আবদুল মান্নান :
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস নাগাদ এটি পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল পাকিস্তান তাদের চিরশত্রু ভারতকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সমর্থন ও তাদের দেশে এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য ‘সমুচিত শিক্ষা’ দিতে চায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে গণহত্যা শুরু করলে বাঙালি ছাত্র, কৃষক, সাধারণ মানুষ, সেনাবাহিনী, পুলিশ ও ইপিআরের বাঙালি সদস্যরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেন। তবে একই সঙ্গে লাখ লাখ মানুষ নিজেদের বাড়ি-ভিটা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। সেই সময় ভারতের অর্থনীতি বর্তমান সময়ের মতো এত মজবুত ছিল না। তারপরও সেই দেশের, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ও আসামের মানুষ নিরাশ্রয় বাঙালিকে আশ্রয় দিতে কার্পণ্য করেনি। এক অভাবনীয় কূটনৈতিক তৎপরতার মাধ্যমে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ববিবেক ও সহানুভূতি জাগ্রত করতে পেরেছিলেন। সক্ষম হয়েছিলেন বাঙালিদের এই দুঃসময়ে কেন ভারত ও তার জনগণ আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তা তুলে ধরতে। বিশ্বের পাঁচটি পরাশক্তির মধ্যে একমাত্র যুক্তরাষ্ট্র ও চীন পাকিস্তানের পক্ষে ছিল। আর ছিল আরব দেশগুলোর পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন। ব্যতিক্রম ছিল একমাত্র ইরাক। ইরান পাকিস্তানের বন্ধুরাষ্ট্র হলেও সরাসরি পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন থেকে বিরত থাকে। পাকিস্তানের সুশীল সমাজ বাংলাদেশে কী ঘটছে সে সম্পর্কে হয়তো তেমন একটি জানার প্রয়োজন মনে করত না অথবা জেনেও ইয়াহিয়া খান ও তাঁর সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডকে সমর্থন করেছে। পাকিস্তানের সাধারণ জনগণ দেশটির জন্মলগ্ন থেকেই সেনাবাহিনীর প্রতি তাদের অন্ধ সমর্থন জোগাতে কখনও কার্পণ্য করেনি। তবে কিছু ব্যতিক্রম যে ছিল না, তা কিন্তু নয়।
১৯৭১ সালের মে মাসে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের সিনিয়র আমলা হাসান জহিরকে ঢাকায় একজন সচিব হিসেবে বদলি করা হয়। তিনি ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-ভারত মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করা পর্যন্ত বাংলাদেশে একজন সচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন। একজন যুদ্ধবন্দি হিসেবে পরে তাঁকে ভারতে নিয়ে যাওয়া হয়। সিমলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর ১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে হাসান জহির মুক্ত হয়ে পাকিস্তানে ফেরত যান। তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে ১৯৯০ সালে অবসরগ্রহণ করে ‘দি সেপারেশন অব ইস্ট পাকিস্তান’ নামক একটি গ্রন্থে ঢাকায় অবস্থানকালে তাঁর অভিজ্ঞতা ও সে সময়ের পাকিস্তানের রাজনীতির কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনা করেন; যদিও তাঁর বইটিতে একজন পাকিস্তানি আমলা হিসেবে একাত্তর সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন ঘটেছে। তথাপি তিনি চেষ্টা করেছেন কিছু বিষয়ে নির্মোহ থাকতে। হেনরি কিসিঞ্জার মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি নিক্সনের পররাষ্ট্র সচিবের (মন্ত্রী) দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও অবসর নেওয়ার পর ‘হোয়াইট ইয়ার্স’ নামক একটি প্রামাণ্য গ্রন্থে একাত্তরে নিক্সন প্রশাসনের ভূমিকা, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর দেশে দেশে দূতিয়ালি, প্রবাসী সরকারের বিরুদ্ধে খন্দকার মোশতাক ও তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তাজউদ্দীন সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র সম্পর্কে বর্ণনা পাওয়া যায়।
