শাহাব উদ্দিন মাহমুদ
গতকালের পর…
একাত্তরের শুরুতে জুলফিকার আলী ভুট্টো সামরিক কর্তাদের যোগসাজশে বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ ও বিজয়ী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা সৃষ্টি করে সংঘাতের পথ রচনায় সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে এই নির্বাচনের ফলাফলেও পাকিস্তানের দুই প্রদেশের ঐক্য যে অবাস্তব এবং দেশটির ঐক্যবদ্ধ ভবিষ্যৎ যে সংকটাপন্ন, তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আওয়ামী লীগ জাতীয় সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করলেও ২৬৭টি অর্থাৎ সব আসনই জিতেছে পূর্ব পাকিস্তানে। আবার ভুট্টোর পাকিস্তান পিপলস পার্টির কোনো ভিত্তিই ছিল না দেশের পূর্বাংশে। দুই প্রদেশে প্রতিনিধিত্বকারী কনভেনশন মুসলিম লীগ আগেই কাগুজে দলে পরিণত হয়েছিল এবং এই বাংলায় চিরকালের জন্য দলটি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলে পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকে বাঙালির ভবিষ্যৎ নিয়ে শেখ মুজিবের চিন্তার দূরদর্শিতা স্পষ্ট বোঝা যায়। বঙ্গবন্ধু কালের যাত্রাপথে নানা সংকটে-বিপদে-বিপর্যয়ে অবিচল থেকে একে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার অনিবার্যতা আগেই বুঝেছিলেন বলে স্বাধীনতা নিয়ে তাঁর মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল না। ছয় দফা, মাঠের রাজনীতি এবং বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু তাঁর যাত্রাপথ স্পষ্টই রেখেছিলেন। নির্বাচনে বিজয়ী শক্তিশালী বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এতটাই ভয় পেয়েছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা তারা ভাবতেই চায়নি। এটাও ঠিক যে তারা বাঙালি মুসলমানদের কখনো সমকক্ষ নাগরিক ভাবতে পারেনি। এদের দ্বারা শাসিত হওয়ার বিষয়ে তাদের চরম অনীহা প্রকাশ পেয়েছে। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসিয়ে ব্যর্থতার দায় চাপানোর চক্রান্তের পুরোনো কৌশল প্রয়োগের সাহসও করেনি। তারা সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া বিকল্প কিছু ভাবতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ আকস্মিক এক ঘোষণায় ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেন। বিশাল ষড়যন্ত্রের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তারা নির্বাচনের রায় অস্বীকার করা মাত্রই সারা দেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। তাঁর নির্দেশে এই অঞ্চল চলতে শুরু করল। সমগ্র প্রদেশ তাঁকে সমর্থন জানাল। অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে (২-২৫ মার্চ ১৯৭১) পূর্ব পাকিস্তানের গোটা বেসামরিক প্রশাসন তাঁর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং তাঁর নির্দেশমতো চলে। তিনি কার্যত প্রদেশের সরকারপ্রধান হয়ে যান। লন্ডনের দৈনিক Evening Standard পত্রিকার ভাষায়: ‘জনতার পুরোপুরি সমর্থন পেয়ে শেখ মুজিব যেন পূর্ব পাকিস্তানের কর্তৃত্বে সমাসীন হন।’ বেতারে ইয়াহিয়ার বিবৃতি প্রচারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব বাংলার মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। বাঙালি জাতি অপেক্ষা করতে থাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কী নির্দেশ দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনার রেসকোর্স মাঠে পূর্বঘোষিত জনসভায় ১০ লক্ষাধিক মানুষের বিশাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করেন। বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বলেছিলেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে, তা নিয়ে শক্রর মোকাবিলা করতে হবে। এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত হননি। তিনি অহিংস, অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি দেন, যা বাংলাদেশের সর্বত্র স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালিত হতে থাকে। তিনি বেসামরিক প্রশাসন চালু করার জন্য ৩৫টি বিধি জারি করেন। ১৯৭১ সালে ৭ মার্চ থেকে পূর্ব বাংলা মূলত তাঁর নির্দেশেই চলতে থাকে। সেদিন থেকেই ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়িটি ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের সব আশা-আকাঙক্ষার উৎস। মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকত সেখান থেকে কী নির্দেশ আসে? দেশের বাস্তব সার্বভৌমত্ব যখন জনগণের হাতে, এমনই এক পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতা বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর দলের সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে ১৫ মার্চ ঢাকায় আসেন। পরদিন থেকে আলোচনা শুরু হয়, যা মাঝেমধ্যে বিরতিসহ ২৫ মার্চ সকাল পর্যন্ত চলে। এ সময়ে পূর্ব পাকিস্তানে অসহযোগ আন্দোলন এবং লাগাতার হরতাল চলছিল। ২ মার্চ থেকে ছাত্র এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা স্বাধীনতা ঘোষণা করতে থাকেন এবং এ ধারা অব্যাহতভাবে চলে। ২৫ মার্চ ১৯৭১, টালমাটাল মার্চের এদিন মানুষের ঢল নামে মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে। সকাল ৮টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত সারাদিন মাঝে মাঝে মিছিলের সামনে এসেই তিনি সংক্ষিপ্ত বিবৃতি প্রদান করেন এবং সবাইকে সর্বাত্মক সংগ্রামের জন্য তৈরি হওয়ার আহ্বান জানান। এদিন তার বাড়িতে সকাল থেকে অগণিত সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন এবং তাদের মধ্যে প্রায় ২০০ ছিলেন বিদেশি। বেলা ১২টায় শেখ মুজিব খবর পান, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সদলবলে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে চলে গেছেন। ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেনÑ আমি শুধু বাংলার মাটি চাই, মানুষ নয়। বাঙালির আবেগ, সংগ্রাম ও মুক্তির আকাক্সক্ষাকে নির্মূল করতে অস্ত্র হাতে ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠার নীলনকশা চূড়ান্ত করে শোষিত ও নির্যাতিত মানুষের স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অপারেশন সার্চলাইটের নামে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন স্থানে পৈশাচিক তাণ্ডব চালিয়ে ছাত্র-শিক্ষক এবং নিরীহ লোকদের গণহারে নিষ্ঠুরভাবে হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। বঙ্গবন্ধু আত্মগোপন বা গা ঢাকা দিয়ে প্রতিবেশী সম্ভাব্য বন্ধুরাষ্ট্রে গিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রাম চালানোর চেয়ে প্রতিপক্ষের হাতে বন্দি হওয়াকেই নিজের ভাগ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর মতো ক্যারিশম্যাটিক জনপ্রিয় নেতার জন্য হয়তো এটাই স্বাভাবিক পদক্ষেপ। তবে তাজউদ্দীন আহমদসহ সতীর্থ সবাইকে নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার এবং তাঁর অনুগামী জনগণকে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশনা দিয়েছিলেন। শুধু তা-ই নয়, তিনি বেতারযন্ত্রের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণাও দিয়েছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চের সূচনালগ্নে গ্রেফতার হওয়ার আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে বলেন, ‘এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হতে বাংলাদেশ স্বাধীন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিত পিলখানার ইপিআর ঘাঁটি, রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের লোকদের হত্যা করছে। ঢাকা-চট্টগ্রামের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশে^র জাতিগুলোর কাছে সাহায্যের আবেদন করছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশÑ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দু থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোনো আপস নেই, জয় আমাদের হবেই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্য দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় লোকদের এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আমাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’
