স্টাফ রিপোর্টার- ঢাকার বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর নিউ মার্কেট এলাকায় অবস্থিত গাউছিয়া মার্কেটে দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিরূপণে জরিপ চালিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। ফায়ার সার্ভিস, ডিজিএফআই ও এনএসআই কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি পরিদর্শন টিম গাউছিয়া মার্কেটে যায়। এরপর দোকান মালিক সমিতির অফিসে বসে মার্কেট সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য পূরণ করে গোটা মার্কেট ঘুরে দেখেন। পরিদর্শনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে এমন বেশ কয়েকটি বিষয় চিহ্নিত করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, অতীতেও মার্কেট সমিতিকে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছিল। তবে মার্কেটে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থায় কিছু ত্রুটি থাকলেও ঝুঁকিপূর্ণ মানতে নারাজ সেখানকার দোকান মালিক সমিতি।
সমিতির দাবি, ফায়ার সার্ভিসের পরিদর্শনে ১০টি বিষয়ের মধ্যে ৮টিতে তারা উত্তীর্ণ হয়েছেন। বাকি দুটি বিষয়ে তারা শিগগিরই ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। এরপরও তাদের মার্কেট কেন ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হচ্ছে তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা।
মার্কেট পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ সাংবাদিকদের বলেন, এই মার্কেটের ৬টি সিঁড়ি রয়েছে, কিন্তু সিঁড়িগুলো উন্মুক্ত নয়। ইলেকট্রিসিটির তার যেখানে-সেখানে ঝুলে রয়েছে। মার্কেটটিতে স্বয়ংক্রিয় অগ্নি সংকেত ব্যবস্থা স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল সেটি এখনো করা হয়নি।
এখানে অগ্নি নির্বাপণের কোনো প্যানেল বোর্ড নেই, এই বোর্ড থাকলে একটি ঘরে বসেই দেখা যায় কোথায় আগুন লেগেছে। মার্কেট কর্তৃপক্ষকে নিজেদের অগ্নি নির্বাপণী জনবল গড়ে তুলতে বলা হয়েছিল, যেটি এখনো দৃশ্যমান হয়নি। ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত ৭তলা এই মার্কেটে ৪৩০টি দোকান রয়েছে। বেশিরভাগই নারীদের পোশাক, জরি, লেস, গয়না ব্যাগ, জুতা ও কসমেটিকসের দোকান। মার্কেটের উপরের তলাগুলোতে পাইকারি ব্যবসায়ীদের অফিস ও গুদাম। ৩ বছর আগে এই মার্কেটে অগ্নি নির্বাপণী মহড়া দিয়েছিল ফায়ার সার্ভিস। বজলুর রশিদ জানান, তখন ব্যবসায়ীদের কিছু করণীয় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছিল। যেগুলোর অনেকগুলোই তারা পালন করেছেন।
মার্কেটের ৬০টি ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্থাপন করা হয়েছে বলে ব্যবসায়ীরা আমাদের জানিয়েছেন। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা ঘুরে দেখেছেন সেগুলোর মেয়াদ আছে এবং সেগুলোর মনোমিটারে পর্যাপ্ত প্রেসার শো করছে। তবে বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসকে পানির সংকটে পড়তে হয়েছিল। সেজন্য এই মার্কেটে ফায়ার হাইড্রেন্ট স্থাপনের কথা বলা হয়েছিল, যা এখনো দৃশ্যমান হয়নি। তবে তারা জানিয়েছেন, তারা একটি ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভার স্থাপন করেছেন। এখানে পর্যাপ্ত পানি রয়েছে বলে আমরা তাদের জানিয়েছি। গাউছিয়া মার্কেটের যে ৬টি সিঁড়ি রয়েছে, দোকান বসার কারণে সবগুলোই অপ্রশস্ত হয়ে পড়েছে। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এসব সিঁড়ি দিয়ে পর্যাপ্ত মানুষ নামতে পারবে না বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক বজলুর। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে এই সিঁড়িগুলো দিয়ে পর্যাপ্ত মানুষ নামতে পারবে না। আর সিঁড়িতে যদি আগুন লেগে যায় তাহলে সেই সিঁড়ি ব্যবহারযোগ্য থাকবে না। তাই সিঁড়ি খালি রাখা বাঞ্ছনীয়।
