সবাই মিলে যদি একটি কাজ করা যায়, তাহলে তা পরিপূর্ণতা পায়- এই ধারণা কিন্তু আজকের নয়, সেই আদিকালের। দশে মিলে করি কাজ হারি জিতি নাহি লাজ, এই লোকরঞ্জক কবিতার পথ থেকে আমরা সরে এসেছি আজ সুপারসনিক ধারণার অ্যারেনাতে। স্মার্ট বাংলাদেশ সেই ধারণারই একটি শ্লোগান। কিন্তু শ্লোগান আর বাস্তব তো আর এক নয়। অভিজ্ঞতাজাত শব্দটি সৃষ্টি হয়েছে পরম্পরা অনুসরণে। তাই সমন্বিত শব্দের ভেতরমহলে বাস করে মানুষের জন্য কল্যাণ ও ন্যায়বোধ। কিন্তু এই কল্যাণধর্ম ও ন্যায়বোধ কি আমাদের সমাজে-সংসারে, আমাদের চলমান রাজনৈতিক সমাজে আছে, অরাজনৈতিক সমাজে কি তার কোনো অবশেষ আছে? ব্যবসায়িক সমাজের মানুষ কি ওই শব্দের মহিমা ভুলে গেছেন? আড়তদার থেকে কাঁচাবাজারের খুচরা দোকানি এবং ভাসমান ঠেলাওয়ালারা ক্রেতা মানুষের প্রতি মিনিমাম সহানুভূতিশীল হতে পারে না? আজ সকালে ভাসমান বিক্রেতারা কাঁচামরিচের দাম রাখল ২৪০ টাকা কেজি। গতকাল সন্ধ্যায় ছিল ১৮০ টাকা কেজি। এখানে সমন্বিত লোভের একটি রাজনৈতিক চরিত্র আমরা খুঁজে পাব, যা সরকার তার অনুমোদন দেবে না।
দুই.
ওই শব্দটি নিয়ে কেন আমি প্রশ্ন তুললাম, রাজনীতিকরা ভাবতে পারেন, আমি তাদের উদ্দেশেই শব্দটিকে তুলে এনেছি। ঠিক ধরেছেন। রাজনীতি ও রাজনীতিকরাই তো দেশ পরিচালনায় জড়িত। সমস্ত ন্যায় ও কল্যাণই তো তাদের রাজনৈতিক ধর্ম। কিন্তু তাদের কথাবার্তায় ওই ন্যায়বোধ ও কল্যাণ কি আছে? জনগণ নয়, তাদের লক্ষ্য এখন প্রতিপক্ষ দলন। দমন ও দলনের রাজনীতি কখনোই জনগণের প্রতি যথার্থ ন্যায় ও জনকল্যাণকর কোনো উপাদান উপকরণ থাকে না, থাকতে পারে না। সেখানে অসুরিক অন্যায় ও শক্তিমত্ততার হুমকিই আমরা দেখতে পাচ্ছি। যেমন সরকারকে পাহারা দেবে আওয়ামী লীগ- এই ঘোষণা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। ওই ঘোষণা কেবল ক্ষমতা রক্ষারই বা দখলীস্বত্ব অটুট রাখার হুমকি নয়, রাজনৈতিক মত্ততার বোধও সেখানে কেন্দ্রীভূত। ফলে হারিয়ে যায় রাজনৈতিক চিন্তার মূল লক্ষ্য। গণতন্ত্র যার ডাকনাম। জনগণের অধিকার সেখানে ভূলুণ্ঠিত।
আমাদের রাজনৈতিক সরকার দাবি করে তারা উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দিয়েছে। কথাটায় তেমন মিথ্যা যে নেই তা দেখেছে ঢাকার ধানমন্ডিসহ গোটা মহানগরের মানুষ। কোমর পানিতে ডুবে গিয়েছিল ওই এলাকা। একরাতের অতিবৃষ্টিই এর জন্য দায়ী। পানি কেন নামতে পারেনি, তা কিন্তু রাজধানীর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত। উন্নয়ন কাজের সঙ্গে যে পানি নিষ্কাশনের সমন্বয় ঘটেনি বা ঘটাতে পারেননি নগর পরিকল্পক ও বাস্তবায়নকারীরা, সেটা কিন্তু একবারও ভেবে দেখেনি উন্নয়নের রশি ধরে থাকা দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রদ্বয়। এবং তাদের প্রজ্ঞাবান কর্মকর্তারাও তা অনুধাবণ করতে পারেননি। কেন পারেননি, সেটা অন্য প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর দিলে তারা ক্ষেপে যাবেন। তাদের প্রাকটিক্যাল অভিজ্ঞতা যেমন শূন্য তেমনি বুকিশজ্ঞানও তারা ভুলে গেছেন নানা কারণে। এই নানা কারণের মধ্যে ঘুষ পারিতোষিক অন্যতম এবং রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তির ফলে অযোগ্যদের কাজ দেয়া।
গোটা টাকাটাই যে জলে গেছে, সেটা না বললেও মহানগরবাসী টের পাচ্ছে। কিন্তু ক্ষমতায় বসে থাকা লোকজন দাবি করছেন তারা তো নৌকা ভাসানোর জন্যই উন্নয়ন করেছেন। সে ক্ষেত্রে তারা তো বিজয়ী! নয় কি?