বঙ্গবন্ধুর এই স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বর ও নির্বিচারে গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও সর্বব্যাপী পৈশাচিক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি তাদের সর্বশক্তি নিয়ে সশস্ত্র লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সারাদেশে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। অপ্রস্তুত জাতির ওপর পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীই বস্তুত যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তারপর বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব রূপকথার মতো অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। নিষ্ঠুর আক্রমণের মুখে লাখো নিরস্ত্র মানুষ যেমন ঘরবাড়ি, সহায়সম্পদ, দেশ ছেড়ে পালিয়েছিল; তেমনই আবার বাঙালি সেনা এবং কিশোর থেকে বৃদ্ধ নানা বয়সের হাজারও মানুষ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য পাগলপারা হয়েছে। এ এক রূপান্তরের কাহিনি। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে মেহেরপুরের অখ্যাত গ্রাম ভবের পাড়া। ওই গ্রামেরই বৈদ্যনাথতলায় সাদামাটা পরিবেশে একটি আমবাগানে শপথ নিয়েছিল ঐতিহাসিক মুজিবনগর সরকার। একাত্তরের ১৭ এপ্রিল শপথ নেওয়া ওই সরকারের নেতৃত্বেই দেশের অকুতোভয় সূর্যসন্তানরা দীর্ঘ নয় মাস তুমুল যুদ্ধ করে ৩০ লাখ শহিদের প্রাণের বিনিময়ে ছিনিয়ে আনে স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে বৈদ্যনাথতলার নামকরণ করা হয় মুজিবনগর। সে সরকারও পরিচিতি পায় মুজিবনগর সরকার নামে। মিয়ানওয়ালি কারাগারে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বিচার চলাকালে ডিফেন্স লইয়ার হিসেবে একে ব্রোহিকে নিয়োগ দিতে চেয়েছিল পাকিস্তান সরকার। দৃঢ়চেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন, ‘আই উইল নট ডিফেন্ড মাইসেলফ। বিকজ ইয়াহিয়া খান ইজ দ্য প্রেসিডেন্ট অব পাকিস্তান। ইয়াহিয়া খান ইজ দ্য চিফ মার্শাল ’ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটটর। হি ইজ দ্য কনফার্মিং অথরিটি অব মাই ডেথ সেনটেন্স। অলরেডি হি টোল্ড, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর। যেহেতু রায় দেওয়া হয়ে গেছে। সুতরাং আমি নিজকে ডিফেন্ড করব না।’ একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী মাথা নত করে পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। বিশে^র মানচিত্রে স্থান পায় একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন পতাকাÑ যার নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের পর ভুট্টো ভীত হয়ে পড়ে যে, ইয়াহিয়া কি ইতোমধ্যে মুজিবকে হত্যা করেছে? তাহলে বাংলাদেশে এই খবর পৌঁছলে সেখানে বন্দি হয়ে থাকা প্রায় এক লাখ পাকিস্তানি সৈন্যের প্রতি মুক্তিবাহিনী কোনো প্রকার যুদ্ধবন্দির সম্মান বা করুণা প্রদর্শন না করার সম্ভাবনাই বেশি। তাদের জীবিত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ভুট্টো নিউইয়র্কে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনে ব্যস্ত থাকার কারণে সর্বশেষ কয়েকদিন মুজিবের অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। ভুট্টোর চাপাচাপিতে ইয়াহিয়া স্বীকার