার দিয়ে দিন, বাড়িতে সবাই মিলে খাব। খাবারের কষ্টে ফুটবল খেলা শুরু করা অদম্য মেয়েরা এখন বিশ্বের বুকে বাংলাদেশের মানচিত্রকে আরও গর্বিত করছে।
একজন ফুটবলারের সংগ্রামের গল্প শোনা যাক চলুন। ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী ধোবাউড়া উপজেলার এক অজপাড়া গ্রাম মন্দিরঘোনা। উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গ্রামটিতে যেতে হলে নৌকাই একমাত্র বাহন। শুকনো মৌসুমেও নেতাই নামক খরস্রোতা নদীটি পানিতে থৈ থৈ করে, তাই অনেকটা কষ্ট করেই যাতায়াত করতে হয় এলাকার মানুষজনকে। তবে অজপাড়াগ্রাম হলেও এই গ্রামটি যেন চাঁদের আলো হয়ে এসেছে এক অদম্য মেয়ে। সে আর কেউ নন, নারী ফুটবলার মারিয়া মান্দা। শহরের সব আলো-সুবিধা থেকে বঞ্চিত এই গ্রাম থেকেই উঠে এসেছেন এই অদম্য কিশোরী। তার লড়াইয়ের গল্প যে কারও চোখ ভেজাবে। গারো পাহাড়ের কোলে এক গারো পরিবারে জন্ম হয় মারিয়ার। বাবা অনেক আগেই মারা যাওয়ায় সংসার চলে শুধু মায়ের রোজগারে। মায়ের রোজগারের পথ ছিল অন্যের বাড়িতে কাজ করা। টানাপোড়েনের জীবনেও ফুটবল নিয়ে নিজের স্বপ্নটাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন অদম্য মারিয়া। শুধু মারিয়া একাই নন, শিরোপাজয়ী মেয়েদের প্রায় সবার গল্পগুলোও প্রায় একই।
সাফ চ্যাম্পিয়ন এই দলে আছেন কলসিন্দুর গ্রামের ৮ ফুটবলার খেলেছেন। মারিয়া মান্দা, সানজিদা আক্তার, শিউলি আজিম, তহুরা খাতুন, শামসুন্নাহার সিনিয়র ও জুনিয়র, সাজেদা খাতুন, মার্জিয়া আক্তার। সিরাত জাহান স্বপ্নার বাড়ি রংপুর। আঁখির বাড়ি সিরাজগঞ্জ। বাংলাদেশ অধিনায়ক এবং গোল্ডেন বুটজয়ী সাবিনা খাতুন এবং মাসুরা সাতক্ষীরার মেয়ে। কৃষ্ণা টাঙ্গাইলের, মনিকা আর রূপনা রাঙামাটির। আনাই আর আনচিং যমজ বোন খাগড়াছড়ির। নীলুফার ইয়াসমিন কুষ্টিয়ার।
নারী ফুটবলাররা দেশের মানুষের জন্য উৎসবের উপলক্ষ্য এনে দিয়েছে। অথচ মেয়েরা হাফ প্যান্ট পরে খেলবেন, একসময় অনেকেই তা মেনে নিতে চাননি। ২০০৪ সালে বয়সভিত্তিক ফুটবল দিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে পা রাখা শুরু। এরপর গত কয়েক বছর ধরেই ধারাবাহিকভাবে সাফল্য পেয়ে আসছিল নারী ফুটবল দল। বয়সভিত্তিক সাফে শিরোপা জয়তো ডালভাত হয়ে গেছে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় ভারতকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-১৫ সাফের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশের স্বর্ণকিশোরীরা। তাদের সেই সাফল্যের শুরুটা বাংলাদেশের ফুটবলে নতুন দিগন্তের সূচনা এনে দিয়েছিল। এরপর ২০১৮ সালে ভুটানে হওয়া অনূর্ধ্ব-১৮ নারী সাফেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। সবশেষ ২০২১ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জয় বাংলাদেশের বিজয়ের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করে। আর এবার সবকিছুকে ছাপিয়ে জিতল সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপ। ফাইনালে নেপালকে ৩-১ গোলে হারিয়ে প্রথমবারের মতো এ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় করে নিল বাংলাদেশ নারী ফুটবল দল।
