স্টাফ রিপোর্টার- বায়ুদূষণ রোধে বুধবার থেকে বিশেষ অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনমন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন। এছাড়া এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োজনে তিনি অভিযানে অংশগ্রহণ করবেন বলে জানান।
মঙ্গলবার নিজ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের এ নির্দেশনা দেন তিনি।
মন্ত্রী বলেন, পরিবেশ অধিদপ্তরে বর্তমানে তিনজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট রয়েছেন। তাদের মাধ্যমে বুধবার থেকেই বায়ুদূষণকারী প্রতিষ্ঠান ও যানবাহনের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করতে হবে।
অভিযানের সংখ্যা ও পরিধি বাড়াতে জরুরিভিত্তিতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদায়নের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানাতে বলেছেন তিনি। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রয়োজনীয় সংখ্যক সদস্য দিতে জননিরাপত্তা বিভাগকে অনুরোধ করেন।
তিনি বলেন, দেশের বায়ুদূষণের এ পরিস্থিতি কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়। তাই বায়ুদূষণ রোধে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরকে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে কার্যকর আইনি সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
পরিবেশমন্ত্রী এসময় হাইড্রলিক হর্ন ও শব্দদূষণ বন্ধে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালককে নির্দেশ দেন।
সভায় উপস্থিত ছিলেন মন্ত্রণালয়ের উপমন্ত্রী হাবিবুন নাহার, সচিব ডক্টর ফারহিনা আহমেদ, অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন, অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. মিজানুল হক চৌধুরী, অতিরিক্ত সচিব (জলবায়ু পরিবর্তন) মো. মনিরুজ্জামান, অতিরিক্ত সচিব (পরিবেশ) সঞ্জয় কুমার ভৌমিক।
এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, পৃথিবীতে প্রতিবছর সড়ক দুর্ঘটনা, ধূমপান ও ডায়াবেটিস-এ তিনটি কারণে যেসংখ্যক মানুষ মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় বায়ুদূষণের কারণে। পরিবেশ ও চিকিৎসাবিদ্যা মতে, বায়ুদূষণ থেকে ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (সিওপিডি) নামে শ্বাসতন্ত্রের যে রোগ হয়, তা বিশ্বজুড়ে মানুষের মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ। আর ২০১২ সালে শুধু এ রোগেই পৃথিবীতে যে পাঁচটি দেশে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, বাংলাদেশ তার অন্যতম। কারণ, বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাসহ এ দেশের বড় শহরগুলোয় বায়ুদূষণের মাত্রা অত্যন্ত বেশি।
বায়ুদূষণ ও এর ক্ষতিকর প্রভাববিষয়ক চিত্রটি অত্যন্ত উদ্বেগের। শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশেই ঘটছে পরিবেশদূষণ। বিশ্বের প্রভাবশালী স্বাস্থ্য সাময়িকী দ্য ল্যানসেটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পরিবেশদূষণের কারণে ঘটা মৃত্যুর দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষে। আর রাজধানী ঢাকা তো অনেক বছর ধরেই বসবাসের অযোগ্য ও নিকৃষ্টতম শহরগুলোর একটি, যার অন্যতম কারণ পরিবেশ দূষণ।
অনিয়ন্ত্রিত যানবাহন, বাড়ি ও কলকারখানার দূষিত ও রাসায়নিক পদার্থ নির্গমন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, নাগরিক অসচেতনতা ইত্যাদি পরিবেশ দূষণের কারণ। ২০১৯ সালে WHO ১০টি স্বাস্থ্যঝুঁকি চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে এক নম্বর ঝুঁকি হলো বায়ুদূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তন। আর ২০১৮ সালে সংস্থাটির হিসাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা ছিল তৃতীয়। ঢাকার বায়ুদূষণের এ চিত্র সরকারি সংস্থা পরিবেশ অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণেও উঠে এসেছে। সংস্থাটির পর্যবেক্ষণে ঢাকার বায়ুমান মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর।
ঢাকা শহরের বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫। WHO-এর তথ্যানুসারে, পিএম ২.৫ শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে সহজেই শরীরে প্রবেশ করে তা শ্বাসতন্ত্রের নানা রোগসহ হৃদরোগের পরিমাণ বাড়ায় এবং পিএম ২.৫-এর কারণে অ্যাজমা ও ফুসফুসের ক্যানসারও হতে পারে। আর বায়ুদূষণের কারণে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ২২ হাজার ৪০০ মানুষের মৃত্যু হয়।
ঢাকার বাতাস দূষিত হওয়ার কারণ কী এবং তা রোধে পরিবেশ অধিদপ্তর কী পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানাতে ইতোপূর্বে মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। একইসঙ্গে যেসব পরিবহণ নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, সেসব যানবাহন জব্দ করতেও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে সুপারিশসংবলিত বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রতিবেদন হাইকোর্টে উপস্থাপনের পর আদালত ঢাকার বায়ুদূষণ রোধে মোট ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন।
মানবাধিকার ও পরিবেশবাদী সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের (এইচআরপিবি) এক রিট আবেদনের ধারাবাহিকতায় বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন। নির্মল বায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় বিশ্বব্যাংকের ৩০০ কোটি টাকায় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ টাকা পরিবেশ অধিদপ্তর কীভাবে ব্যয় করেছে, পরিবেশ উন্নয়নে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছে, এতে জনগণ কী ধরনের সুফল পাচ্ছে অর্থাৎ পুরো প্রকল্পের টাকা কীভাবে ব্যয় হয়েছে, তার ব্যাখ্যা দিতে সংশ্লিষ্টদের তলব করা হয়েছে। মহামান্য হাইকোর্টের দেওয়া ৯ দফা নির্দেশনায় সড়ক পরিবহণ আইনের বিধান অনুযায়ী পরিবহণের ‘ইকোনমিক লাইফ’ নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে। যেসব পরিবহণের ইকোনমিক লাইফের মেয়াদ শেষ হয়েছে, সেসব পরিবহণের চলাচল নিষিদ্ধ করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।