তিন.
উন্নয়ন কেবল অবকাঠামোর মধ্যে মাথা গুঁজে থাকে না। সে তো আর উট পাখি নয় যে বালি না পেয়ে কংক্রিটে মাথা ঢুকিয়ে বসে থাকবে। উন্নয়ন একটি সমন্বিত ধারণা। উন্নয়নের সঙ্গে কেবল ফ্লাইওভার, পাতাল বা এলিভেটেড রেল, যাকে মেট্রোরেল বলছি আমরা, কেবল এলিভেটেড সড়ক বিআরটি নয়, এর সঙ্গে জড়িত জাতির প্রত্যাশার অনুপুঙ্খ বিষয় বা চাহিদা। যেমন খাদ্যনিরাপত্তা, যেমন পুষ্টির নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জরুরি বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন শিক্ষার সমন্বিত পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। জাতির সবাইকে একসঙ্গে ধারাবাহিকভাবে উন্নতি করতে না পারলে দেশের ও মানুষের উন্নয়ন ঘটে না। আমাদের দেশে তিন ধরনের শিক্ষা চালু আছে। ফলে আমাদের শিক্ষা চেতনার মৌলিকতা ত্রিধারায় বইছে। আর এক ধারার ছেলেমেয়েরা অন্যধারার শিক্ষার্থীকে অবজ্ঞা করে। ইসলামিক শিক্ষার নামে মাদ্রাসার উন্নয়ন ঘটিয়ে সরকার দেশের চাহিদাকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার সঙ্গে জ্ঞান বিজ্ঞানের সমন্বয় করতে পারছে না। মাদ্রাসাগুলো এমন শিশু-কিশোর সৃষ্টি করছে, যারা চলমান জগতের ভেতরে বসবাস করছে, কিন্তু আবার মন-মানসিকতায় তারা সেখানে বসবাস করছে না। তাদের কথাবার্তা, পোশাক-আশাক ভিন্নতর সংস্কৃতির পরিচয় বয়ে আনছে। আমরা বোরকা ও নিকাব-হিজাবি সত্তায় পরিণত হয়ে চলেছি। অথচ ইসলাম সেটা কখনোই কায়েম করতে চায়নি, চায় না। ইসলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানের এক সমন্বিত মহাসমুদ্র, সেখানে পোশাকের এই রূপ কোনো আত্মিক বিষয় নয়। বরং ওইসব শিশুকে পরিণত করছে পোশাকি ইসলামের ধারক হিসেবে। তৈরি করছে ধর্মান্ধ শিশু-কিশোর। আর এদের শিক্ষার সঙ্গে যতই মূলধারার সমন্বয় করা হোক না কেন, তারা সেই শিক্ষাকে মনেপ্রাণে গ্রহণ করছে না। যারা শিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন, তাদের ব্যক্তিগত চিন্তা ও কর্মধারার আলোকেই তাদের প্রশিক্ষিত করে চলেছেন। এই ত্রিমাত্রার শিক্ষা আমাদের শিক্ষার শক্ত ও পোক্ত শিরদারা গঠনে সাহায্য করছে না। যারা এই তিন ধারার শিক্ষা চালু রেখেছেন, তারা বাংলাদেশি চেতনার সাংস্কৃতিক শক্তিকে তিন ধারায় নির্মাণ করে জাতির আকাক্সক্ষাকে এক অশনির মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। এতে করে আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক ধারার বর্তমান প্রবাহের সঙ্গে সাংঘর্ষিক করে তুলেছি। আবার এর পাশে আছে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুল ও কলেজের শিক্ষা চেতনা। ধনী ও বিত্তবানদের চাহিদাকে পূর্ণ করে তাদের জাতীয় চেতনা থেকেও বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। তারা আন্তর্জাতিক সমাজের অনুকারী, ধারক।
