ভয়াল ১৫ আগস্ট জাতির এ কলঙ্কজনক অধ্যায়ের ২১ বছর পর মামলা হয় ১৯৯৬ সালে। সেই মামলায় ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল চূড়ান্ত রায় হয়। সেই রায়ে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পাঁচ আসামি এখনও রয়েছে বিচারের বাইরে।
আত্মস্বীকৃত পলাতক সেই পাঁচ খুনি হলেন- এ এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, শরিফুল হক ডালিম, মোসলেম উদ্দিন খান ও খন্দকার আব্দুর রশিদ। দেশের বাইরে অবস্থান করায় এ পাঁচ আসামিকে ফেরাতে ২০০৯ সালে ইন্টারপোলের মাধ্যমে প্রথম রেড নোটিশ জারি করে বাংলাদেশ পুলিশ। তাদের ফেরাতে ল ফার্মও নিয়োগ করে সরকার। কিন্তু প্রায় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকার তাদের দেশে ফিরিয়ে বিচারের মুখোমুখি করতে পারেনি।
রেড নোটিশ জারির পর যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রাশেদ চৌধুরী ও কানাডায় থাকা নূর চৌধুরীর অবস্থান শনাক্ত করা সম্ভব হয়। বাকি তিন আসামির অবস্থান ঠিক কোথায়, তা এখনও জানা যায়নি।
বাংলাদেশ পুলিশ সদরদপ্তর সূত্রে জানা যায়, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিগত সহকারী এ এফ এম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে রাজধানীর ধানমন্ডি থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেই মামলার তদন্ত শেষে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তৎকালীন এএসপি আব্দুল কাহার আখন্দ ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি ২০ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং পাঁচজনকে অব্যাহতি দেন আদালত। পরবর্তীতে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্ট ১২ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। অব্যাহতি পান তিনজন।
বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফেরানোর যে কমিটি সেটিতে আমিও ছিলাম। দুজনের অবস্থান জানা গেলেও বাকি পলাতক তিনজনের অবস্থান জানা যাচ্ছে না। ল ফার্ম নিয়োগ করেও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রাশেদ চৌধুরী ও কানাডায় অবস্থান করা নূর চৌধুরীকে ফেরানো যায়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তারা ফেরত দেয় না।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমেদ
আওয়ামী লীগ সরকার পুনরায় ক্ষমতায় আসার পর অর্থাৎ ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি পাঁচ আসামির ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। তারা হলেন- মেজর (অব.) বজলুল হুদা, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদ, মেজর (অব.) এ কে এম মহিউদ্দিন, কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান।
২০০১ সালের ২ জানুয়ারি জিম্বাবুয়েতে অবস্থানকালে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামি লে. কর্নেল (অব.) আব্দুল আজিজ পাশা মৃত্যুবরণ করেন।
২০১০ সালের ৭ এপ্রিল পলাতক আসামি লে. আব্দুল মাজেদকে (বাধ্যতামূলক অবসর) ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ওই বছরের ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করে সরকার। পলাতক বাকি পাঁচ আসামিকে এখনও বিচারের মুখোমুখি করা যায়নি।
পলাতক পাঁচ খুনিকে ফেরাতে প্রথম রেড নোটিশ জারি হয় ২০০৯ সালে
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত পলাতক পাঁচ খুনিকে ফেরাতে ২০০৯ সালে প্রথম ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। লে. কর্নেল (অব্যাহতি) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরীকে ফেরাতে ২০০৯ সালের ৩১ আগস্ট ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। তখন তার অবস্থান ছিল কানাডায়। সেই রেড নোটিশের মেয়াদ শেষ হলে ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ তা পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। তারপরও তাকে ফেরানো যায়নি।
লে. কর্নেল (অব.) এ এম রাশেদ চৌধুরীকে ফেরাতে ২০০৯ সালের ৭ জানুয়ারি প্রথম ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। সেটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৮ সালের ২৬ জুলাই। পরে তা পাঁচ বছরের জন্য বাড়ানো হয়। তার অবস্থান আমেরিকায় বলে নিশ্চিত হওয়া গেলেও ফেরানো যায়নি।
আমরা অনেক চিঠিপত্র দিয়েছি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েও আমরা আমেরিকার সরকারকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা সবসময় বলে, ইস্যুটা তাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে আছে। মাঝখানে অ্যাটর্নি জেনারেল আমাদের দেশে রাশেদ চৌধুরীর নামে যে মামলা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য চান। আমরা সব তথ্য তাকে দিয়েছি। এখন স্টেট ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্রোচ করলে তারা বলে, এটা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিষয়।
