মীর রফিকুল ইসলাম
‘এই সব শ্রান্ত শুষ্ক ভগ্ন বুকে
ধ্বনিয়া তুলিতে হবে আশা; ডাকিয়া বলিতে হবে-
মুহূর্ত তুলিয়া শির একত্র দাঁড়াও দেখি সবে;
যার ভয়ে তুমি ভীত সে অন্যায় ভীরু তোমা চেয়ে,
যখনি জাগিবে তুমি সে পালাইবে ধেয়ে।
যখনি দাঁড়াবে তুমি সমুখে তাহার তখনি সে
পথকুক্কুরের মতো সংকোচে সত্রাসে যাবে মিশে।’
কবি গুরুর এই অমর উপলব্ধিকে জীবনের মহামন্ত্র রূপে গ্রহণ করিয়া জীবনের জয়ধ্বনি গাহিয়াছিলেন একজন নেতা। তিনি ব্যথিত, নিপিড়িত, ভাগ্যাহত মানুষের বুকে আশা জাগাইয়া তুলিয়াছিলেন। তিনি তাহার জনতাকে ডাকিয়া বলিয়াছিলেন- ‘মুহূর্ত তুলিয়া শির …।’ (এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার …)। বলিয়াছিলেন- ‘যখনি দাঁড়াবে তুমি …।’ (তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা…)।
তাহার জনতা তাহাকে প্রাণাধিক ভালোবাসিতেন। মূলত: তিনি ছিলেন জনতার হৃদয় রাজ্যের একচ্ছত্র রাজা। এই রাজা তাহার জনতাকে সংঘবদ্ধ করিয়া শোষকদের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন অপ্রতিরোধ্য তেজদ্বিপ্ত সাহসিকতায়। পথকুক্কুরের মতই তিনি ঐ ভীরুদের তাড়াইয়া দিয়া নিজ রাজ্য ছিনাইয়া আনিয়াছিলেন। এই রাজা তাহার জনতাকে খুবই ভালোবাসিতেন। এতই ভালোবাসিতেন যে, জনতা তাহাকে হৃদয়ের রাজআসন যেমন অর্পন করিয়াছিলেন, একইভাবে পরম নির্ভরতার আধার পিতার আসনেও তাহাকেই আসিন করিয়াছিল। তাহারা মনে করিত তিনি শুধু রাজাই নহেন, তিনি রাজ পিতা। তাই জনতা তাহাকে তাহাদের জাতির পিতা বলিয়া মান্য করিত।
একদা পিতা কহিলেন, হে ভক্ত সকল, কৃষক-শ্রমিক ভ্রাত:গণ, তোমরা ক্ষেতে ফসল ফলাইয়া, কারখানায় পণ্য উৎপাদন করিয়া দেশের চাকা সচল রাখিতেছ। তোমরাই জাতির প্রাণ। আমি তোমাদের জন্যই একটি রাজনৈতিক দল করিব। সত্যিকার অর্থে তোমরাই হইবে রাজ্যের মালিক। তোমাদের প্রত্যেকেরই আবাস থাকিবে, কেহই গৃহহীন থাকিবেনা। সবারই কাজ থাকিবে, চাকুরী শেষে পেনশন পাইবে, কৃষকগণ বৃদ্ধ বয়সে ঘরে বসিয়াই ভাতা পাইবে।
ভক্তজনতা পিতার কথা বিশ্বাস করিলো। কারণ তাহারা জানিত, পিতা কখনো তাহাদের অমঙ্গল চিন্তা করিতে পারেন না। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল। কিন্তু ভিতরে ভিতরে রাজ্যের লুটেরা পুঁজি আগ্রাসী ভূস্বামীগণ এবং তাহাদের বৈদেশিক মদদ দাতা প্রভুগণ প্রমাদ গুনিলেন- হায়: যদি সত্যিকার প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পাইয়া যায়, তবে তো আর জনতার সম্পদ লুটিয়া বিত্তের পাহাড় গড়িবার সুযোগ থাকিলোনা। জনতার অধিকার সচেতনতা সৃষ্টি বড়ই বিপদজনক। তাহারা গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হইল। আন্ত:রাষ্ট্রীয় ও বহি: রাষ্ট্রীয় কুচক্রি ঘাতক মহল পিতার