আমাদের সমাজে আমাদের রাজনৈতিক সরকারের পরিকল্পনায় কি প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে কেন্দ্রের বা নগরে মহানগরে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে শিক্ষা, খাদ্য, পুষ্টির বণ্টন সমন্বিতভাবে আছে? ঢাকা মহানগরের প্রান্তিক মানুষের খাদ্যগ্রহণ আর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানীর মানুষের পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণের মধ্যে কি মিল আছে? না, নেই। কিন্তু থাকার কথা। খাদ্য ও পুষ্টিকর খাদ্য বিতরণের মধ্যে যে গ্যাপ বা ফারাক, তা নিয়ে কি আমরা কখনো ভেবেছি? না ভাবিনি। কারণ আমাদের রাজনৈতিক সরকারের চিন্তায় কেবল তারা ভোটের উপাদান বা উপকরণ মাত্র, এর বাইরে তারা কম দামে ওএমএসের (ওপেন মার্কেট সেল) মাধ্যমে প্রান্তিক বা গরিব মানুষদের বাঁচিয়ে রাখার আয়োজন করছেন। এটা সরকারের লোকজন গলার রগ ফুলিয়ে সিনা উঁচু করে বলেন। কিন্তু এটা তারা ভেবেও দেখেন না যে ওইসব গরিবের জন্য পুষ্টির সরবরাহ যথার্থভাবে আছে কি না। না নেই এবং ঢাকার বাইরের জেলাগুলোর অবস্থা আরো খারাপ। সেই খারাপের একটি রিপোর্ট পড়লাম ভোরের কাগজে।
দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও পুষ্টির স্তর উন্নয়ন প্রত্যাশিত মাত্রায় হয়নি। ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রামের ২০২৩ সালের সিকিউরিটি মনিটরিং অনুযায়ী বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার ৩৬ শতাংশ মানুষ খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। দারিদ্র্য ও অপুষ্টি এখনো হাত ধরাধরি করে চলছে। নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী কক্সবাজার অঞ্চলে অপুষ্টির হার অত্যন্ত বেশি, যেখানে ২৯ শতাংশ শিশু কম ওজনসম্পন্ন এবং ৩৫ শতাংশ শিশুই খর্বাকৃতিতে ভুগে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে অপুষ্টি দূর করে জনসাধারণকে সচেতন করার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। গত ২৭ সেপ্টেম্বরে কক্সবাজারের একটি হোটেলে আয়োজিত এক প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে বক্তারা উল্লিখিত মত তুলে ধরেন। নিউট্রিশন ইন্টারন্যাশনালের অর্থায়নে, ব্র্যাক স্বাস্থ্য কর্মসূচির (বিএইচপি) ‘অ্যাডোপ্টিং এ মাল্টিসেক্টরাল অ্যাপ্রোচ ফর নিউট্রিশন’ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। পুষ্টি উন্নয়নে বহুমাত্রিক পদক্ষেপের অংশ হিসেবে মাঠ পর্যায়ের কর্মীদের ‘মাল্টিসেক্টরাল মিনিমাম নিউট্রিশন প্যাকেজ’ বাস্তবায়নে করণীয় ঠিক করতে এই প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়।