সাফ নারী ফুটবল চ্যাম্পিয়ন মানেই ভারতের শিরোপা জেতা যেন নির্ধারিতই ছিল। বাংলাদেশ সেই পথ নতুন করে লিখেছে। ছয়বারের চ্যাম্পিয়নশিপে এরআগে টানা পাঁচবার ভারত শিরোপা জিতলেও এবার বাংলাদেশ জিতল। ভারতকে পেছনে ফেলে দিল। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানকে উড়িয়ে, ভারতকে হারিয়ে, নেপালকে ফাইনালে সহজেই ডুবিয়ে শিরোপা নিজেদের করে নিল বাংলাদেশ।
তবে বয়সভিত্তিক পর্যায়ে ভালো খেললেও জাতীয় দলে তেমন আশাজাগানিয়া ফল আসছিল না। ২০১৬ সালে সাফ শিরোপার খুব কাছাকাছি গিয়েও স্বপ্নভঙ্গ হয়। ভারতের কাছে হারতে হয়। এবার ভারতকে আগেই হারিয়ে দেয় বাংলাদেশ। তখনই বাংলাদেশের শিরোপা জেতার আশা ভালোভাবে তৈরী হযে যায়। শিরোপা জিতেও বাংলাদেশ।
দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিতে পারেনি নারী ফুটবলাররা। এরপর কী দুর্দান্ত টুর্নামেন্ট খেলল বাংলাদেশ। ফাইনালে স্বাগতিক নেপালকে ৩-১ গোলে হারানোর আগে গ্রুপপর্বে মালদ্বীপকে ৩-০, পাকিস্তানকে ৬-০, ভারতকে ৩-০ এবং সেমিফাইনালে ভুটানকে ৮-০ গোলে হারায় বাংলাদেশ। কোন দলই বাংলাদেশের কাছে পাত্তা পায়নি। দক্ষিণ এশিয়ার নতুন চ্যাম্পিয়নরা টুর্নামেন্টে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। টুর্নামেন্টে বাংলাদেশ গোল দিয়েছে ২৩টি। বিপরীতে খেয়েছে মোটে একটি। সেটি ফাইনালে।
নারী ফুটবলারদের বেতন বৈষম্যতো ছিলই। সাথে ঢাকায় কোন টুর্নামেন্ট খেলে বাড়িতে যেতে হল লোকাল বাসে চড়ে। বিশেষ কোন সুবিধাই ছিল না। তাদের জন্য এখন বাসের ব্যবস্থা হচ্ছে। বেতনও বাড়বে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে, তাদের কঠিন দিনই পার করতে হয়েছে। তারা মাসিক বেতন পেতেন মাত্র ১০ হাজার টাকা! লীগ খেললে পান সর্বোচ্চ ৩-৪ লাখ টাকা। যেখানে একজন পুরুষ ফুটবলার লীগ খেললে কোটি টাকা পান। সেখানে নারী ফুটবলারদের আয় ধারেকাছে নেই। এই হিসেবটিই যদি ক্রিকেটের সঙ্গে মেলানো যায়, তাহলে আকাশ পাতাল ভিন্নতা থাকছে। একজন ক্রিকেটার বেতন পান সর্বোচ্চ ৮ লাখ টাকা। ম্যাচ ফি’তো আছেই। আর নারী ক্রিকেটাররা সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকা মাসিক বেতন পান। ম্যাচ ফিও আছে। নারী ফুটবলাররা কতটা বঞ্চিত তা বোঝাই যাচ্ছে। আবার ৫ বছর কোন মেয়ে বিয়ে করতে পারবেন না, চুক্তিতে এই শর্তও জুড়ে দেয়া হয়। অথচ এই নারী ফুটবলাররাই দেখিয়ে দিয়েছেন তারা কি করতে পারেন। দেশকে গর্বিত করেছেন তারা।