প্রতিজ্ঞা প্রতিহত করিতে মরিয়া হইয়া উঠিল। তাহাদের ষড়যন্ত্রের কথা পিতার কর্ণগোচর হইলেও তিনি হাসিয়া বলিলেন, তোমরা উদ্বিগ্ন হইওনা। আমার মানুষেরা আমার ক্ষতি করিতে পারেনা। পিতা বুঝিতে চাহিলেন না যে, মানুষের উপর যখন লোভ ভর করে তখন আর সে মানুষ থাকে না, সে তখন ক্ষমতা লোভী বা অর্থ লোভী নরপিশাচ। এই নরপিশাচরা সবকিছুই করিতে পারে। যে কারো রক্তে হস্ত রঞ্জিত করিতে তাহাদের এতটুকু বাঁধে না। যাহা হইবার তাহাই হইল।
এক পারিবারিক উৎসবমুখর রাত্রিতে পারিবারের অন্যান্য সদস্যসহ তারা পিতাকে হত্যা করিল। পরিবারের ছোট্ট শিশুটিকেও তাহারা বাঁচিতে দিল না। পিতার রক্তাক্ত নিথর দেহ প্রাসাদের সিঁড়িতে পরিয়া থাকিল। নিস্তব্দ স্থানু প্রভাত যেন! ভোরের কাকদের আর্ত চিৎকারেও যেন সম্বিত ফিরিছে না কারো। হন্তারকদের মনে হইল, এইভাবে বিভৎসরূপে পিতার মরদেহ পরিয়া থাকিবার দৃশ্য জনরোষ সৃষ্টি করিতে পারে। তাই তাহারা তরিঘড়ি করিয়া দূর গ্রামে পিতার পিতৃভূমিতে নিয়া গিয়া তাহার লাশ দাফন করিল। দৈব ক্রমে বাঁচিয়া গিয়াছিল দুই রাজকন্যা। বিভূঁইয়ে থাকিয়াই তাহারা তাহাদের সব হারাইবার সংবাদ জানিতে পারিল। বুক ফাটা ক্রন্দনে আকাশ বাতাস ভারী হইয়া উঠিল। পিতৃ মাতৃহীন রাজকন্যারা বিদেশেও নিরাপদ নয়, এ বিষয়টি রাজকন্যারা নিজেরা যতখানি অনুভব করিলেন তারও অধিক অনুভব করিলেন পিতার সুহৃদ প্রতিবেশি রাজ্যের রাজা। তিনি রাজ কন্যাদের তাহার রাজ্যে ডাকিয়া নিলেন। সেথায় নিরাপদে তাহারা সময় কাটাইতে লাগিলেন কিন্তু সমস্ত হৃদয় জুড়িয়া এক সমুদ্র বেদনার ঢেউ। সেই ঢেউ প্রশমিত হইবার নহে কোন ক্রমেই।
এই দিকে দিন যায় মাস যায়, বছরের পর বছর যায়। পিতাকে হারাইয়া জাতি অভিভাবকহীন হইয়া পরিয়াছে। তাহাদের জীবনে ঘোর অমানিশা নামিয়া আসিয়াছে। মানুষের দুর্বিসহ জীবনের অবসান ঘটাইয়া রাজ্যে পুনরায় শান্তি ফিরাইয়া আনিবার জন্য নিগৃহীত ব্যথিত জনতা রাজ্যে ফিরিয়া আসিয়া পিতার আসন গ্রহণ করিবার জন্য রাজকন্যার প্রতি জোড় মিনতি জানাইল। পিতার মতই সিংহ হৃদয় জনবৎসল রাজকন্যা শুভক্ষণ গনিয়া নিজভূমে অগ্রসর হইলেন। লক্ষ জনতার প্রসারিত হস্তের সমর্থন ও ভালবাসায় মুগ্ধ রাজকন্যা পিতৃগৃহে আরোহন করিয়া মর্মবেদনায় বিমূঢ় হইয়া পরিলেন- চারিধার শূন্য খা খা করিতেছে কেউ নেই! বুকের ব্যথা পাশান চাপা দিয়া ধাতস্ত হইলেন। ভাবিলেন, যাহারা গিয়াছেন, জনতার ভালবাসার অন্তরে তাহারা বাঁচিয়া আছেন। এই জনতার মধ্য হইতেই আমি আমার পিতা-মাতা, ভাই, ভ্রাত্রি বঁধু সকলকে খুঁজিয়া লইব। প্রিয় জনতাকে সংগী করিয়া, তাহাদের ন্যায্য অধিকার ফিরাইয়া দিবার উদ্দেশ্যে মাঠে নামিলেন। প্রবল বিরুদ্ধ শক্তির প্রতিকুলে দীর্ঘ একুশ বছরের মরন পন লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়া মসনদ পূনরুদ্ধার করিলেন। রাজ্য পরিচহালনার পাঁচ বছরের মেয়াদ কালিন সময়ে রাজ্যে শান্তি পূন:প্রতিষ্ঠা করিলেন। পিতৃহত্যার সুবিচার নিশ্চিত করিলেন, নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য পন্য, কৃষি পন্যের ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করিলেন। প্রযুক্তি ও গবেষণা নির্ভর কৃষি উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা প্রবর্তন করিয়া বহুযুগীয় অভিশাপ-উত্তরাঞ্চলীয় মঙ্গা দূর করিলেন। উত্তরাঞ্চলীয় জনতা অভাব বিস্মৃত হইল। অস্ত্রধারী উশৃঙ্খল পাহাড়ী জনতাকে শান্তির বানী শুনাইলেন, মন্ত্র চালিতের মত তাহারা রাজ কন্যার নির্দেশনা অনুসরন করিল। তাহারা রাজ কন্যার চরনে অস্ত্র সমর্পন করিয়া ভালবাসা ও শান্তি স্থাপন চুক্তিতে আবদ্ধ হইল। পাহাড়ে রক্তের হোলি খেলা বন্ধ হইল। অপর দিকে বহুপূর্বে পিতার অংশ গ্রহণ ও উদ্বুদ্ধায়নে যে মাতৃভাষা আন্দোলন সংগঠিত হইয়াছিল, সেই দিবসটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করিল।
সব মিলাইয়া জাতিয় ও আন্তর্জাতিকভাবে সুবিবেচ্য একটি সুখী রাজ্যের রূপ লাভ করিল রাজকন্যার স্বপ্ন কানন। জাতি প্রথম বারের মত প্রত্যক্ষ করিল খাদ্য উদবৃত্তের মত প্রাচুর্য পূর্ণ গৌরব জনক বাস্তবতা। পিতা হন্তারকদের প্রেতাত্মা সেই খলনায়করা বসিয়া থাকিল না। রাজকন্যার সাহসিকতা ও উত্থানে ভিত হইয়া ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে তাহারা রাজকন্যার বিশ্বস্ত রাজন্যবর্গকে হত্যা যজ্ঞে মাতিয়া উঠিল এবং বেশ কিছু রাজন্য ব্যক্তিত্বকে হত্যা করিয়া রাজকন্যাকে অস্থিতিশীল অবস্থার মধ্যে ফেলিবার সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখিল। দেশী ও বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীরা তাদের নিপূণ ষড়যন্ত্র চরিতার্থ করনে সফল হইল, তাহারা রাজ্য পরিচালনার পরবর্তী মেয়াদে রাজকন্যার অভিষেক প্রতিহত করিতে সমর্থ হইল।
রাজ্য পরিচালনার অধিকার কারিয়া লইতে পারিলেও জনতার হৃদয় রাজ্যে রাজকন্যার জন্য ভালবাসার যে রাজ সিংহাসন পাতা রহিয়াছে সেইখানে তাহারা কোন অনুশাসন আরোপ করিতে পারিল না। আপামর জনতা ক্রমাগত রাজ কন্যাকে যাঞ্চা করিতে থাকিল। অন্ধকারের সেই রক্ত পিপাসু দানবরা ভয় পাইয়া গেল। তাহারা পিতার মতই রাজকন্যাকে সমুলে বিনাশ করিবার উদ্দেশ্যে রাজ কন্যাকে লক্ষ্য করিয়া তাহার জনসভায় গ্রেনেড চার্জ করিল। পিতার জন্য না পারিলেও এইবার জনতা সরাসরি রাজ কন্যার জন্য প্রান বিসর্জন দিল। জনতা রাজকন্যাকে ঘিরিয়া মানব ঢাল রচনা করিয়া নিজে স্পিøন্টার বিদ্ধ হইয়া মৃত্যুবরণ করিল, কিন্তু রাজকন্যার শরীরে একটিও প্লিন্টার বিদ্ধ হইতে দিলনা !