সবাই জনগণকে সচেতন করার কথাই বলেন। একবারও নিজেদের দিকে, তাদের দায়িত্ব কর্তব্যের কথা বলেন না। বলেন না যে আমরা প্রান্তিক জীবনে ন্যায়সঙ্গত খাদ্য ও পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান উপকরণ সরবরাহ করতে ব্যর্থ হচ্ছি। আর তাই কক্সবাজারের শিশুরা খর্বাকৃতি থেকে যাচ্ছে, তাদের ওজন কম হচ্ছে। খর্বাকৃতি ও ওজন কমের সঙ্গে দারিদ্র্য ও অপুষ্টি জড়িত। দারিদ্র্যের সঙ্গে অপুষ্টি গলাগলি করে থাকে বা থাকবেই। কিন্তু এর দারিদ্র্য যে রাজনৈতিক ব্যর্থতার, সরকারের সামগ্রিক চিন্তারও দায়, তাদের রাজনৈতিক প্রবণতার এক অন্ধকার দিক, সেটা কিন্তু উন্নয়নের নেতারা একবারও বলেন না, স্বীকারও করেন না। রাজধানী মহানগর, বাণিজ্যিক মহানগর ও দেশের বড় বড় মহানগরগুলোকে চাকচিক্যময় করার মানে কিন্তু এটাই প্রমাণ করে যে প্রান্তিক গ্রামের মানুষের প্রতি বঞ্চনা ছুড়ে মারা। তাদের টাকায় উন্নয়নের সব দৃষ্টিবিভ্রম স্থাপনা করার পরও কেন যে এতটা শঙ্কিত আগামী নির্বাচনে তারা জিততে পারবেন তো?
এই রাজনৈতিক শঙ্কার জবাব ওই পুষ্টিহীনতা ও খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার মধ্যেই নিহিত আছে। একবার বুকে হাত দিয়ে বলুক সরকার যে গ্রামের একজন কৃষক ২০০ টাকা দরে কাঁচামরিচ, ৭০-৮০ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ কিনতে পারে কি না। তাদেরই উৎপাদিত ওইসব পণ্য কেন আকাশছোঁয়া দামে বিক্রি হচ্ছে? অথচ ওই কৃষক তার প্রকৃত মূল্যও পায় না। দেশের ব্যবসায়ের মধ্যস্বত্বভোগী দালাল/ফরিয়াগণ, কৃষকের লাভ চুষে নিয়ে পেটুকে পরিণত হয়েছে। আর সরকার তাদেরই তার রাজনৈতিক ছাতার নিচে রেখে জাতির সেবা করে চলেছেন। এর চেয়ে অমানবিক ও লজ্জার আর কী হতে পারে?
অথচ সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় যদি খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ সমন্বিত হতো তাহলে আজকে এই প্রশ্ন উঠত না যে সরকার এক চোখে তেল আর চোখে জল দিয়ে সবকিছু বিবেচনা করছে। জনগণকে এক চোখে দেখতে না পারলে মহানগরেই কেবল সব কাঠামো উন্নয়নের স্থাপনা আমরা দেখি। এই উন্নয়ন ধারায় হাইওয়েগুলোতে ও সার্ভিস ওয়েতেও দেখতে পেতাম। আর মহাসড়কে ওঠা-নামার জন্য অ্যাপ্রোচ সড়কগুলোও হতো আন্তর্জাতিক মানের ও ডিজাইনের। আমাদের উন্নয়নগুলো তাই ঢেউ খেলানো, নদীর জলে হাওয়া বয়ে গেলে যে রকম সুদৃশ্য ঢেউ ওঠে, আমাদের উন্নতিও সেই রকম।
এখন আমাদের দাবি হচ্ছে সরকার তো বহু উন্নয়ন ধারা বইয়ে দিয়েছেন, এখন কৃষির মতো মৌলিক জায়গার উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা গৃহীত হোক। খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে পুষ্টির নিরাপত্তা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। তা হবে একদিকে শিক্ষার, যোগাযোগের, নানারকম পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য উপকরণ উপাদানের সমন্বিত উৎপাদন ও বিতরণ, প্রতিটি শিশু যাতে সমানভাবে পুষ্টির ছায়ায় আসে সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরি।
এই অতীব জরুরি বিষয়টি কি সরকারের রাজনৈতিক কানে পৌঁছবে?
ড. মাহবুব হাসান : সাংবাদিক ও কলাম লেখক।
mahboobh868@gmail.com