করেন যে, মুজিব এখনো বেঁচে আছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া এটাও বলেন যে, প্রাণ থাকতে তিনি মুজিবকে জীবিত ফেরত দেবেন না। এদিকে ১৯ ডিসেম্বর রাতে পরাজয়ের অপমান সহ্য করতে না পেরে পদত্যাগ করেন তৎকালীন পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান। রাতে পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্ট পদে ইয়াহিয়া খানের ইস্তফাদানের বার্তা ঘোষিত হয়। বার্তায় বলা হয়, ‘আগামীকাল প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের সাথে সাথে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে দেশের পথে রয়েছেন এবং তিনি নতুন সরকার গঠন করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।’ ভুট্টোর ফেরার খবর পেয়েই জরুরি মিটিং ডাকেন ইন্দিরা গান্ধী। ভুট্টোর বিমান রিফুয়েলিংয়ের জন্য থামার কথা ছিল হিথ্রো বিমানবন্দরে। ইন্দিরা গান্ধী চেয়েছিলেন, সেসময় সেখানে উপস্থিত থাকুক কোনো ভারতীয় প্রতিনিধি। যাতে তিনি জানতে পারেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কী ভাবছেন তিনি? সেই বৈঠকে ছিলেন বিদেশমন্ত্রকের উপদেষ্টা দুর্গা প্রসাদ ধর, RAW প্রধান রামনাথ কাও, প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিএন হাসকার, বিদেশ সচিব টিএন কাউল। পূর্ব পাকিস্তানের চিফ সেক্রেটারি মুজাফফর হোসেন ভারতে যুদ্ধবন্দি হন এবং ডিপি ধরের বাড়িতে অতিথির মর্যাদায় ছিলেন। তার স্ত্রী ছিলেন লন্ডনে। ফলে সেই সময় কূটনীতিকদের মাধ্যমেই যোগাযোগ করতেন স্বামী-স্ত্রী। অবসরপ্রাপ্ত কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, তিনিই দুজনের মাধ্যম হয়ে উঠেছিলেন। ফলে দুজনের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়। লায়লা ছিলেন ভুট্টোর একসময়ের বান্ধবী। সেই লায়লাকেই কাজে লাগান ইন্দিরা গান্ধী। ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে পাঠান লায়লাকে। উদ্দেশ্য ছিল একটাইÑ শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কী ভাবছেন, সেটা জানা। এই শশাঙ্ক বন্দ্যোপাধ্যায়ই লায়লাকে জানান, তিনি যাতে হিথ্রো বিমানবন্দরে গিয়ে একসময়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভুট্টোকে বলেন, তাঁর স্বামীকে ভারত থেকে ছাড়ার ব্যবস্থা করতে। সেই মতো এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে দেখা হয় দুজনের। কথাবার্তা শেষে লায়লাকে কাছে টেনে তার কানে কানে একটা বার্তা দেন ভুট্টো। বলেন, ‘লায়লা আমি জানি, তুমি কী জানতে এসেছ! একটা মেসেজ দিও ইন্দিরা গান্ধীকে। বলো, আমি মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেব। কিন্তু বদলে কী চাইব? সেটা পরে জানাব।’ বার্তা জানান লায়লা। তবুও সন্দেহ দূর হয় না। ভারতকে ভুল পথে চালিত করছেন না তো ভুট্টো? কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই সন্দেহের অবসান হলো। খবরটা সত্যি সেটাই জানা গেল। বদলে চাওয়া হলো ৯৩ হাজার যুদ্ধবন্দিকে। ক্ষমতা হারানোর শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা জেলের অন্য কয়েদিদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত করে। মিয়ানওয়ালি কারাগারের কয়েদিদের মধ্যে গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, বাংলাদেশে নিয়াজিকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিশোধ হিসেবে মুজিবকে হত্যা করতে হবে। চক্রান্তের পরিকল্পনা ছিল ভোর ৬টায় কয়েদিদের সেল খুলে দেওয়া হবে এবং তারা বঙ্গবন্ধুর সেলে আক্রমণ চালাবে। কিন্তু জেলার হাবিব আলীর সহৃদয়তায় বঙ্গবন্ধু বেঁচে যান। জেলার ভোর ৪টায় বঙ্গবন্ধুকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান এবং বঙ্গবন্ধু সেখানে পরবর্তী দুইদিন অবস্থান করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়ে প্রথম ভাষণেই ‘ভাঙা পাকিস্তানকে’ জোড়া লাগানোর আবেদন জানিয়ে ভুট্টো বলেছিলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তান আমাদের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তারা এদেশের বৃহদাংশ। আমি নিশ্চিত তারা আমাদের সঙ্গে একসঙ্গে বাস করতে চায়। আমি তাদের কাছে আবেদন করছি, তারা যেন আমাদের ভুলে না যায়। তবে তারা যদি ক্ষুব্ধ হয়ে থাকে, তাহলে তারা যেন আমাদের ক্ষমা করে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা পূর্ব পাকিস্তান ফিরে পেতে লড়াই করব।’ ক্ষমতা হারানোর শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা জেলের অন্য কয়েদিদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চক্রান্ত করে ব্যর্থ হয়ে, দায়িত্ব হস্তান্তরের সময় বঙ্গবন্ধুকে হত্যায় মরিয়া ইয়াহিয়া ভুট্টোকে প্রস্তাব দেন পেছনের তারিখ দেখিয়ে মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো যায় কি না। কিন্তু ভুট্টো অস্বীকৃতি জানান।
মুক্ত বাংলাদেশে বিজয়োল্লাসের মধ্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে উদ্্গ্রীব হয়ে পড়ে সবাই। পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমগুলো বিবেকবান উদ্বিগ্ন মানুষকে জানিয়ে দেয় যে মুজিব বেঁচে আছেন। স্বস্তি পায় পুরো পৃথিবী। কিন্তু অপেক্ষার এক দীর্ঘ প্রহর শুরু হয় সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে, বঙ্গবন্ধুর নিজের মানুষের মাঝে। কবে নেতা ফিরে আসবেন? নেতার ফিরে আসা ছাড়া এই স্বাধীনতা অর্থহীন। বিশ^ নেতৃবৃন্দ তাঁর জীবন বাঁচাতে উদ্যোগী হলে রাওয়ালপিন্ডিতে বিদেশি সংবাদদাতাদের জন্য আয়োজিত নৈশভোজে পাকিস্তানের নতুন প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বীকার করলেন, শেখ মুজিব অক্ষত রয়েছেন। তবে শীঘ্রই তাঁকে মুক্তি দিয়ে গৃহবন্দি করে রাখা হবে। ইতোমধ্যে বঙ্গবন্ধুকে রাওয়ালপিন্ডির সিহালা নামক স্থানে একটি বাড়িতে সরিয়ে নেওয়া হয় এবং তাঁকে সেখানে গৃহবন্দি করে রাখা হয়। ক্ষমতা সংহত করে সেখানে দেখা করতে হাজির হন জুলফিকার আলী ভুট্টো। ২৩ এবং ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ দুদফায় বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। ভুট্টোকে প্রথমবার দেখে বঙ্গবন্ধু বিস্ময় প্রকাশ করেন, ভুট্টো আপনি এখানে কেন? ভুট্টো জানান, তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। বঙ্গবন্ধু শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে বলেন, সেই ম্যান্ডেট তো আমার ছিল, আপনি কোন যোগ্যতায়? বিব্রত ব্যক্তিত্ব হারানো ভুট্টো উচ্চারণ করেন যে তিনি পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও বটে। ভ্রাতৃত্বের দোহাই, কোনোভাবে দুই পাকিস্তানকে এক রাখার চেষ্টা, ভুট্টোর সরকারে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি হওয়া কিংবা অন্তত কনফেডারেশনÑ এরকম অনেক উদ্ভট প্রস্তাব উড়িয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু বলেন, ‘আমার মানুষদের কাছে ফিরে যাওয়া ছাড়া আমি কিছুই বলতে পারব না।’ বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে প্রিয় শব্দ ‘আমার মানুষ’। করাচিতে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে এক বৈঠকে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে ভুট্টো সিদ্ধান্ত নেন বলে জানা যায়। কিন্তু সঠিক তারিখটি গণমাধ্যমকে জানাননি তিনি। তারপর ৩ জানুয়ারি করাচিতে লাখো মানুষের এক উন্মুক্ত জনসভায় ভুট্টো পাকিস্তানের জনগণের সম্মতি আদায় করে নেন মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে। ভুট্টোর প্রশ্নের জবাবে জনতা চিৎকার করে জবাব দেয়, হ্যাঁ, আমরা মুজিবের মুক্তি চাই। ভুট্টো স্বস্তির সঙ্গে উচ্চারণ করেন ‘শুকরিয়া’। কিন্তু ভুট্টো ভেতরে ভেতরে গোপন ষড়যন্ত্র আঁটতে থাকে!
