শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব জাকিয়া সুলতানা নরওয়ে, জাপানসহ অন্যান্য উন্নয়ন অংশীদারদের বাংলাদেশে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে অর্থায়নের আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ বাংলাদেশের জন্য একটি সম্ভাবনাময় খাত। বাংলাদেশ বিশ্বের মধ্যে অন্যতম প্রধান জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকারী দেশ, বাংলাদেশে ১০৮টি জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ ইয়ার্ড রয়েছে যা চট্টগ্রামস্থ সীতাকুণ্ড উপজেলাতে অবস্থিত। উল্লিখিত ইয়ার্ডগুলির মধ্যে কার্যরত রয়েছে ৫০টির মত। যাদের বার্ষিক জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা ১০ মিলিয়ন মেট্রিক টনেরও অধিক। এদেশের বার্ষিক জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের গড় প্রবৃদ্ধি প্রায় ১৪%। দেশের সামগ্রিক আয়রন চাহিদার ৬০-৭০% আসে জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াকরণ শিল্প হতে। এ খাত থেকে আয় হয় প্রায় ৮০০ মিলিয়ন ডলারেরও অধিক এবং সরকারের রাজস্ব আয় হয় প্রায় ১০০–১২০ মিলিয়ন ডলার। এ শিল্পে প্রত্যক্ষভাবে ৩০,০০০–৫০,০০০ মানুষ, পরোক্ষভাবে প্রায় ১,৫০,০০০ মানুষ নির্ভরশীল। এ শিল্পের উপর ৩০০টিরও অধিক রি–রোলিং স্টিল মিল নির্ভরশীল। ফলে দেশের সামগ্রিক টেকসই উন্নয়নে এ শিল্প ব্যাপক ভূমিকা রেখে চলেছে।
তিনি আজ রাজধানীর সোনারগাঁও প্যান প্যাসিফিক হোটেলে Inception workshop on IMO-Norway sensrec Project Phase III শীর্ষক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। শিল্প মন্ত্রণালয় ও আন্তর্জাতিক সামদ্রিক সংস্থা (আইএমও) যৌথভাবে এ কর্মশালার আয়োজন করে। এতে অন্যদের মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত নরওয়ের রাষ্ট্রদূত Espen Rikter-Svendsen এবং জাপানের রাষ্ট্রদূত IWAMA Kiminori, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এর কান্ট্রি ডিরেক্টর Tuomo Poutiainen উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া, আন্তর্জাতিক সামদ্রিক সংস্থা (আইএমও) এর অংশীদারিত্ব ও প্রকল্প বিষয়ক ডিরেক্টর Jose Matheickal ভার্চুয়ালি সংযুক্ত ছিলেন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের শিপ ব্রেকিং তথা জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৬০ এর দশকে। উক্ত সময়ে MV. Alpine নামক গ্রীক পতাকাবাহী একটি জাহাজ চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপকুলে আছড়ে পড়ে। দীর্ঘদিন উক্ত জাহাজটি মালিকানাবিহীন অবস্থায় সীতাকুন্ড উপজেলার কুমিরা ফেরিঘাটে পড়ে ছিল। পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রাম স্টীল হাউজ জাহাজটি স্ক্র্যাপ হিসেবে ক্রয় করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্থানী পতাকাবাহী Al Abbas নামক জাহাজ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। পরবর্তীতে উক্ত জাহাজটি ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থায় ফৌজদারহাট উপকুলে পড়ে থাকে। ১৯৭৪ সালে কর্ণফুলি মেটাল ওয়ার্কস লিঃ উক্ত জাহাজটি স্ক্র্যাপ হিসেবে ক্রয় করে। এভাবে ১৯৮০ এর দশকে বাংলাদেশ শিপ ব্রেকিং কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমান সময়ে এ শিল্পটি লাভজনক শিল্প হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীনে এ শিল্পের কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে আসছে।