কিসিঞ্জার লিখেছেন, নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে খুবই অপছন্দ করতেন এবং তা তিনি প্রকাশ করতে দ্বিধা করতেন না। ১৯৭১ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর নিক্সনের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর দুই দফা বৈঠক হয়। কিসিঞ্জার এই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে অস্বীকার করেন। ৫ নভেম্বরের বৈঠকের আগে সব ধরনের রাষ্ট্রাচার ভঙ্গ করে নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে ৪৫ মিনিট বৈঠক কক্ষে বসিয়ে রাখেন। ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় নিক্সন ইন্দিরা গান্ধীকে যে অপছন্দ করেন, তা প্রকাশ করতে তিনি কখনও পিছপা হতেন না। ইন্দিরা গান্ধীর এই সফর ছিল বাংলাদেশ সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানে মার্কিন ভূমিকার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে নিক্সনের সঙ্গে আলোচনা করা। কিসিঞ্জার তাঁর গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ইন্দিরা গান্ধীর ওয়াশিংটন সফরের ঠিক প্রাক্কালে ইয়াহিয়া খান নিক্সনের কাছে এক পত্র মারফত জানিয়েছিলেন, তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সেনা প্রত্যাহারের জন্য প্রস্তুত। ইয়াহিয়া হয়তো এটা উপলব্ধি করেছিলেন, মুক্তিবাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেশি দিন টিকে থাকা সম্ভব হবে না। কিসিঞ্জার আরও উল্লেখ করেছেন, পিপলস পার্টির জুলফিকার আলী ভুট্টো, যিনি বাংলাদেশে সংকট সৃষ্টির পেছনে একজন বড়মাপের হোতা ছিলেন, তিনি ৩ নভেম্বর পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানান, শেখ মুজিব ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা না করে এই সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। ইন্দিরা গান্ধী সম্পর্কে কিসিঞ্জারের মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘তিনি অত্যন্ত কঠোর ব্যক্তিত্বের মহিলা ছিলেন এবং দেশের স্বার্থে সবসময় শক্ত অবস্থান নিতে দ্বিধা করতেন না আর কখনও কখনও তিনি একরোখা আচরণ করতেন।’ নিক্সনের সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর আলোচনা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয় বলে কিসিঞ্জার মন্তব্য করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ৯ আগস্ট ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন একটি মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর করে, যা নিক্সনকে ইন্দিরা গান্ধীর প্রতি আরও বৈরী মনোভাবাপন্ন করে তোলে। এই চুক্তির ফলে চীনও ভারতের প্রতি বেজায় নাখোশ হয় এবং উভয় দেশ বাংলাদেশের সংকটকালে পাকিস্তানকে সমর্থন করে।
হাসান জহির লিখেছেন, বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের কূটনৈতিক তৎপরতা ছিল খুবই দুর্বল। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইন্দিরা গান্ধীর তুলনায় ইয়াহিয়া খানের উপস্থিতি ছিল খুবই দুর্বল ও নিষ্প্রভ। ইয়াহিয়া খানের কাছে মদ আর নারীর সঙ্গ ছাড়া অন্য কিছু তেমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল না। হাসান জহির লিখেছেন, সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর শেষে ইন্দিরা গান্ধী ২৫ অক্টোবর থেকে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো সফর শুরু করেন এবং সেসব দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের এটি বোঝাতে সক্ষম হন যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সংকট সমাধানের একমাত্র পথ। তিনি এও বলেন, ভারত এ সংকট সমাধানের শান্তিপূর্ণ উপায় খুঁজে বের করার পক্ষে এবং ভারত কখনও পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায় না।
পাকিস্তান ইন্দিরা গান্ধীর কূটনৈতিক তৎপরতা দেখে অনেকটা দিশাহারা হয়ে পড়ে এবং উপলব্ধি করে, তারা দ্রুত আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগস্ট মাসে বিদেশে তাদের রাষ্ট্রদূতদের নিয়ে দুটি বৈঠক করে। প্রথম বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় ইরানের রাজধানী তেহরানে ২১ ও ২২ আগস্ট। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ খান ও মেজর জেনারেল ওমর। এই বৈঠকে উত্তর আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন। দ্বিতীয়টি অনুষ্ঠিত হয় সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায়, যেখানে ইউরোপে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা উপস্থিত ছিলেন। হাসান জহির জেনারেল ওমরের উদ্ধৃতি দিয়ে লিখেছেন, “কোনও রাষ্ট্রদূতের কাছেই পরিষ্কার ধারণা ছিল না পাকিস্তানে কী ঘটছে। তখন কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জেনারেল ওমরের ভাষায় বাংলাদেশে সংঘটিত ‘গণহত্যার’ খবর সয়লাব হয়ে গেছে; কিন্তু এসব ব্যাপারে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতদের করণীয় সম্পর্কে তাঁদের কাছে কোনও ধারণাই ছিল না।” এ সময় পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলেন ঝানু কূটনীতিবিদ রোয়েদাদ খান। হাসান জহির তাঁকে উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, ‘আমরা উপস্থিত রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বাঙালিদের পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করে স্বাধীন দেশ স্থাপনের পরিকল্পনার কথা বলার চেষ্টা করেছি। এও বলেছি, তাদের এই পরিকল্পনা কীভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নস্যাৎ করে দেয়। তাদের অভয় দিয়ে বলেছি, বেশিরভাগ বাঙালি আমাদের সঙ্গে আছে। সব কিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণাধীন। পুরো ঘটনা সম্পর্কে আসলাম আজহারের নির্মিত একটি চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। পুরো সময় ধরে রাষ্ট্রদূতরা কোনও কথা বলেননি; কিন্তু সবাই একবাক্যে অনুরোধ করেন এই ছবি আর যেন প্রদর্শিত না হয়।’ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সিনিয়র কূটনীতিবিদ আগা শাহি, যিনি পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘে পাকিস্তানের প্রতিনিধি হয়েছিলেন।
হাসান জহির তাঁর গ্রন্থে আগা শাহিকে উদ্ধৃত করে লিখেছেন, ‘জেনেভায় রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বৈঠকটি ছিল একটি তামাশা।’ আগস্ট মাস নাগাদ পাকিস্তান সরকারের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, একদিকে তারা বাংলাদেশে খুব দ্রুতগতিতে মুক্তিবাহিনীর কাছে এলাকা হাতছাড়া করছে, অন্যদিকে কূটনৈতিক যুদ্ধেও তারা ভারত ও প্রবাসী বাঙালিদের তৎপরতার কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। এই সময় প্রবাসী সরকার নানা ষড়যন্ত্রের মুখোমুখি হলেও ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় তা তারা সফলভাবে মোকাবিলা এবং যথেষ্ট সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা করছিল।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও আরব দেশগুলো (ইরাক ছাড়া) পাকিস্তানকে বাংলাদেশ প্রশ্নে নৈতিক সমর্থন দিলেও অন্য কোনও ধরনের সমর্থন দিতে এগিয়ে আসেনি। এর অন্যতম কারণ সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি। হাসান জহিরের মতে, ‘পাকিস্তানিদের একটি ভ্রান্ত ধারণা ছিল, মুসলমান (পাঞ্জাবি) সেনারা হিন্দু সেনাদের চেয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে অনেক বেশি শক্তিশালী, যদিও আধুনিক যুদ্ধে ধর্ম নয়, পেশাদারিত্ব ও কৌশল যেকোনও সেনাবাহিনীকে বাড়তি সুবিধা দেয়।’
হাসান জহির লিখেছেন, অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, ইয়াহিয়া আর মুজিবের মধ্যে একটি আলোচনার ব্যবস্থা হলে হয়তো পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যেতো। জহিরের মতে, তাঁরা ভুলে গিয়েছিলেন ২৬ মার্চ ইয়াহিয়া খান রেডিও-টিভিতে তার দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের দুশমন আখ্যায়িত করে আওয়ামী লীগকে চিরদিনের জন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। তিনি নিজেই আলোচনার সব দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। ১১ আগস্ট এক সামরিক ট্রাইব্যুনালে বঙ্গবন্ধুর প্রহসনের বিচার শুরু হয়। এক সংক্ষিপ্ত বিচারে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। অক্টোবরের শেষ নাগাদ বাংলাদেশের বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চল মুক্তিবাহিনীর দখলে চলে আসে। ভেঙে পড়তে শুরু করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মনোবল। অন্যদিকে পাকিস্তানের সেনা কর্মকর্তাদের যুদ্ধকৌশল ছিল ভুলে ভরা। তারা মনে করেছিলেন সীমান্ত অঞ্চল সুরক্ষা করলে মুক্তিবাহিনী দেশের ভেতর প্রবেশ করতে পারবে না। তারা ভুলে গিয়েছিলেন এই দেশ মুক্তিযোদ্ধাদের এবং এই দেশের প্রতি ইঞ্চি জমি তাদের পরিচিত।
পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি দেখে ইয়াহিয়া খান ২ ডিসেম্বর নিক্সনের কাছে ১৯৫৯ সালের ৫ মার্চ দুই দেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত একটি সামরিক চুক্তির বরাত দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সামরিক সাহায্য দাবি করেন। নিক্সন বুঝে গিয়েছিলেন ডুবন্ত পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য কোনও কিছুই তার পক্ষে করা সমীচীন হবে না। তার দৃষ্টিতে অখণ্ড পাকিস্তান এখন ইতিহাসের অংশ।
ডুবন্ত মানুষ খড়কুটাকেও ধরে বাঁচতে চায়। ইয়াহিয়া খানের অবস্থাও তখন একটি ডুবন্ত মানুষের মতো। তিনি শেষ ভুলটা করেন ৩ ডিসেম্বর বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের কিছু বিমানঘাঁটিতে হঠাৎ বিমান আক্রমণের সূচনা করে। তিনি মনে করেছিলেন, ভারতীয় বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমানগুলো বিমানঘাঁটিগুলোতে উন্মুক্ত রানওয়েতে থাকবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের এই ধারণা ছিল সম্পূর্ণ ভুল এবং হাসান জহিরের মতে, পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার দক্ষতা ছিল আনাড়ি পর্যায়ের। এই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। তার ব্যক্তিগত সহকারী একটি চিরকুটের মাধ্যমে তাকে বিমান হামলার তথ্য জানালে তিনি বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখে বিমানবাহিনীর একটি বিমানে দিল্লি ফিরে আসেন।
ইন্দিরা গান্ধী দিল্লি ফিরে ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং ভারতের লোকসভায় রাতে এক বিবৃতি দিয়ে দেশের মানুষকে যুদ্ধের কথা জানিয়ে দেন। সেই রাতেই বাংলাদেশে প্রথম বিমান আক্রমণ শুরু করে নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনী; যার নেতৃত্ব দেন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী এয়ার ভাইস মার্শাল সুলতান মাহমুদ বীর-উত্তম (বর্তমানে প্রয়াত)। এর পরপরই বাংলার আকাশ ভারতীয় বিমানবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। বিমান আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশ ও ভারতের সমন্বয়ে নবগঠিত মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী। পাকিস্তানকে বাঁচানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদে ৪ ও ৫ ডিসেম্বর দুটি যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব আনে, যা সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেটোর কারণে বাতিল হয়ে যায়। ডুবন্ত পাকিস্তানকে উদ্ধার করার জন্য তার অন্য কোনও মিত্র এগিয়ে আসেনি। পাকিস্তানিদের ধারণা ছিল, মিত্রবাহিনী প্রতিটি শহর দখল করার জন্য যুদ্ধ করবে। কিন্তু এটি ছিল নিরর্থক। কারণ, এতে শুধু প্রাণহানি হতো। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল দ্রুততম সময়ে ঢাকায় পৌঁছে যাওয়া। ১৫ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী আর মুক্তিবাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে টঙ্গী সেতুতে পৌঁছে যায়। পরদিন সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে ভারতীয় জেনারেল নাগরা বিজয়ীর বেশে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের নিয়ে ঢাকায় প্রবেশ করেন। এর পরপরই আসেন জেনারেল জ্যাকব, যিনি ছিলেন ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার। একসময় জেনারেল নিয়াজির সহপাঠীও ছিলেন। ২০১৪ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে জেনারেল জ্যাকব আমাকে সেই মুহূর্তের অনুভূতি ব্যক্ত করতে গিয়ে বলছিলেন, নিঃসন্দেহে ওই মুহূর্তটা ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ মুহূর্ত। কিন্তু হঠাৎ যখন নিয়াজি কান্নায় ভেঙে পড়েন তখন তাঁর প্রতি আমার কিছুটা হলেও সহানুভূতি হয়েছিল। সেদিন পড়ন্ত বিকালে, ৪টা ২০ মিনিটে রমনা রেসকোর্সে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জেনারেল নিয়াজি ভারতীয় বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে প্রকাশ্যে আত্মসমর্পণ দলিলে যখন স্বাক্ষর করছিলেন তখন ঢাকার চারদিকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত হচ্ছিল। সেই রাতে ভারতের লোকসভা আর রাজ্যসভার এক যৌথ সভায় ইন্দিরা গান্ধী ঘোষণা করেন, ‘ঢাকা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী।’
একাত্তরের সব শহীদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সাবেক চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ।