মিথুন আশরাফ
‘আমি প্রস্তুত, চলো আর্জেন্টিনা।’ – ফাইনাল ম্যাচের আগে কথাগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছিলেন আর্জেন্টিনার অধিনায়ক ও সুপারস্টার লিওনেল মেসি। পরে হ্যাশট্যাগ দিয়ে তিনি আরও লিখেন, ‘কোনোকিছুই অসম্ভব না।’ সত্যিই তাই হলো। বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল মেসির আর্জেন্টিনা। অবশেষে রুদ্ধশ্বাস ফাইনাল জিতে মেসির আর্জেন্টিনার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়া সম্ভব হয়ে গেল। স্বপ্নজয় হলো মেসির। মেসি নিজেও জোড়া গোল করেন।
ফুটবল বিশ্বকাপের ২২তম আসরে এসে নিজের অধরা সেই শিরোপার খোঁজ পেলেন মেসি। রবিবার দোহার লুসাইল স্টেডিয়ামে ফ্রান্সকে কাতার ফুটবল বিশ^কাপের ফাইনালে টাইব্রেকারে ৪-২ গোলে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হতেই তৃতীয়বারের মতো শিরোপা ঘরে তুলল আর্জেন্টিনা। এবার মেসির হাত ধরে শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। এরআগে ১৯৭৮ ও ১৯৮৬ সালে বিশ^চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ১৯৭৮ সালে ড্যানিয়েল প্যাসারেলা ও ১৯৮৬ সালে ডিয়েগো ম্যারাডোনার নেতৃত্বে বিশ^কাপ জিতে আর্জেন্টিনা। নিজের পঞ্চম বিশ^কাপে এসে মেসিও এবার আর্জেন্টিনাকে বিশ^কাপ জেতালেন।
১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ জয়ের পর ৩৬ বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটল আর্জেন্টিনার। চতুর্থ দল হিসেবে তিন বা তার বেশি বিশ্বকাপ জেতার নজির তৈরি হলো। বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ব্রাজিল। জার্মানি এবং ইতালি জিতেছে চারবার করে। এরপরই আর্জেন্টিনার অবস্থান।
ফ্রান্স এরআগে ১৯৯৮ সালে প্রথম বিশ^কাপ জিতেছিল। দিদিয়ের দেশামের তত্বাবধানে বিশ^কাপ জিতে। দ্বিতীয়বার গত আসরে, ২০১৮ সালে হুগো লরিসের নেতৃত্বে চ্যাম্পিয়ন হয়। এবার তৃতীয় ও টানা দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা জেতার সুযোগ ছিল। হুগো লরিসের নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয়বার বিশ^চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু মেসি তা হতে দেননি। আর্জেন্টিনা তা হতে দেয়নি।
বিশ্বকাপ গত ২০ নভেম্বর শুরু হয়েছিল। ২৯ দিনের মহাযজ্ঞ শেষে বিশ্বকাপের পর্দা নামে। কাতার ফুটবল বিশ্বকাপের পর্দা নামে। ২২তম বিশ্বকাপের সমাপ্তি ঘটে। মেসি ক্যারিয়ারের শেষ বিশ^কাপ ম্যাচ খেলতে নামেন। পঞ্চমবারে এসে অবশেষে নিজের হাতে শিরোপা উচিয়ে ধরতে পারেন। কিলিয়ান এমবাপ্পে, আন্তোনিও গ্রিজম্যান, অলিভিয়ের জিরু, উসমান ডেম্বেলেদের ফ্রান্সের বিপক্ষে গত আসরে হারের বদলা নেন লিওনেল মেসি, হুলিয়ান আলবারেজ, ডি মারিয়া, নাহুয়েল মোলিনারা। আর্জেন্টিনাকে এবার এমন সময় জেতান, যখন শিরোপাই জয় হয়ে যায়।
এরআগে কখনোই আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স বিশ্বকাপ ফাইনালে লড়াই করেনি। এবার প্রথমবার লড়াই করে জিতে আর্জেন্টিনা। ফ্রান্সের উসমান ডেম্বেলে বলেছিলেন, ‘মেসি বিশ্বকাপের দাবিদার।’ মেসিই বিশ^কাপ জিতল। মেসির মাথায় প্রথমবারের মতো বিশ্বচ্যাম্পিয়নের মুকুট উঠল। স্বার্থক হলো যেন তার ফুটবল খেলা। তাতে করে সর্বকালের সেরা ফুটবলারের খেতাবেও সর্বজন স্বীকৃত হয়ে যেতে পারেন।
অবশ্য আর্জেন্টিনাকে কঠিন পরীক্ষাই দিতে হয়। ফ্রান্সের ফুটবলারদের গতির সামনে যে কুলিয়ে ওঠা কঠিন হয়ে পড়ে। তবে ম্যাচটি ফাইনাল ম্যাচ থাকায় স্নায়ুচাপ নেয়ার সঙ্গে ছন্দ ধরে রাখতে সম্ভব হয়। মেসি যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি ছন্দে থাকেন, তাও ধরে রাখেন। নকআউট পর্বে প্রতি ম্যাচেই গোল পান মেসি। ফাইনালেও গোল পান। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপে স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল মেসির। ফাইনালে জিততে পারেননি। এবার নিজের শেষ বিশ্বকাপে এসে স্বপ্ন বাস্তব হয়। স্বপ্ন জয় হয়।
বিশ্বকাপের গত আসরে ফ্রান্সের কাছে শেষ ষোলতে হেরে বিদায় নেয় আর্জেন্টিনা। ৪-৩ গোলে হারে। সেই হারের বদলা নেয়া হয়ে যায়। সাথে বিশ^কাপের ইতিহাসে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স এরআগে তিনবার লড়াই করে যে দুইবার জিতেছিল আর্জেন্টিনা, জয় সংখ্যাও বাড়িয়ে নিল আর্জেন্টিনা।
ম্যাচের প্রথমার্ধেই ২ গোল করে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ম্যাচের ২৩ মিনিটে পেনাল্টি থেকে গোল করেন মেসি। এরপর ৩৬ মিনিটে ডি মারিয়া আরেকটি গোল করে বসেন। ম্যাচের ২১ মিনিটে ডি মারিয়াকে বক্সে ফাউল করা হয়। পেনাল্টি পেয়ে ২৩ মিনিটে গোল করেন মেসি (১-০)। এ বারের বিশ্বকাপে ষষ্ঠ গোল হয় মেসির।
এরপর আর্জেন্টিনা বক্স থেকে অনবদ্য একটা মুভ তৈরি হয়। মেসি-ম্যাক অ্যালিস্টার। ম্যাক যে পজিশনে ছিলেন, তাঁর শট ব্লক হয়ে যেতে পারত। বাঁ দিকে বল বাড়ান ডি মারিয়াকে। হুগো লরিস জায়গা বদলের সুযোগ পেলেন না। ৩৬ মিনিটে ডি মারিয়া অনবদ্য গোল করে বসেন (২-০)।
ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধেও আর্জেন্টিনা দাপট দেখাতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ করেি খেলা ঘুরে যায়। ৭৮ মিনিট খেলা গড়িয়ে যায়। মনে করা হয়, আর্জেন্টিনাই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। কিন্তু ৭৮ মিনিটে পেনাল্টি পেয়ে যায় ফ্রান্স। কিলিয়ান এমবাপ্পে গোল করে বসেন। খেলায় উত্তেজনা তৈরী হয়ে যায়। ফ্রান্স ব্যবধান কমায় (২-১)। মেসির সঙ্গে সমান ৬ গোলও হয় এমবাপ্পের। দেখতে দেখতেই আরেকটি গোল করে বসেন এমবাপ্পে। পরের মিনিটেই ডিবক্সের ভেতর বল পেয়েই গোল করে বসেন এমবাপ্পে। তাতে করে ফ্রান্স ২-২ সমতায় ফিরে। এমবাপ্পেও ৭ গোল করে গোল্ডেন বুটের দৌড়ে এগিয়ে যান। ফ্রান্সেরও গতি চরমভাবে বেড়ে যায়। শেষপর্যন্ত খেলা অতিরিক্ত মিনিটে গড়ায়। যেখানে মনে করা হচ্ছিল, খেলার নির্ধারিত মিনিটেই শেষ হয়ে যাবে খেলা, সেখানে অতিরিক্ত সময়ে খেলা গড়ায়।
অতিরিক্ত ১৫ মিনিটও শেষ হয়ে যায়। যখন ১০৮ মিনিটে খেলা যায়, তখন আবার মেসি গোল করে দলকে এগিয়ে দেন। ৩-২ গোলে এগিয়ে যায় আর্জেন্টিনা। ডি মারিয়াকে বদলের পরই আর্জেন্টিনার খেলায় গতি কমে যায়। সেই গতি আবার শেষ ১৫ মিনিটে যেন ফিরে আসে। মেসি গোল করতেই বিশ্বকাপে ৭ গোল হয়ে যায়। এমবাপ্পের সমান গোল হয়। ১১৭ মিনিটে গিয়ে আবার ফ্রান্স গোল পেয়ে যায়। আবার পেনাল্টি পায় ফ্রান্স। এবারও এমবাপ্পে গোল করেনন (৩-৩)। শেষমুহুর্তে গিয়ে সমতায় ফিরে খেলা। এমবাপ্পে হ্যাটট্রিক করেন। বিশ্বকাপের ফাইনালে হ্যাটট্রিক করেন। বিশ্বকাপে ৮ গোল হয়ে যায় এমবাপ্পের। গোল্ডেন বুট জেতাও নিশ্চিত হয়ে যায়। খেলা যে টাইব্রেকারে গড়ায়। টাইব্রেকারে ফ্রান্সের দ্বিতীয় শটটি আটকে দেন গোলরক্ষক মার্টিনেজ। তৃতীয় শটটিও মিস করে ফ্রান্স। অবশেষে ৪-২ গোলে জিতে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা। ফ্রান্স এবার রানার্সআপ হয়।
ইউরোপের আধিপত্য থামিয়ে দিল আর্জেন্টিনা। ২০০২ কোরিয়া বিশ্বকাপে ব্রাজিলের পর চার আসরে ট্রফি জিতেছে ইউরোপের দেশ। এবার আর্জেন্টিনা আবার লাতিন আমেরিকার কোনো দেশ হিসেবে বিশ্বকাপ জিতল। ব্রাজিলের (২০০২) পর লাতিন আমেরিকার প্রথম দল হিসেবে ইউরোপীয় দলকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জেতার নজির তৈরি হলো। ব্রাজিল সে বার হারিয়েছিল জার্মানিকে। স্পেনের পর দ্বিতীয় দল হিসেবে প্রথম ম্যাচ হেরেও বিশ্বকাপ জয়ের নজির গড়ল আর্জেন্টিনা। মেসির আর্জেন্টিনা বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হলো।