লে. কর্নেল (অব্যাহতি) শরিফুল হক ডালিমকে ফেরাতে ২০০৯ সালের ২৮ জুন প্রথম ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। সেটির মেয়াদ শেষ হয় ২০১৯ সালের ২৭ জানুয়ারি। পুনরায় পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু তাকে ফেরানো তো দূরের কথা, তার অবস্থানও নিশ্চিত করতে পারেনি ইন্টারপোল কিংবা বাংলাদেশ পুলিশ। তবে, পুলিশের ধারণা ডালিমের অবস্থান পাকিস্তান অথবা লিবিয়ায়।
লে. কর্নেল (বরখাস্ত) খন্দকার আব্দুর রশিদকে ফেরাতে প্রথম ২০০৯ সালের ৩১ আগস্ট ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয়। সেটির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ ফের পাঁচ বছরের জন্য় তা বৃদ্ধি করা হয়। কিন্তু তাকেও ফেরানো যায়নি। তার অবস্থানও নিশ্চিত করা যায়নি। তবে পুলিশের ধারণা, আব্দুর রশিদের অবস্থান লিবিয়া অথবা জিম্বাবুয়েতে।
বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আরেক পলাতক আসামি রিসালদার মোসলেহ উদ্দিন। তাকে ফেরাতে প্রথম ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ জারি করা হয় ২০০৯ সালের জুনে। সেটির মেয়াদ শেষ হলে ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর পুনরায় পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। তার অবস্থান পাকিস্তানে বলে নিশ্চিত হলেও তাকেও ফেরাতে পারেনি বাংলাদেশ পুলিশ।
এ বিষয়ে পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর (এনসিবি) সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান জানান, যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করেই পলাতক অপরাধী-আসামিদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে।
পুলিশ সদরদপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহসান ঢাকা পোস্টকে বলেন, এনসিবির সঙ্গে ইন্টারপোল ও সংশ্লিষ্ট দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগাযোগ অব্যাহত আছে। ইন্টারপোল প্রায়ই সহযোগিতা করে থাকে। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীসহ দাগি আসামি, অপরাধী ও দণ্ডপ্রাপ্তদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলমান।
জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ড. কামালউদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের ফেরানোর যে কমিটি সেটিতে আমিও ছিলাম। দুজনের অবস্থান জানা গেলেও বাকি পলাতক তিনজনের অবস্থান জানা যাচ্ছে না। ল ফার্ম নিয়োগ করেও যুক্তরাষ্ট্রে থাকা রাশেদ চৌধুরী ও কানাডায় অবস্থান করা নূর চৌধুরীকে ফেরানো যায়নি। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের তারা ফেরত দেয় না। আমরা ইন্টারপোলে ছবি, সম্ভাব্য হাতের ছাপও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু বাকি তিনজনকে ট্রেসই করা যায়নি।
সাবেক এ স্বরাষ্ট্র সচিব বলেন, চাইলেই কাউকে ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। কিন্তু চাইতে তো হবে। ইন্টারপোলে যে ৬২ জনের নাম ঝুলছে তাদের কিন্তু গ্রেপ্তার করে সংস্থাটি বাংলাদেশে পাঠাবে না। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে অপরাধীদের খুঁজে বের করা, তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে জানানো। সেটিই হচ্ছে না। এ বিষয়ে নিয়মিত মনিটরিং ও খোঁজ রাখার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদরদপ্তরের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরোর।
‘যদি কাউকে ফিরিয়ে আনতে চান, তিনি যদি ক্রিমিনাল হন, তাহলে সেই দেশের সঙ্গে চুক্তি (বহিঃসমর্পণ চুক্তি) থাকতে হবে।’
এদিকে, গতকাল সোমবার (১৪ আগস্ট) জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচ পলাতক খুনির অবস্থানের তথ্য দিতে পারলে তাকে সরকারের পক্ষ থেকে পুরস্কৃত করা হবে।
‘বঙ্গবন্ধুর দুই খুনির খবর আমরা জানি। একজন আমেরিকায় এবং আরেকজন কানাডায় অবস্থান করছে। বাকি তিনজন সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। যারা এদের তথ্য দেবে সরকার তাদের পুরস্কৃত করবে।’
যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা খুনি রাশেদ চৌধুরীকে ফেরানোর প্রসঙ্গে মোমেন বলেন, ‘আমরা অনেক চিঠিপত্র দিয়েছি। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েও আমরা আমেরিকার সরকারকে চিঠি দিয়েছি। কিন্তু তারা সবসময় বলে, ইস্যুটা তাদের অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসে আছে। মাঝখানে অ্যাটর্নি জেনারেল আমাদের দেশে রাশেদ চৌধুরীর নামে যে মামলা হয়েছে, তার বিস্তারিত তথ্য চান। আমরা সব তথ্য তাকে দিয়েছি। এখন স্টেট ডিপার্টমেন্টে অ্যাপ্রোচ করলে তারা বলে, এটা অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের বিষয়।’
কানাডায় অবস্থান করা খুনি নূর চৌধুরী প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দেশটির সরকার তাকে ফেরত দিচ্ছে না। ওরা ফাঁসির রায় কার্যকর করে এমন দেশে খুনিদের পাঠায় না। ফলে সব খুনিরা ওখানে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।’
রাশেদ-নূরকে ফেরত না দেওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার সরকারের সমালোচনা করে মন্ত্রী বলেন, ‘কানাডা-যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ, যেখানে আইন অত্যন্ত শক্তিশালী, সেখানে তারা খুনিদের আশ্রয় দিতে পারে না। যারা কি না ভয়ংকর কাজ করেছে।’