ডেস্ক রির্পোট- নদী মাতৃক বাংলাদেশের নদ-নদী, জলাধার, প্রকৃতি, নদী নির্ভর মানুষ ও তাদের জীবীকা হত্যা করা হচ্ছে নানাভাবে জবরদখল, দূষণের মাধ্যমে। যুদ্ধাপরাধিদের বিচারের জন্য যেমন ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে, নদী হত্যা বন্ধে অবৈধভাবে নদী জবরদখলকারিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তসহ সঠিক ও দ্রুত বিচারের জন্য সেরকম একটি সম্পূর্ণ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা এখন সময়ের দাবি। “বাংলাদেশের বিপন্ন নদ-নদী, হাওর-জলাশয় এবং জনমানুষের জীবিকা ও পরিবেশের নিরাপত্তা” শীর্ষক সেমিনারে অংশগ্রহণকারী আলোচকবৃন্দ এবং অন্যান্য বক্তারা জোড়ালোভাবে এ দাবিটি তুলে ধরেছেন।
মঙ্গলবার (২১ মার্চ) সকাল ১০.৩০ মিনিটে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনের এ টি এম শামসুল হক মিলনায়তনে পানি অধিকার ফোরাম, এএলআরডি, এবং বেলা- এর যৌথ আয়োজনে বিশ্ব পানি দিবস- ২০২৩ উপলক্ষে এ সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে।
এএলআরডি’র চেয়ারপারসন খুশী কবিরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সেমিনারে দুটো পৃথক প্রবন্ধ উপস্থাপন করা হয়। বাংলাদেশের নদ-নদী দখল, দূষণের সার্বিক চিত্র নিয়ে একটি উপস্থাপনা দিয়েছেন শামসুল হুদা, নির্বাহী পরিচালক, এএলআরডি। হাওরাঞ্চলের মৎস্য সম্পদের ওপর অপর একটি উপস্থাপনা দিয়েছেন ড. মো. মোতাহার হোসেন, ফ্যাকাল্টি অব ফিশারিজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।
প্যানেল আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান এবং ভূমি সচিব ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার; সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, নির্বাহী প্রধান, বেলা; এবং ড. শাহজাহান মন্ডল, অধ্যাপক, বুয়েট।
কোন এক অজ্ঞাত কারণে নদী সুরক্ষার উদ্যোগ এবং ্উদ্যোগের গতি থেমে যাচ্ছে।” প্রথম প্রবন্ধে শামসুল হুদা নদী সুরক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রমের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করে এ মন্তব্য করেন। তিনি আরও বলেন, “নদীকে মায়ের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে, নদীকে মেরে ফেলা মানে মা কে হত্যা করা। নিজের মা কে যারা হত্যা করে তারা সুসন্তান নয়।” দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অদক্ষতা, অসচেতনতা, অজ্ঞতা, উদাসিনতা, দূর্নীতি ইত্যাদি কারণে নদী সুরক্ষায় আইন বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। নদী, পাহাড়, জলাধার, কৃষিজমি রক্ষা করা না হলে আমাদের অস্তিত্ব থাকবে না। মাঠের আন্দোলন, সংগ্রাম আরও সংগঠিত ও সম্প্রসারিত করার ওপর জোর দেন তিনি।
ড. মো. মোতাহার হোসেন বলেন যে পুকুরে মাছ চাষের মাধ্যমে মাছের উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেলেও উন্মুক্ত জলাশয়ের পরিমাণ হ্রাস পাচ্ছে। ময়লা, আবর্জনা ফেলে ও দখল হয়ে সুরমা, কুশিয়ারা নদী এখন ছোট হয়ে গেছে। হাওরে এখন আইনঅনুযায়ী জাল ব্যবহার না করার কারণে দেশীয় ছোট ছোট মাছসহ আরও অনেক মাছের প্রজাতি এখন বিলুপ্তির পথে। এসব কারণে মাছের ব্রিডিং গ্রাউন্ড ও মাইগ্রেশনে বাধা পড়ছে, পানি ও জলজ উদ্ভিদ নষ্ট হচ্ছে।
সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন যে নদী, জলাশয়ের পরিবর্তন এসেছে ঠিকই, তবে তা নেতিবাচক পরিবর্তন। নদী কোন প্রকৌশলের বিষয় না, বরং নদীর পাড়ের মানুষের, কৃষকের, জেলের বেঁচে থাকার বিষয়। সংবিধানে নদী, জলাশয় সাধারণ জনগণের সম্পত্তি হলেও শিল্প-কারখানার মালিক এবং নদী দূষণকারীরাই এখন নদী উন্নয়নের ধারক ও বাহক। এদের কারণে ভূ-উপরিস্থ পানির উৎস এবং ভূ-গর্ভস্থ পানি এখন সংকটাপন্ন। বৃহত্তর জনস্বার্থে নদী সুরক্ষায় এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য আগামী নির্বাচনে প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহারে প্রকৃতি ও ভূ-গর্ভস্থ পানিবিষয়ক অঙ্গিকার থাকতে হবে। এছাড়াও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বর্তমানে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন নদী সুরক্ষায় তার ম্যান্ডেট থেকে সরে এসেছে। তিনি আরও বলেন, মাছের অভরাণ্যের কোন আইনগত স্বীকৃতি নেই। ১৯৫০ সালের মৎস্য সংরক্ষণ আইন দিয়ে ২০২৩ সালে এসে আপনি কিভাবে মাছের সুরক্ষা দেবেন?
ড. মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেন, পানি সম্পদ যে নামেই থাকুক তা সংরক্ষণ করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যে সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো এগুলো রক্ষায় জড়িত তাদের মননে স্থায়ীভাবে নদী সুরক্ষার বিষয়টিকে স্থান দিতে হবে। সরকারি কর্মকর্তাদের কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য কাজের হিসাব নেয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনে কঠোরভাবে দাপ্তরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ, মুক্তি নিহিত আছে জবাবদিহিতার মধ্যে। যারা যমুনা নদী সংকুচিত করতে চায়, কেন ও কি কারণে করতে চায় তার সঠিক কারণ জনগণকে জানাতে হবে। এ মরণঘাতি পরিকল্পনাকারীকে ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখী করতে হবে।
অধ্যাপক ড. শাহজাহান মন্ডল বলেন, যে কোন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ণের পূর্বে অর্থনীতির চেয়ে পরিবেশ ও সমাজকে সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
সেমিনারের সভাপতির বক্তব্যে খুশী কবির বলেন, প্রকৃতির পরিবর্তন আনতে চেষ্টা করলে সেটা অনেকসময় ক্ষতিকর হয়ে যায় আমাদের জন্য। বিজ্ঞান অনেককিছুর সমাধান দেবে ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতি ছাড়া জীবন ঠিক রাখতে গেলে সেটা বিজ্ঞানের গবেষণাগার হয়ে যাবে, জীবন ও পৃথিবী থাকবে না। আমরা গবেষণাগারের গিনিপিগ হতে চাই না। আমাদের ব-দ্বীপের বিশেষত্ব চিন্তা না করে বইয়ের বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করলে হবে না। তিনি, নদী হত্যাকারিদের নাম পরিচয় সবজায়গায় ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান।
এছাড়াও, সেমিনারে স্থানীয় পর্যায়ের চিত্র তুলে ধরে বরিশাল থেকে রফিকুল আলম, চলনবিল অঞ্চল থেকে মিজানুর রহমান, সুনামগঞ্জ থেকে ফেরদৌস আলম, সাভার থেকে বশির উদ্দিন, রংপুর থেকে ফরিদুল ইসলামসহ প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।