বিগত কয়েক বছরের জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় যে ২০১৪ সালে ২২৭টি, ২০১৫ সালে ২২১টি, ২০১৬ সালে ২৫০টি, ২০১৭ সালে ২০৪টি, ২০১৮ সালে ১৯৮টি, ২০১৯ সালে ২৩৭টি, ২০২০ সালে ১৫০টি, ২০২১ সালে ২৭১টি, ২০২২ সালে ১৪৮টি জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ৪টি ইয়ার্ড ClassNK সার্টিফিকেট অর্জন করেছে এবং ইয়ার্ডগুলির গ্রিন ইয়ার্ডে রূপান্তর কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনা এবং বর্তমান ধারা অব্যাহত থাকলে ২০২৪ সালের মধ্যে কমপক্ষে ১০টি ইয়ার্ড ClassNK সার্টিফিকেট অর্জন করতে সক্ষম হবে মর্মে আশা করা যায়। একটি ClassNK সার্টিফিকেট অর্জনকারী ইয়ার্ড একসাথে ২ থেকে ৬টি পর্যন্ত জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণ করতে সক্ষম।
জীবনের শেষ সীমায় পৌছানো (End of Life) জাহাজের নিরাপদ এবং পরিবেশসম্মত উপায়ে পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণের উদ্দেশ্যে Hong Kong International Convention, 2009 (হংকং কনভেনশন) পাশ হয়েছিল। কনভেনশনটির উদ্দেশ্য ছিল জীবনের শেষ সীমায় পৌছানো জাহাজগুলি স্ক্র্যাপ হিসেবে ব্যবহার করা বা ক্ষেত্র বিশেষে পুন:প্রক্রিয়া করার সময় তা যেন কোনভাবেই পরিবেশ, মানব স্বাস্থ্য বা সুরক্ষাকে বিপন্ন না করে তা নিশ্চিত করা। ৬৩টি দেশের উপস্থিতিতে হংকং কনভেনশনটি গৃহীত হয়। বাংলাদেশও আলোচ্য কনভেনশনের স্বাক্ষরকারী দেশ। হংকং কনভেনশন ২০০৯ এর ১৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক কনভেনশনটি নিম্নলিখিত ৩টি শর্ত পূরণের তারিখ হতে ২৪ মাস পরে কার্যকর হবে মর্মে উল্লিখিত :
(১) কমপক্ষে ১৫টি দেশ বা তার বেশি এটি অনুসমর্থন (ratification) করেছে;
(২) অনুসমর্থনকারী (ratification) দেশগুলির বণিক জাহাজের মালিকানা বিশ্বের বণিক শিপিং এর মোট গ্রস টনেজের কমপক্ষে ৪০% হতে হবে; এবং
(৩) পূর্ববর্তী ১০ বছরে অনুসমর্থনকৃত (ratification) দেশগুলির সম্মিলিত সর্বোচ্চ বার্ষিক জাহাজ পুন:প্রক্রিয়াজাতকরণের পরিমাণ, রাষ্ট্রগুলির মোট বণিক জাহাজের ওজনের কমপক্ষে ৩% হতে হবে।
গত ১২ জুন ২০২৩ তারিখে বাংলাদেশ কর্তৃক হংকং কনভেনশন অনুসমর্থন করা হয়েছে। সে হিসেবে ২০২৫ সালের মধ্যে TSDF সকল ইয়ার্ডসমূহ HKC Compliant না হলে শীপ রিসাইক্লিং এর জন্য নতুন করে কোনো জাহাজ ভাঙ্গার অনুমোদন শিল্প মন্ত্রণালয় হতে পাওয়া যাবে না। বর্তমানে পরিবেশসম্মত ভাবে জাহাজ পুনঃপ্রক্রিয়াকরণের জন্য জাপান সরকারের অর্থায়নে জাইকা Treatment Storage and Disposal Facility (TSDF) স্থাপনের লক্ষ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। আলোচ্য SENSREC Phase III উক্ত TSDF পরিচালনার লক্ষ্যে সরকারি কর্মকর্তা/ইয়ার্ড ম্যানেজারসহ সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণ প্রদানসহ TSDF পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত গাইডলাইন বা নীতিমালা প্রণয়নে সার্বিক বিষয়ে কারিগরি সহায়তা প্রদান করবে।