ঠিক এই মুহূর্তে রাজধানীর কতোটি মার্কেট ঝুঁকিপূর্ণ, এমন প্রশ্নের জবাবে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা শহরের অনেক মার্কেট ও কাঁচাবাজার ঝুঁকিপূর্ণ। এরমধ্যে ঠাটারিবাজার, রাজধানী সুপার মার্কেট, নিউমার্কেট, চকবাজারসহ বিভিন্ন জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সব মার্কেটেই কিছু না কিছু ঝুঁকি রয়েছে। কারণ কেউ ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারেনি। তাই আমাদের দৃষ্টিতে বেশিরভাগ মার্কেটই ঝুঁকিপূর্ণ। আমরা অনুরোধ করবো মার্কেটগুলোতে ফায়ার সার্ভিসের নির্দেশনা যেন শতভাগ বাস্তবায়ন করা হয়। তবে গাউছিয়া মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণার বিষয়টিকে মানতে সেখানকার নারাজ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি কামরুল ইসলাম বাবু।
৩ বছর আগে ফায়ার সার্ভিস যে পরামর্শ দিয়েছিল, সে অনুযায়ী কাজ করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, মার্কেটের বৈদ্যুতিক লাইন শতভাগ ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শ মতো উন্নত করা হয়েছে, বসানো হয়েছে ফায়ার এক্সটিংগুইশার। তারা এখন যে পরামর্শগুলো দিয়ে যাচ্ছেন, সেগুলো আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো। তিনি দাবি করেন, মার্কেটের ভবন তৈরির সময় রাজউকের অনুমোদন নেয়া আছে। বুয়েটের বিশেষজ্ঞরা এর ডিজাইন করেছেন। ফায়ার সার্ভিস তাদের সার্টিফিকেট দিয়েছে। এরপরও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বলার কোনো মানে হয় না। এভাবে আতঙ্ক তৈরি করলে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বিরূপ প্রভাব পড়বে। ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
কামরুল ইসলাম বাবু বলেন, গাউছিয়া মার্কেটের আশপাশে পর্যাপ্ত প্রশস্ত রাস্তা রয়েছে। এমন প্রশস্ত রাস্তাযুক্ত মার্কেট ঢাকা শহরে কমই আছে। মার্কেটে প্রবেশ ও বাহির হওয়ার জন্য ৬টি সিঁড়ি আছে। ফায়ার সার্ভিস পানি সংকটের কথা বলেছে। আমাদের বিল্ডিংয়ের নিচে ও ছাদে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানির মজুত আছে। ইলেক্ট্রিসিটির লাইন আধুনিক সুযোগ-সুবিধাযুক্ত চ্যানেলের মাধ্যমে স্থাপন করা হয়েছে। পুরো মার্কেটটিতে নিজস্ব বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যবস্থা রয়েছে। মার্কেট সমিতির সভাপতি বলেন, ফায়ার সার্ভিস যেসব নিয়মের কথা বলছে সেসব নিয়ম মানার পরও অভিজাত শপিংমলগুলোতে আগুন লাগছে।
এমনকি এমনো অভিজাত শপিং মল আছে যেগুলোতে পরপর তিনবার আগুন লেগেছে। কিন্তু গাউছিয়াতে অগ্নিকাণ্ডের রেকর্ড নাই। পুরো মার্কেটে আগুনের ব্যবহার নিষিদ্ধ। ধূমপান নিষিদ্ধ করার পাশাপাশি মশার কয়েল ও আগরবাতি ব্যবহারও বন্ধ করা হয়েছে। ঢাকা শহরে ১০০ মার্কেটের সঙ্গে তুলনা করলে গাউছিয়া মার্কেট এক নম্বর হবে। স্মোক ডিটেক্টর স্থাপনের বিষয়ে তিনি বলেন, ভবনটির চারপাশে খোলা বারান্দা থাকায় স্মোক ডিটেক্টর কাজে আসবে না। এটা পুরোপুরি মূল্যহীন। তারপরও তারা এটি স্থাপন করবেন।
সিঁড়িতে বসা দোকানের বিষয়ে কামরুল হাসান বাবু বলেন, মার্কেট তৈরির সময় থেকেই এই সিঁড়ির দোকানগুলো রয়েছে। আমরা এগুলো বরাদ্দ দেইনি।
ভয়াবহ আগুনে ঢাকার কাপড়ের সবচেয়ে বড় মার্কেট বঙ্গবাজার পুড়ে ছাই হওয়ার পরদিন বুধবার ফায়ার সার্ভিস জানায়, রাজধানীতে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেট ও বিপণীবিতানগুলোয় জরিপ চালাবে তারা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মাইন উদ্দিন সদর দপ্তরে এক ব্রিফিংয়ে বলেন, আপাতদৃষ্টিতে রাজধানী সুপার মার্কেট, গাউছিয়াসহ বেশকিছু মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে। বৃহস্পতিবার থেকে এসব মার্কেটে জরিপ শুরু হবে। জরিপের ফলাফল তাৎক্ষণিকভাবেই জানানো হবে। কার্যক্রম শুরুর প্রথমদিন গতকাল গাউছিয়া মার্কেট পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিস ও অন্যদের সমন্বয়ে গঠিত টিম, যারা ব্যস্ত এই মার্কেটকে আগে থেকেই ঝুঁকিপূর্ণ মনে করে আসছে।