সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
শিক্ষা মানুষের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের উপায়, সুনাগরিক গড়ে তোলার মাধ্যম। বাংলাদেশে আদতেই কোনও শিক্ষা আছে কিনা সে নিয়েই এখন ভাবতে হচ্ছে। মুন্সিগঞ্জের হৃদয় মন্ডলের ঘটনা মিইয়ে না যেতেই নড়াইলে কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরিয়ে দিয়েছে এক শ্রেণির উন্মাদ এবং সেটা ঘটেছে পুলিশ এবং প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই। এ নিয়ে যখন আলোচনা তখন ঢাকার আশুলিয়ার হাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে পিটিয়ে হত্যা করেছে তারই ছাত্র। এবং এটাই শেষ নয়, এদিনই জানা গেলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের ইমেরিটাস অধ্যাপক, খ্যাতিমান পদার্থ বিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অরুণ কুমার বসাকের বাড়ি দখল করে রেখেছে এক প্রতিবেশী।
দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষার মান ক্রমহ্রাসমান। কেউ কেউ বলছেন সাধারণভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার মেরুদণ্ডটাই ভেঙে পড়েছে। তাই শিক্ষা আছে, এ কথা বলা চলে কিনা, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। আছে কেবল শিক্ষা নিয়ে ব্যবসা। তাই ধর্মীয় উন্মাদনায় পড়ুয়ারা যখন বিজ্ঞান শিক্ষকের শ্রেণিকক্ষের কথা রেকর্ড করে সেটা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করে, একই উন্মাদনায় শিক্ষকের গলায় জুতার মালা পরায় এবং প্রশাসনকে বলতে হয় এলাকার নিরাপত্তার স্বার্থে তাদের চুপ করে থাকতে হয়েছে, কিংবা বখাটে ছাত্র যখন পিটিয়ে শিক্ষক হত্যা করে তখন বেশি বিবেক জাগ্রত হয় না। আসলে শিক্ষা হত্যা হলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সকলেই মারা যায়।
এই ময়দানে কেউ মরে আর কেউ মারে। সামাজিক বিকাশের জন্য শিক্ষার মূল্য যে প্রচুর, অর্থাৎ ব্যক্তি শিক্ষিত হলে যে কেবল ব্যক্তির উন্নতির সম্ভাবনাই বাড়ে না, সমাজের সামগ্রিক উন্নতির পথও প্রশস্ত হয়, সেটা তো কার্যত আমরা ভুলতে বসেছি অনেকদিন ধরেই। আমাদের রাজনীতি, আমাদের নাগরিক সমাজ এখন শিক্ষাকে তার সত্যমূল্য দেয় না। বড় বড় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে ঠিকই, এসবের বড় বড় ভবন দেখে যারপরনাই মুগ্ধও আমরা। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ নানা প্রকার অশিক্ষার তুমুল উদযাপনে। সর্বত্র এক অন্যরকম আড়ম্বর আর তার পাশাপাশি বিরাজ করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেমেয়ের শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজের অপার ঔদাসীন্য। সেই
জায়গা দখলে নিয়েছে সমাজ বিরোধীরা, মৌলবাদী গোষ্ঠী যার পরিণতি উপরে বর্ণিত প্রতিটি ঘটনা। এসব ঘটনায় যতটা প্রতিক্রিয়া হওয়া প্রয়োজন ছিল হয়নি। গুটিকয়েক নাগরিক মানুষ কিছু কথা বলেছে, বাকি সবাই নিরাপদ দূরত্বে বসে হয় আফসোস করেছে বা নির্লিপ্ত থেকেছে।
যাদের হাতে ক্ষমতা আছে এবং যাদের গলায় জোর আছে, সেই বর্গের নাগরিকদের সন্তানরা দেশে-বিদেশে ভালোভাবে লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের কোনও ক্ষতিও হচ্ছে না। কিন্তু দেশের অধিকাংশ শিশু এবং কিশোর-কিশোরী যারা সেইসব বড় স্কুল বা কলেজে যেতে পারে না তাদের একটা বিরাট অংশের পড়াশোনা কার্যত শিকেয় উঠেছে, অনেকের ক্ষেত্রেই ভবিষ্যতে তা শিকে থেকে নামার সম্ভাবনা নেই। একটা গোটা প্রজন্মের সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে, অথচ সবাই নির্বিকার।
এখানেই বিশেষ দায় এবং দায়িত্ব সরকারের। হৃদয় মন্ডলের ঘটনায় সামাজিক আলোড়ন না হলে তিনি আর স্কুলে ফিরতে পারতেন না। নড়াইলের ঘটনায় রাষ্ট্রকে জেগে উঠতে হবে। দেখতে হবে এরা কারা যারা নির্দোষ একজন শিক্ষককে পুলিশ ও প্রশাসনের মানুষদের সামনে গলায় জুতার মালা পরাতে পারে। এই মালা কি শিক্ষকের গলায় উঠলো শুধু? এই বিবেচনায় ঘটনার সময় প্রতিটি পুলিশ সদস্য ও প্রশাসনের ব্যক্তিদের ভূমিকা যাচাই করে সাজা দিতে হবে। তবে বড় বার্তা দিতে যারা ঘটনা ঘটিয়েছে সেই ধর্ম ব্যবসায়ী সমাজবিরোধী চক্রকে বিচারের আওতায় এনে। একইভাবে অন্য ঘটনাগুলোরও বিচারিক সুরাহা করতে হবে। বারবার পার পেয়ে পেয়ে একটি মহল দেশের হৃদপিণ্ডে আঘাত হানছে একের পর এক এমন ঘটনার জন্ম দিয়ে।
সংখ্যাগরিষ্ঠ ছেলেমেয়েরা শিক্ষা লাভ করতে চায়, তারা শিক্ষকদের ভালোবাসে। তারা যাতে থেমে না যায়, তার আয়োজন করার দায় সরকারের। তারা সুযোগবঞ্চিত বলে, তাদের নিজস্ব সামর্থ্য ও সক্ষমতার অভাব আছে বলে
তারা অতি সাধারণ প্রতিষ্ঠানে পড়ে, কিন্তু তাদের পড়াটা যেন বন্ধ হয়ে না যায় এসব সমাজবিরোধীর পাল্লায় পড়ে। কী করে এই সর্বনাশের কবল থেকে ছেলেমেয়েদের বাঁচানো যায় তা নিয়ে শাসকদের যথার্থ উদ্যোগ দেখতে চাই আমরা। যেকোনও ভাবে পরীক্ষার একটা ফল প্রকাশ করে দেওয়া এবং ভর্তির ব্যবস্থা করা সেই আগ্রহের প্রমাণ হতে পারে না। স্কুল-কলেজ পরিচালনার নামে সমাজবিরোধীদের আড্ডা বন্ধ করতে হবে। অনেক কর্তাই মনে করেন শিক্ষকরা নেহাত অপদার্থ, শাসিয়ে চোখরাঙিয়ে না রাখলেই নয়। শিক্ষকদের অশেষ দোষত্রুটি। অবশ্যই অনেক অযোগ্য ও অপরাধপ্রবণ শিক্ষক আছেন। তবে, সেটা নিশ্চয়ই পুরো চিত্র নয়। আর হলেও সেটা রাজনীতি ও রাষ্ট্রের দায়। ভালো শিক্ষকদের পেশায় আকৃষ্ট করতে এবং তাদের প্রয়োজনীয় আবহ, রসদ, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা দিতে রাষ্ট্র উদ্যোগী না হলে কি চলে? আমরা কি যথেষ্ট ভাবছি বিষয়টি নিয়ে?