আব্দুর রহমান
বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের লাহোরে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের পক্ষে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষে ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে ‘ছয় দফা দাবি’ পেশ করেন। ৪ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব পাকিস্তানের লাহোরে পৌঁছান এবং তার পরদিন অর্থাৎ ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ছয় দফা দাবি পেশ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পত্র-পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা হিসাবে চিত্রিত করা হয়। ফলে তিনি নিজেই ৬ ফেব্রুয়ারি এর সম্মেলন বর্জন করেন।
ছয় দফা দাবি ঘোষণা করার পর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)- এর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমদ শেখ মুজিবুর রহমানকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘ আপনি এই যে ছয় দফা দিলেন তার মূল কথাটি কি? উত্তরে আঞ্চলিক ভাষায় শেখ মুজিব বলেছিলেন- ‘ আরে মিয়া বুঝলা না, দফা তো একটাই। একটু ঘুরাইয়া কইলাম।’ লাহোরে পেশ করা ছয় দফা বঙ্গবন্ধুর একটু ঘুরিয়ে বলা এক দফাই হলো বাঙালির মুক্তির দফা, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন অর্থাৎ বাংলাদেশের স্বাধীনতার দফা।
লাহোর থেকে ঢাকায় ফিরে পরের মাসেই শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। সাধারণ সম্পাদক হন তাজউদ্দীন আহমদ। ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ছয় দফা প্রস্তাব এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনের কর্মসূচি গৃহীত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দিন আহমদের ভূমিকা সংবলিত ছয় দফা কর্মসূচির একটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। যার নাম ছিল ‘ছয় দফা: আমাদের বাঁচার দাবি’। ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব বিরোধীদলীয় সম্মেলনে ৬ দফা পেশ করেন। এরপর ১৮ মার্চ আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি: ৬-দফা কর্মসূচি’ শীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশ ও প্রচার করা হয়। ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে ছয় দফা উত্থাপন করা হয় লাহোর প্রস্তাবের সাথে মিল রেখে। ছয় দফা দাবির মূল উদ্দেশ্য ছিলো- পাকিস্তান হবে একটা ফেডারেল রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গরাজ্যের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন থাকবে। ছয় দফা কর্মসূচি জনগণের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব এবং তাঁর সহকর্মীরা সারা দেশে মহকুমায় ঘুরে বেড়াতে শুরু করলেন। এই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে সারা দেশে গণজাগরণের সৃষ্টি হলো। দৈনিক ইত্তেফাক এর পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে বড় ধরনের ভূমিকা রাখে। তখন শেখ মুজিব যেখানে যাচ্ছেন সেখানেই তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে। এই কর্মসূচিকে তারা ‘বাঙালির বাঁচার দাবি’ হিসেবে অভিহিত করেন।
ছয় দফার জন্মের পেছনে মূল কারণ ছিল মূলত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামরিক বৈষম্য। তাই ছয় দফা হঠাৎ করেই আসমান থেকে পরেনি। এর প্রস্তুতি ছিল দীর্ঘদিনের। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাব, ‘৪৭ সালের ভারত ভাগ, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, ‘৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের সামরিক শাসন – এসবই ছয় দফার ভীত তৈরি করেছে। পরবর্তীকালে এই ছয় দফা দাবিকে কেন্দ্র করে বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের তথা স্বাধীনতার আন্দোলন জোরদার হয়। বাংলাদেশের জন্য এই আন্দোলন এতোই গুরুত্বপূর্ণ যে আন্দোলনকে ‘ম্যাগনা কার্টা বা ‘বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ’ও বলা হয়। ছয় দফা যে পূর্ব বাংলার প্রাণের দাবি- পশ্চিমা উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীদের দালাল পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকশ্রেণী যে আর পূর্ব বাংলার নির্যাতিত গরীব জনসাধারণকে শোষণ বেশি দিন করতে পারবে না, সে কথা আমি এবার জেলে এসেই বুঝতে পেরেছি। বিশেষ করে ৭ই জুনের যে প্রতিবাদে বাংলার গ্রামে গঞ্জে মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়েছে, কোনো শাসকের চক্ষু রাঙানি তাদের দমাতে পারবে না। পাকিস্তানের মঙ্গলের জন্য শাসকশ্রেণির ছয় দফা মেনে নিয়ে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করা উচিত। যে রক্ত আজ আমার দেশের ভাইদের বুক থেকে বেরিয়ে ঢাকার পিচ ঢালা কালো রাস্তা লাল করল, সে রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ছয় দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। শেখ মুজিবসহ সব রাজবন্দির মুক্তির দাবিতে এই দিন আওয়ামী লীগ সমগ্র পূর্ব-পাকিস্তানে হরতাল ডাকে। হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হক, মুজিবুল হকসহ মোট ১১ জন বাঙালি শহিদ হন। ৬ দফা আন্দোলনের প্রথম শহিদ ছিলেন সিলেটের মনু মিয়া।
শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাই যে সাড়ে পাঁচ কোটি বাঙালির মনের কথা ছিলো, তার চাক্ষুষ প্রমাণ হলো ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বরের নির্বাচন। আওয়ামী লীগে জাতীয় পরিষদে ১৬০টি সাধারণ আসন ও সংরক্ষিত নারী আসন ৭টি, মোট ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক নির্বাচনে ২৮৮টি সাধারণ আসন ও ১০টি সংরক্ষিত নারী আসনসহ মোট ২৯৮টি আসন নিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। ছয় দফা সম্পর্কে বলতে গিয়ে শেখ মুজিব সাহিত্যিক সৈয়দ শামসুল হককে বলেছিলেন: ‘আমার দফা আসলে তিনটা। কতো নেছো (নিয়েছ), কতো দেবা (দিবে), কবে যাবা?’ ১৯৭০ সালে পাকিস্তান সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের রিপোর্ট মতে উন্নয়ন ও রাজস্ব খাতে পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৬০ শতাংশ বেশি ব্যয় করা হয়েছে। ফলে পশ্চিমের মাথা পিছু আয়ও বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তার সাথে রাজনৈতিক বৈষম্যতো ছিলোই। প্রশাসনে বাঙালিদের নিয়োগ দেওয়া হতো না। নেওয়া হতো না সেনাবাহিনীতেও। ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক বৈষম্যও মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে গেল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকগণ মনে করেন, ১৭ দিনের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ছয় দফার আশু পটভূমি তৈরি হয়েছিল। এই যুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তান সামরিক দিক থেকে সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। সে কারণে এই অঞ্চলের রাজনীতিবিদ ও লোকজনের মধ্যে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। শেখ মুজিব বলেছিলেন যে ‘এই যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের বিষয়টি নতুন গুরুত্ব পেয়েছে। আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে’। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় ভারত পূর্ব পাকিস্তানে আক্রমণ না করায় পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘চীনের ভয়ে ভারত পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধে জড়াতে সাহস করেনি।’ জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে যুদ্ধকালীন সময়ে এতিমের মতো ফেলে রাখা হয়েছে। ভারতীয় সৈন্যরা যদি দেশের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত লেফট রাইট করে হেঁটে যেত তবুও তাদেরকে বাধা দেওয়ার মতো অস্ত্র বা লোকবল কিছুই পূর্ব বাংলার ছিল না। আর চীনই যদি আমাদের রক্ষাকর্তা হয় তবে পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে চীনের সঙ্গে গাঁটছাড়া বাঁধলেই হয়। এর পর থেকেই শেখ মুজিবকে বারবার গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখা হয় এবং তাঁর বিরুদ্ধে দায়ের করা হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। তখনই শোনা গেল ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’ এই স্লোগান।
ছয় দফা আন্দোলনের শুরু থেকেই রাজনীতিবিদদের সাথে শিক্ষার্থীরাও যুক্ত ছিলো। নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে কারখানার শ্রমিকরাও এর সাথে শরিক হলো। কিন্তু এর আগে বিভিন্ন আন্দোলনে মূলত শিক্ষার্থীরাই ভূমিকা পালন করেছিল। পরে ‘৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে কৃষকরাও আন্দোলনে যোগ দেয়। কারণ শেখ মুজিব সারা দেশের মানুষকে এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন- পশ্চিম পাকিস্তান আমাদের সম্পদ লুটে নিচ্ছে এবং বাঙালিদের পদে বঞ্চিত করছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তখন সবকিছু তার কাঁধে তুলে নিলেন। মহাজাদুকর ছিলেন তিনি। কথায় জাদু ছিলো তাঁর।১৯৬৬ থেকে ৭০ এই চার বছরে তিনি সবাইকে ছাড়িয়ে গেলেন। ছয় দফা ঘোষণা করে শেখ মুজিব বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পুরোধা হয়ে উঠলেন। ছয় দফা ঘোষণার পাঁচ বছর মধ্যে নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদ এবং দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাংলাদেশের জন্ম হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হন এই রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি।
লেখক- আব্দুর রহমান, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।