Search
Close this search box.

আটা, ময়দা, রং মিশিয়ে তৈরি হয় নামিদামি ব্রান্ডের নকল ওষুধ

নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে একটি চক্র

স্টাফ রিপোর্টার:- হুবহু আসল মোড়কে গ্যাস্ট্রিক, এ্যাজমা, ব্রংকাইটিস ও নিউমোনিয়া,  ব্যাথা নিরাময়, কৃমিনাশক, ক্যান্সার, ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগের নকল ওষুধ বাজারে ছাড়ছে একটি চক্র। যা দেখে ভোক্তাদের আসল-নকল পরখ করা অনেকটাই দুঃসাধ্য। অভিযোগ রয়েছে, এ চক্রকে  সহযোগিতা করছে অতি মুনাফালোভী কতিপয় ফার্মেসি মালিকরা।

এমন এক চক্রের ১০ জনকে গ্রেফতার করছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ সময় বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রায় ২০ লক্ষ পিস নকল ওষুধ উদ্ধার করা হয়।

জব্দকৃত ওষুধ
জব্দকৃত ওষুধ

ডিএমপি মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান ডিবি প্রধান হাফিজ আক্তার। তিনি জানান গত ৫ই জুন ডিবি লালবাগ বিভাগের কোতয়ালী জোনাল টিম রাজধানীর মিটর্ফোট হাসপাতাল এলাকা থেকে এ চক্রের একজনকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে তার দেয়া তথ্য মতে কুমিল্লায় অবস্থিত আর্য়ুবেদী ওষুধের কারখানা হিমালয় ল্যাবরেটরীজ ও ঢাকার সাভার এলাকায় অবস্থিত একটি গোডাউন থেকে এসব ওষুধ ও তৈরির সরন্জাম এবং ওষুধের খালি মোড়ক জব্দ করে। এ চক্রের আরো নয়জনকে গ্রেফতার করে ডিবি।

ব্রিফিং
ব্রিফিং

গ্রেফতারকৃতরা হলো- ১। মোঃ কবির হোসেন (৪৪), ২। আইনুল ইসলাম (৩২), ৩। মোঃ মোরশেদ আলম শাওন (৩৫), ৪। আল আমিন চঞ্চল (৩৫), ৫। মোঃ সাগর (১৯), ৬। মোঃ আবির (২১), ৭। মোঃ রুবেল (২৩), ৮। মোঃ নাজিম উদ্দিন (৪২), ৯। মোঃ তৌহিদ (২৮) ও ১০। মোঃ পারভেজ (৩২)।

ডিবি প্রধান আরও জানান, নকল ওষুধ তৈরির চক্রটির মূলহোতা মোঃ কবির হোসেন ও মোরশেদ আলম শাওন নকল ওষুধ তৈরি করে তার অপর সহযোগীদের সহায়তায় বিভিন্ন কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে  দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাজারজাত করে আসছে। তারা দেশীয় ব্যান্ডের যেসকল ওষুধের বাজারে চাহিদা বেশি সেই ওষুধ গুলো আর্য়ুবেদী ওষুধের কারখানায় তৈরি করে । তারা প্যাকেজিং কোম্পানীর অসাধু কর্মচারীদের সহায়তায় আসল মোড়ক সংগ্রহ করে অভিনব পন্থায় নকল ওষুধ বাজারজাত করে।

সংবাদ সম্মেলনে ওষুধ প্রসাশন অধিদপ্তরের পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি আমরা নিয়মিত মনিটরিং এর চেষ্টা করি। আমাদের লোকবল সংকট থাকায় আমরা প্রতন্ত্য অঞ্চল গুলোতে ঠিকমত মনিটরিং করতে পারিনা। তাছাড়া আমাদের নিজস্ব কোন গোয়েন্দা ইউনিট নেই। এই সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে এসকল অসাধু চক্র মানবদেহের জীবন রক্ষাকারী এসব ওষুধ নকল করে বাজারে ছড়িয়ে দিচ্ছে। তিনি বলেন তাদের কাছ থেকে নকল ও ভেজাল ওষুধ কিনে খেয়ে মানুষ সুস্থ হওয়ার বদলে তাদের শরীরে বাসা বাঁধছে নানারকম রোগ।

