সোমবার, ২৩শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

পারমাণবিক অস্ত্র: সভ্যতার রক্ষাকবচ না ধ্বংসের বারুদ?

পারমাণবিক-অস্ত্র-সভ্যতার-রক্ষাকবচ-না-ধ্বংসের-বারুদ-potheprantore-nasrinsultan-news-1-scaled.jpg

“আমি জানি না তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কোন অস্ত্র দিয়ে হবে, তবে চতুর্থটি নিশ্চিতভাবে পাথর ও লাঠি দিয়ে হবে।”
— আলবার্ট আইনস্টাইন

আধুনিক বিজ্ঞান সভ্যতাকে অনেক দিয়েছে, কিন্তু কিছু কিছু আবিষ্কার মানবতার জন্য আশীর্বাদ না হয়ে বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে। পারমাণবিক অস্ত্র তারই একটি দৃষ্টান্ত। পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় অস্ত্র এটি। এটি শুধু একটি দেশের প্রতিরক্ষা নয়, সমগ্র মানবজাতির অস্তিত্বকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।

পারমাণবিক অস্ত্র কী এবং কিভাবে কাজ করে?

পারমাণবিক অস্ত্র এমন একটি বিস্ফোরক যন্ত্র, যা পারমাণবিক বিভাজন (fission) বা একীভবন (fusion) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিপুল শক্তি উৎপাদন করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি মাত্র পারমাণবিক বোমার শক্তি কয়েক হাজার টন TNT বিস্ফোরকের সমান হতে পারে। একটি ২০ কিলোটন শক্তির বোমা এক নিমিষে পুরো শহর ধ্বংস করতে পারে।

১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ‘লিটল বয়’ ও ‘ফ্যাট ম্যান’ নামক দুটি পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। এতে প্রায় ২,১৪,০০০ মানুষ সরাসরি ও পরবর্তীতে মারা যায়। বহু মানুষ আজও সেই তেজস্ক্রিয়তার ফলে ক্যানসার ও জিনগত রোগে আক্রান্ত।

এই অস্ত্রের ব্যবহার কীভাবে হয় এবং এর প্রভাব কী?

পারমাণবিক অস্ত্র সাধারণত ক্ষেপণাস্ত্র, বোমারু বিমান বা সাবমেরিনের মাধ্যমে নিক্ষেপ করা হয়। বিস্ফোরণের সময় ৩০ লক্ষ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপমাত্রা সৃষ্টি হতে পারে। এর ফলে তাৎক্ষণিক মৃত্যু ছাড়াও দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে, যার প্রভাবে কৃষি, প্রাণিকুল, শিশু জন্ম, এমনকি আবহাওয়াও প্রভাবিত হয়।

উদাহরণস্বরূপ, হিরোশিমার বিস্ফোরণে প্রায় ৭০% ভবন ধ্বংস হয়ে যায়। আজও সেখানে জন্ম নিচ্ছে বিকলাঙ্গ শিশু, দেখা যায় ত্বকের ক্যানসার ও মানসিক সমস্যার হার বৃদ্ধি।

বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো কারা?

বর্তমানে বিশ্বের ৯টি দেশ পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী বলে জানা যায়। সেগুলো হলো:
রাশিয়া (৫,৮৮৯ টি), যুক্তরাষ্ট্র (৫,২২৪ টি), চীন (৪১০ টি), ফ্রান্স (২৯০ টি), যুক্তরাজ্য (২২৫ টি), পাকিস্তান (১৭০ টি), ভারত (১৬৪), ইসরায়েল (৯০ টি, অনানুষ্ঠানিক), উত্তর কোরিয়া (আনুমানিক ৩০–৫০ টি)।
(সূত্র: SIPRI Yearbook 2024)

এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায়, মাত্র কয়েকটি দেশের হাতে রয়েছে এমন এক অস্ত্র, যা গোটা পৃথিবীকে ধ্বংস করে দিতে পারে একাধিকবার। বিজ্ঞানীরা একে বলেন “Overkill Capacity”।

কেন এই অস্ত্র এখনো সংরক্ষিত?

বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো এই অস্ত্রকে প্রতিরক্ষার শেষ ভরসা হিসেবে দেখে। একে বলা হয় “নির্বৃত্ত প্রতিরোধ” বা Mutually Assured Destruction (MAD) অর্থাৎ, এক দেশ যদি পারমাণবিক হামলা চালায়, অপর দেশও পাল্টা হামলায় পুরো জাতিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে। এই ভয় একদিকে যুদ্ধ প্রতিরোধ করে, আবার অন্যদিকে তৈরি করে এক অদৃশ্য আতঙ্ক।

আন্তর্জাতিক চুক্তি ও নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা:

পারমাণবিক অস্ত্র নিয়ন্ত্রণে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক চুক্তি রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো:

1. NPT (Non-Proliferation Treaty) – ১৯৬৮ সালে চালু। বর্তমানে ১৯১টি দেশ এতে স্বাক্ষর করেছে।
2. CTBT (Comprehensive Test Ban Treaty) – ১৯৯৬ সালে গৃহীত, এখনো কার্যকর হয়নি।
3. START ও New START – যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে অস্ত্র হ্রাসের চুক্তি।

এই চুক্তিগুলোর উদ্দেশ্য হলো অস্ত্রের সংখ্যা কমানো, নতুন অস্ত্র তৈরি বন্ধ করা এবং পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার নিশ্চিত করা।

ভবিষ্যৎ হুমকি ও আমাদের করণীয়:

বর্তমানে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা ও চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা আবারও পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস বলেছেন,
“Humanity is just one misunderstanding away from nuclear annihilation.”
(“মানবজাতি এখন শুধু একটিমাত্র ভুল বোঝাবুঝির দূরত্বে পারমাণবিক ধ্বংসের কাছাকাছি রয়েছে।”)

আমাদের উচিত বিশ্বব্যাপী নিরস্ত্রীকরণ চর্চাকে সমর্থন করা এবং শিক্ষা, সচেতনতা ও কূটনৈতিক আলাপের মাধ্যমে পরমাণু যুদ্ধের বিপদ তুলে ধরা। গণমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সামাজিক নেতাদের এগিয়ে আসা জরুরি।

পরিশেষে বলা যায় যে, পারমাণবিক অস্ত্র আধুনিক বিজ্ঞান ও সামরিক প্রযুক্তির এক ভয়াবহ রূপ। এটি যেমন একদেশকে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শনের সুযোগ দেয়, তেমনি গোটা মানবজাতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেয়। তাই এটি রক্ষা নয়, বরং নিয়ন্ত্রণ ও নিরস্ত্রীকরণের পথে হাঁটা আজ সময়ের দাবি।

একটি মাত্র পারমাণবিক যুদ্ধ গোটা মানবসভ্যতার শেষ যুদ্ধ হয়ে যেতে পারে। সেই আশঙ্কা দূর করতে হলে আমাদের দরকার শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আস্থা ও পারস্পরিক বোঝাপড়া। না হলে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে ইতিহাসের জন্য আমাদের ক্ষমা করবে না।

সংবাদটি শেয়ার করুন

Leave a Reply

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