অন্ধকার কবলিত পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্তি লগ্নে পুনরায় রাজকন্যার রাজ্যাভিষেক প্রতিহত করিবার জন্য নানামুখী ষড়যন্ত্র, কালাকানুনের অভিশাপ নামিয়া আসিল। কিন্তু বিপুল জনতার মরনপন, সমর্থন ও আন্দোলনের মুখে অন্ধকার বিদায় নিতে বাধ্য হইল। রাজকন্যা পূণরায় সিংহাসনে আরোহন করিলেন। রাজকন্যা জনতার আত্মত্যাগের কথা বিস্মৃত হইলেন না। তিনি তাহার পিতার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করিবার পদক্ষেপ গ্রহণ করিলেন। অসহায়, বৃদ্ধ, বিধবাদের জন্য ভাতার ব্যবস্থা করিলেন। ভুমিহীনদের সকলের জন্য আশ্রয়ন প্রকল্প গ্রহণ করিলেন। এমন কি মেথরদের জন্যও আধুনিক সুযোগ সুবিধা সম্বলিত আবাসন নির্মান করিয়া দিলেন। দূরতিক্রম্য প্রমত্তা নদীর উপর নিজস্ব অর্থায়নে সেতু নির্মান করিয়া রাজধানীর সাথে রাজ্যের দক্ষিণ অঞ্চলের যোগাযোগ সহজ করিয়া দিলেন। রাজ্যবাসী রাজ কন্যার কর্মযজ্ঞে বিস্মিত ও অভিভূত।
সিংহাসনে আরোহন করিয়াই রাজকন্যা ঘোষণা করিয়া ছিলেন- রাজ্য ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল পদ্ধতি প্রবর্তন করিবেন। সকলের জন্য ইহা ছিল একটি নতুন ধারনা। তাই অধিকাংশেই প্রথমে তাহা ধরিতে/বুঝিতে পারে নাই। তাই ইহা লইয়া অনেকে হাসাহাসি করিতেও কুণ্ঠা বোধ করিল না। কিন্তু রাজযজ্ঞ থামিয়া থাকিবার নয়, ডিজিটালাইজিং কর্মকান্ড আগাইয়া চলিতে থাকিল। দেশের জনতা ক্রমে ক্রমে তাহার সাথে অভ্যস্ত হইয়া উঠিতে থাকিল। জনতা অবাক বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করিল পুরো দুনিয়াটা আজ তাহাদের মুঠোয় পুরিয়া দিলেন রাজকন্যা। আজ তাহার রাজ্যে একজন দিন মজুর এমনকি একজন অন্ধ ভিক্ষুকও তাহার লুঙ্গির কোচর হইতে মোবাইল ফোন বাহির করিয়া ডিজিটাল ফোনে তাহার পরিজনের সংগে সংলাপ বিনিময় করিতেছে।
পরপর তিন মেয়াদে রাজ্য পরিচালনাকারী রাজকন্যার রাজকীয় কর্মনৈপুন্যে বিমুগ্ধ রাজ্যবাসী আজ উন্নত জাতি সত্ত্বার স্বপ্নে আকুল। সকল বাধা উপেক্ষা করিয়া আপন রাজ্যের অভাবনীয় উত্থান সৃজনে সিদ্ধহস্ত জীবন্ত কিংবদন্তি এই রাজকন্যা আজ সত্যিই বিশ্বের বিস্ময়, জাতির অহংকার।
লেখক – গবেষক