নকল ওষুধের নমুনা
নকল ওষুধের নমুনা

গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, নকল ওষুধ প্রস্তুতকারক চক্রটি বাজারে কোন ধরনের ওষুধের ব্যবহার বেশি তা আগে রেকি করে জানার চেষ্টা করে। পরে সেগুলো হুবহু তৈরি করে। বাজারজাতের জন্য প্যাকেটের সিকিউরিটি হলোগ্রামও নকল করে তারা।

চক্রটি পরে বিভিন্ন কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি ও নিজেদের কর্মীদের দিয়ে ফার্মেসির মালিকদের সঙ্গে কম দামে সরবরাহের মৌখিক চুক্তি করে। চুক্তি অনুযায়ী নকল ওষুধের চালান ছড়িয়ে পড়ছে গ্রামাঞ্চলের ফার্মেসিগুলোতে।

গ্রেফতার হওয়া এ চক্রের একাধিক সদস্যকে জিজ্ঞাসাবাদ এবং পুলিশের তদন্তে জানা যায়, ওষুধের ধরন ও প্যাকেটজাতের প্রক্রিয়া ছাড়া আসলের সঙ্গে নকল ওষুধের উপাদানগত কোনো মিল নেই। প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিগুলো যেসব নীতিমালা ও প্রক্রিয়া মেনে ওষুধ তৈরি করে, তারা এর কিছুই মানে না। তাদের নেই কোনো কেমিস্ট বা ফার্মাসিস্ট।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নকল ওষুধ সেবনের ফলে হার্ট, কিডনি ও লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। গর্ভবতী মা ও তার সন্তানের মৃত্যুরও কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে এসব ভেজাল ওষুধ। এছাড়া নকল অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার ফলে পরবর্তীতে আসল অ্যান্টিবায়োটিকের কার্যকারিতা মানব শরীরে আর থাকছে না। ফলে ভুক্তভোগীকে দীর্ঘ মেয়াদি স্বাস্থ্য সমস্যায় পড়তে হচ্ছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ সালে ঔষধ আদালতে মামলা হয়েছে ১২টি। ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬টি, মোবাইল কোর্টে হয়েছে ১২৫৮টি মামলা। জরিমানা করা হয়েছে এক কোটি ৮৫ লাখ ৬৫ হাজার ৯০০ টাকা। ২০১৮-১৯ সালে ঔষধ আদালতে মামলা হয় সাতটি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৫৩টি, মোবাইল কোর্টে ২০২১টি। জরিমানা করা হয় ছয় কোটি ৫১ লাখ ২৮ হাজার ৯৩৯ টাকা। ২০১৯-২০ সালে ওষুধ আদালতে মামলা হয় দুটি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৪১টি, মোবাইল কোর্টে ১৯৬৪টি। জরিমানা করা হয় ১১ কোটি ৬৯ লাখ ৯৮ হাজার ৭০৮ টাকা।

২০২০-২১ সালে ওষুধ আদালতে মামলা হয় ১৩টি, ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ৯২টি, মোবাইল কোর্টে ১৭১৫টি। জরিমানা করা হয় সাত কোটি ৫৮ লাখ ১০০ টাকা। এসব অভিযানে মাঠপর্যায়ে নাপা, সেকলো, মোনাস, প্যারাসিটামলের মতো ওষুধ নকল অথবা নকল মোড়কে ভেজাল ওষুধ বিক্রির তথ্য উঠে আসে।

অভিযানে নেতৃত্বদানকারী কর্মকর্তা ডিএমপির গোয়েন্দা লালবাগ বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার রাজীব আল মাসুদ জানিয়েছেন গ্রেফতারকৃতদের বিজ্ঞ আদালতে হাজির করে রিমান্ডের আবেদন করা হবে। পরবর্তীতে তাদের রিমান্ডে এনে বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করলে মাঠ পর্যায়ে ওষুধ সরবরাহ ও বিক্রয়কারীদের তথ্য সংগ্রহ করে তাদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব হবে। গ্রেফতারকৃতদের বিরুদ্ধে কোতয়ালী থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে।

 

সংবাদটি শেয়ার করুন

সর্বশেষঃ