১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ডিনার টেবিলে ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলেন যে ইরানের শাহ আসছেন। তাই নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তানের আকাশসীমা বন্ধ এবং সুরক্ষিত রাখা হয়েছে। ভুট্টো প্রস্তাব করেন যে, এই পরিস্থিতিতে মুজিব তাঁর দেশে ফেরা বিলম্বিত করতে পারেন কি না। বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে, মরিয়া ভুট্টো শাহের মাধ্যমে তাঁকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন দুই পাকিস্তানের কোনো সম্পর্কসূত্র রাখার ব্যাপারে। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। আপনি চাইলেই পাকিস্তানের আকাশসীমা আবার খুলতে পারে।’ ভুট্টোর শেষ চেষ্টাটিও ব্যর্থ হয়। যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধু গৃহবন্দি ছিলেন, সেখান থেকে নিজে গাড়ি চালিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দেন ভুট্টো। বঙ্গবন্ধু চেয়েছিলেন রেডক্রসের একটি বিমানে নিরপেক্ষ কোনো দেশে পৌঁছতে। সেখান থেকে তিনি নিজের মানুষদের কাছে পৌঁছবেন। শেষ পর্যন্ত রেডক্রসের বিমান সংস্থান করতে পারেননি ভুট্টো। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সম্মতিতেই তাঁর লন্ডনযাত্রার ব্যবস্থা করেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল ইরান কিংবা তুরস্ক যাওয়ার। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। লন্ডনের প্রস্তাবটি তিনি গ্রহণ করেন। চাকলালা বিমানবন্দর ছিল নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা। আর বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছার পর ভুট্টো গণমাধ্যমের কাছে প্রকাশ করেন যে মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং তিনি এখন লন্ডনে। এটি ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রস্থানের ১০ ঘণ্টা পর। বিমানে বঙ্গবন্ধুর সহযাত্রী ছিলেন ড. কামাল হোসেন এবং তাঁর পরিবার। আরও ছিলেন পাকিস্তানের বিমানবাহিনী এবং বিমান চলাচল দপ্তরের কয়েকজন কর্মকর্তা। লন্ডনের হিথ্রো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু পৌঁছেন ৮ জানুয়ারি ভোরে। লন্ডনে বঙ্গবন্ধুর আগমন সংবাদ ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ পান বঙ্গবন্ধুর বিমান অবতরণের এক ঘণ্টা আগে। হইচই পড়ে যায় ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের সাউথ এশিয়ান ডেস্কে। তারা সিদ্ধান্ত নেন যে বঙ্গবন্ধুকে পূর্ণ রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দেওয়া হবে। বিমানবন্দরে দৌড়ে যান সাউথ এশিয়া ডেস্কের সচিব স্যার ইয়ান সাদারলেন্ড। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাঁর অবকাশ বাতিল করে ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ফিরে আসেন। ৮ জানুয়ারি সকাল ৭টায় বিবিসি ওয়ার্ল্ড সার্ভিসে প্রচারিত খবরে বলা হয়: ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমানে লন্ডনে আসছেন।’ বিমানবন্দরে অবতরণ করার পর ব্রিটিশ সরকার বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রীয় অতিথির মর্যাদা দেয়। বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজেস হোটেল থেকে টেলিফোনে কথা বলেন ঢাকায় তাঁর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে, বিশেষ করে শিশু রাসেল, তাঁর রাজনৈতিক সহচর এবং প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ইতোমধ্যে গণমাধ্যম মারফত জানতে পেরে হোটেল এবং আশপাশের রাস্তায় মানুষের ঢল নামে। বিলেতের বাঙালি কমিউনিটির লোকজন প্রিয় নেতাকে একবার দেখতে চায়, তারা বঙ্গবন্ধুর ‘আমার মানুষেরা’। বঙ্গবন্ধু হোটেলের বারান্দায় এসে তাদের দিকে হাত নাড়েনÑ এক সূর্যমাখা হাত, নিজের মানুষের জন্য ভালোবাসামাখা হাত। বঙ্গবন্ধু ক্ল্যারিজেস হোটেলে প্রেস কনফারেন্সে গণমাধ্যমের সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। সাংবাদিকদের তিনি জানান, তিনি জীবিত এবং সুস্থ আছেন। তিনি আরও জানান যে, তাঁর জনগণ যে মহাকাব্যিক স্বাধীনতাযুদ্ধের মাধ্যমে মুক্তি অর্জন করেছে, এর বাঁধভাঙা আনন্দ তিনি সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করতে পেরে খুব ভালো অনুভব করছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ এবং লেবার দলীয় বিরোধী দলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের কথাও সাংবাদিকদের জানান। বঙ্গবন্ধু প্রেস কনফারেন্সের আগেই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে তাঁর কার্যালয়ে বৈঠক করেন। বাংলাদেশের স্বীকৃতি আর বিবিধ সহযোগিতা নিয়ে কথা বলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্কসূত্র রাখার কোনো সম্ভাবনা নেই বলে প্রধানমন্ত্রী হিথকে সাফ জানিয়ে দেন বঙ্গবন্ধু। চলবে…
লেখক- গবেষক