সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
নির্বাচনের ঘণ্টা ঠিকঠাক বাজার আগেই কেমন এক পরিবেশ যেন দেখছি আমরা। এর অনুষঙ্গ হিসেবে হাজির প্রাক-নির্বাচনি বাহাস ও বিতর্ক। কিন্তু তারচেয়েও বেশি দেখছে নির্বাচন কমিশনের নানা অবস্থান।
পরস্পরবিরোধী রাজনৈতিক তর্ক মানুষ দেখে অভ্যস্ত এবং সেটা মিডিয়ায় প্রচারও হয় নিয়মিত। কিন্তু জনগণের তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কথাবার্তায়। নির্বাচনের এখনও দুই বছর বাকি আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সিইসি এখনই খেই বা দিশা হারিয়ে ফেলছেন। সাংবিধানিক পদে থেকে তিনি যা বলছেন, সেটা মেলাতে পারছেন না অনেকেই। তাই জানতে ইচ্ছে করছে, জনাব হাবিবুল আউয়াল কি কোনও মনস্তাত্ত্বিক চাপে পড়েছেন কোনও দিক থেকে? প্রশ্ন এ কারণে যে তার কথায় অসংলগ্নতা ধরা পড়ছে প্রচুর। এ পদটি এমন যে তাঁর কথা ও কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁদের প্রতি সবার আস্থা তৈরি হবে। কিন্তু মনে হচ্ছে তিনি নিজেই আস্থার সংকটে ভুগছেন। শুরুর দিকে যে কঠোরতা ছিল তাঁর কণ্ঠে সেটাও যেন অনেকটা লোপ পেয়েছে।
জাতীয় নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের সংলাপের প্রথম দিন ছিল গত রবিবার। এদিন জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের (এনডিএম) সঙ্গে সংলাপের সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, ‘সব দল সহযোগিতা না করলে আমরা সেখানে ব্যর্থ হয়ে যাবো। আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করবো?’ সিইসির এমন বক্তব্যে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে।
যদিও সিইসি পরে এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, তিনি কৌতুক করেছেন, কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া হয়েছে ব্যাপক। অনেকেই বলতে শুরু করেছেন তার বক্তব্য প্রমাণ করে নির্বাচন কমিশন আগামী নির্বাচন শক্তহাতে পরিচালনা করতে পারবে না।
বাংলাদেশে নির্বাচন সবসময়ই যথেষ্ট চাপ এবং উদ্বেগের। ঐতিহাসিকভাবে বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনি হিংসার শিকার। হিংসা-বিধ্বস্ত অঞ্চলে ভোটাররা ভোট দিতে আগ্রহী হন কম। গত দুইবারের ভোট নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। গত কয়েক বছর ধরে লাগাতার সন্ত্রাস ও সহিংসতার শিকার হয়েছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা। সন্ত্রাসের শিকার হওয়া মানুষদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের উৎসাহ ও পরিমাণও কমে গেছে।
নির্বাচনি সন্ত্রাসের দীর্ঘকালীন প্রভাব গণতন্ত্রে যেন না পড়ে সে জন্য মানুষ চেয়ে আছে আগামী সংসদ নির্বাচনের দিকে। দায়িত্ব নেওয়ার সময় বেশ আশার কথাও শুনিয়েছিলেন জনাব আউয়াল। তার আগের হুদা কমিশন দৃশ্যমান যে ভাবমূর্তির সংকটে ছিল, সবার প্রত্যাশা আউয়াল কমিশন সেখান থেকে দূরে থাকবে এবং একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও আস্থা সৃষ্টিতে সক্ষম হবে। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম কিছু দিন সে চেষ্টাও দৃশ্যমান ছিল।
কিন্তু সময় যত যাচ্ছে ততই যেন সিস্টেমের ওপর তার নিয়ন্ত্রণ আলগা হয়ে পড়ছে। তাই কথাও বের হচ্ছে সে রকম। নির্বাচনের মাঠে কেউ তলোয়ার নিয়ে এলে তাকে মোকাবিলায় বন্দুক নিয়ে দাঁড়ানোর পরামর্শ কৌতুক ছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। চরম হতাশা প্রকাশ করে তিনি বলেছেন, ‘আজকে যদি বিদায় হতে পারতাম, ভালো লাগতো।’ এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘নির্বাচন তো যুদ্ধও। যেমন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি মাঠ ছেড়ে পালাননি। এমনিভাবে দলগুলোকেও মাঠে থাকতে হবে। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো দায়িত্ব পালনের’। এ কথাও নিয়েও বেশ শোরগোল হয়েছিল।
সিইসি বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছেন বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় সব দলকে নির্বাচনে আনা বড় চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে এখন পর্যন্ত বিএনপির মনোভাব খুবই নেতিবাচক। আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ, রিটার্নিং কর্মকর্তা কে হবেন- ডিসি না জেলা নির্বাচন অফিসার? এসব সিদ্ধান্ত বড় ধরনের জটিলতায় ফেলবে কমিশনকে। তাই এখনই শক্তহাতে সিস্টেমের নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারলে সমস্যা হবে। ইভিএম মেশিনে ভোটগ্রহণ নিয়েও মতপার্থক্য সহসা দূর হবে বলে মনে হচ্ছে না।
হাবিবুল আউয়ালের কথায় মনে হচ্ছে কোনও না কোনও জায়গা থেকে তিনি এক প্রকার চাপ অনুভব করছেন। এবং সে কারণে তার কথা বারবার বদলে যাচ্ছে। সাংবিধানিক দায়িত্ব যেহেতু নিয়েছেন তাই ভয় না পেয়ে দায়িত্বে অটল থাকাই শ্রেয় বলে মনে করি। গত মাসে এক সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘আমাদের সৎভাবে দায়িত্ব পালনের স্পৃহা ও চেষ্টা আছে, থাকবে। ব্যাপক অনিয়মের তথ্য আমাদের কাছে এলে, সাহস নয়, আমাদের দায়িত্ব হয়ে যাবে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেওয়ার। অনেক বিধান আমাদের অনুকূলে থাকলেও তা প্রয়োগের হার বাড়াতে হবে’।
এ কথাগুলো গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনকে হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে যা যা করতে হয়, তার সব করার একটা প্রচেষ্টা জনগণের কাছে দৃশ্যমান হতে হবে। মানুষ এখন ভোট দিতে যেতে চায় না। তাই বর্তমান কমিশনের সামনে আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ মানুষ যেন ভোট দানে আগ্রহী হয় এবং গেলে যেন প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ভোটাররা নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পারেন তা নিশ্চিত করা। সবচেয়ে বড় কথা, একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করতে নির্বাচন কমিশনের হাতে যে ক্ষমতা দেওয়া আছে সেটা প্রয়োগে তিনি যেন পিছপা না হন।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন