জাকির হোসেন
পঁচাত্তরে পাকিস্তান-মার্কিন চক্র বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার যে ‘ব্লুপ্রিন্ট’ তৈরি করেছিল, এর বাইরে ছিলেন না তাঁর দুই কন্যা শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। ওই সময় তারা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান। ওইদিন তারা ঘাতকদের হাত থেকে রেহাই পেলেও বিদেশে তাদের হত্যা করতে চক্রান্তকারীদের ‘প্ল্যানিং সেল’ ছিল বেশ তৎপর। কিন্তু ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী দ্রুত পাল্টা ব্যবস্থা নেওয়ায় তাদের সেই মিশন সফল হয়নি। শ্রীমতী গান্ধীর নির্দেশনা মোতাবেক নির্বাসিত জীবনেও শেখ হাসিনাকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে চলতে হয়েছে। ফলে সব হারানোর বেদনা, আর্থিক অনটন, নিঃসঙ্গতা, দেশ ও দেশের মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকার বঞ্চনাসহ নানা অস্বস্তি ও বিড়ম্বনার মধ্যে কেটেছে তার নির্বাসিত জীবন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় শেখ হাসিনা প্রায় ছয় বছর স্বামী, সন্তান ও ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে নয়াদিল্লিতে কাটান।
এম ওয়াজেদ মিয়ার গবেষণার কারণে পঁচাত্তরের ৩০ জুলাই জার্মানিতে যান শেখ হাসিনা, তার সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও সেখানে যান বেড়াতে। ১৫ আগস্ট তারা সবাই ছিলেন বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সানাউল হকের বাসায়। এদিন সকালে তাদের প্যারিস যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আগের দিন (১৪ আগস্ট) গাড়ির দরজায় ড. ওয়াজেদ মিয়ার হাতে চাপা লাগে। ফলে তারা ওই অবস্থায় প্যারিসে যাবেন কি না এ নিয়ে ভাবছিলেন। ১৫ আগস্ট ভোর ৬টার দিকে ওয়াজেদ মিয়ার ঘুম ভাঙে সানাউল হকের স্ত্রীর ডাকে। জার্মানির বন থেকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ফোন করেছেন, তিনি জরুরি কথা বলতে চান ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলার জন্য ওয়াজেদ মিয়া স্ত্রী শেখ হাসিনাকে পাঠিয়ে দেন। কিছুক্ষণ পর শেখ হাসিনা ফিরে এসে জানান, হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান। এতে শেখ হাসিনাকে ভীষণ চিন্তিত এবং উৎকণ্ঠিত হন। টেলিফোন ধরতে ওয়াজেদ মিয়া দ্রুত নিচে নামেন। তখন সেখানে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত অবস্থায় মাথা নিচু করে পায়চারি করছেন সানাউল হক। ওয়াজেদ মিয়া ফোন ধরতেই অপর প্রান্ত থেকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী বলেন, ‘আজ ভোরে বাংলাদেশে ক্যু-দে-টা হয়ে গেছে। আপনারা প্যারিস যাবেন না। রেহানা ও হাসিনাকে এ কথা জানাবেন না। যত দ্রুত সম্ভব আপনারা সবাই আমার এখানে চলে আসুন।’
সানাউল হক যখন শুনলেন ঢাকায় সেনা বিদ্রোহ হয়েছে এবং বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন, সেই মুহূর্ত থেকেই তিনি তিনি শেখ হাসিনা, রেহানা এবং ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে বৈরী আচরণ শুরু করেন এবং কোনো প্রকার সহযোগিতা করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি সবাইকে যত দ্রুত সম্ভব বাসা থেকে চলে যেতে বলেন। বাসা থেকে বের হওয়ার জন্য গাড়িটা পর্যন্ত দিতে অস্বীকৃতি জানান। যদিও এই সানাউল হককে বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক বিবেচনায় বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন।
হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর ওয়াজেদ মিয়া যখন বাসার ওপরে যান তখন শেখ হাসিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওয়াজেদ মিয়ার কাছে জানতে চান রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে। ওয়াজেদ মিয়া জানান, রাষ্ট্রদূত চৌধুরী তাদের প্যারিস যাত্রা বাতিল করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জার্মানির বনে ফিরে যেতে বলেছেন। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা- দুজনই কাঁদতে কাঁদতে বলেন, নিশ্চয়ই কোনো দুঃসংবাদ আছে, যেটি ওয়াজেদ মিয়া তাদেরকে বলতে চাইছেন না। আর তখন তারা দুজন বলেন, প্যারিসের যাত্রা বাতিল করার কারণ পরিষ্কারভাবে না বললে তারা বাসা ছেড়ে অন্য কোথাও যাবেন না। বাধ্য হয়ে ওয়াজেদ মিয়া বলেন, ‘বাংলাদেশে কী একটা মারাত্মক ঘটনা ঘটে গেছে, এজন্য আমাদের প্যারিস যাওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না।’ এ কথা শুনে তারা দুই বোন কান্নায় ভেঙে পড়েন। তাদের কান্নার শব্দে জয় ও পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তারা ব্রাসেলস ছেড়ে জার্মানির বনের উদ্দেশে রওনা হন। বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাসায় গিয়ে পৌঁছান। বিকালে ড্রইংরুমে বসে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী এবং ওয়াজেদ মিয়া উৎকণ্ঠিত অবস্থায় বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও অন্যান্য রেডিও স্টেশন থেকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের চেষ্টা করেন।
এরই এক ফাঁকে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে ঘরের বাইরে নিয়ে ওয়াজেদ মিয়া ঘটনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান। নিরাপদ স্থানে না পৌঁছানো পর্যন্ত শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানাকে কোনো কিছু জানানো হবে না, এই শর্তে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ‘বিবিসির এক ভাষ্যানুসারে রাসেল ও বেগম মুজিব ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই এবং ঢাকাস্থ ব্রিটিশ মিশন কর্তৃক প্রচারিত এক বিবরণীতে বলা হয়েছে যে, বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কেউ বেঁচে নেই।’
ওইদিন বিকালেই জার্মান গণমাধ্যম ‘ডয়েচে ভেলে’রসহ কয়েক জার্মান সাংবাদিক হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর বাসায় যান তাদের মন্তব্য নেওয়ার জন্য। শেখ হাসিনা ও রেহানা মানসিকভাবে এতটাই বিধ্বস্ত ছিলেন যে, তারা কেউই কোনো মন্তব্য করতে চাননি, কারও সঙ্গে কোনো কথাও বলেননি। তবে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী সাংবাদিকদের এটা নিশ্চিত করেন যে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা তার কাছেই আছে। এরইমধ্যে যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মার্শাল টিটো বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা ও ওয়াজেদ মিয়ার খোঁজখবর নিতে ফোন করেন। কিন্তু এই জটিল পরিস্থিতিতে তারা এখন কোথায় থাকবেন, সেই সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলেন না। এ অবস্থায় হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী মনে করেন, একমাত্র ভারতে আশ্রয় নেওয়াটা তাদের জন্য নিরাপদ। ১৬ আগস্ট রাত ১১টার দিকে তিনি এবং তার স্ত্রী ওয়াজেদ মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে যান। উদ্দেশ্য ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তার সঙ্গে ওয়াজেদ মিয়াকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া।
নির্ধারিত স্থানে ভারতীয় দূতাবাসের সেই কর্মকর্তার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ও তার স্ত্রী সেখান থেকে চলে যান। তখন ভারতীয় দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরীর বাসায় নিয়ে যান। আলোচনার এক পর্যায়ে ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াজেদ মিয়াকে বলেন, ভারত সরকারের কাছে তারা ঠিক কী চান, সেটি লিখে দিতে। এ কথা বলে তিনি একটি সাদা কাগজ ও কলম ওয়াজেদ মিয়ার দিকে এগিয়ে দেন। সেই কাগজে ওয়াজেদ মিয়া যা লিখেছিলেন সেটি ছিল এ রকম, ‘শ্যালিকা রেহানা, স্ত্রী হাসিনা, শিশু ছেলে জয়, শিশু মেয়ে পুতুল এবং আমার নিজের কেবলমাত্র ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং প্রাণরক্ষার জন্য ভারত সরকারের নিকট রাজনৈতিক আশ্রয় কামনা করি।’
সেই কঠিন সময়ে ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানার হাতে কোনো টাকা-পয়সা ছিল না। শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দুজনেই ২৫ ডলার সঙ্গে নিয়ে দেশ থেকে এসেছিলেন। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ওয়াজেদ মিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তাদের কোনো টাকা-পয়সা লাগবে কি না? শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলে ওয়াজেদ মিয়া জানান, হাজারখানেক জার্মান মুদ্রা দিলেই তারা মোটামুটি চালিয়ে নিতে পারবেন। ১৮ আগস্ট বন শহর থেকে ৩৫০ কিলোমিটার দূরে কার্লসরুয়ে শহরে যান ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা। সেখানে গবেষণা সংক্রান্ত কিছু কাগজ এবং বই ছিল ওয়াজেদ মিয়ার। এছাড়া আরও কিছু কাজ সম্পন্ন করার প্রয়োজন ছিল। এরপর এক কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে পশ্চিম জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরীর সঙ্গে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর দেখা হয়। তিনি ওয়াই কে পুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে ভারত শেখ হাসিনা আর তার পরিবারকে রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে পারবে কি না? ওয়াই কে পুরী জানান, তিনি খোঁজ নিয়ে জানাবেন। পরের দিন ওয়াই কে পুরী নিজেই হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করতে তার দফতরেই চলে আসেন। তিনি জানান, ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়াটা অনেক সময় নেয়। ফলে তিনি ইন্দিরা গান্ধী এবং তার দুই পরামর্শদাতা ডিপি ধর এবং পিএন হাক্সের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন। কেননা দিল্লিতে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীর অনেক চেনাশোনা আছে, আর মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে সেখানে তিনি মিশনপ্রধান ছিলেন। ওয়াই কে পুরীর সামনেই হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী ডিপি ধর এবং পিএস হাক্সরকে ফোন করেন। কিন্তু দুজনেই সে সময়ে ভারতের বাইরে ছিলেন। সরাসরি ইন্দিরা গান্ধীকে ফোন করতে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী একটু ইতস্তত বোধ করছিলেন। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী একটি দেশের প্রধানমন্ত্রী আর হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী একজন সাধারণ রাষ্ট্রদূত। শ্রীমতী গান্ধীর সঙ্গে তার কয়েকবার সাক্ষাৎ হয়েছে ঠিকই। কিন্তু বছরতিনেক তাদের মধ্যে কোনো যোগাযোগ নেই। রাজনীতিতে তিন বছর অনেকটা লম্বা সময়। এর ওপর তখন ভারতে জরুরি অবস্থা চলছে, শ্রীমতী গান্ধী নিজেই একটা দুরবস্থার মধ্যে রয়েছেন। যখন কোনো দিক থেকেই কিছু হচ্ছিল না, তখন শেষ চেষ্টা হিসেবে হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী একদিন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দফতরে ফোন করেন। তাকে ওই নম্বরটা দিয়েছিলেন ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরী। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী আশা করেননি যে ফোনটা টেলিফোন অপারেটরের পরে অন্য কারও কাছে যাবে! কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে সেই ফোনটা শ্রীমতী গান্ধী নিজেই ধরেন। হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী গোটা বিষয়টা ইন্দিরা গান্ধীকে খুলে বলেন। তখনই তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যাদের রাজনৈতিক আশ্রয় দিতে রাজি হন। জার্মানিতে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত ওয়াই কে পুরী ১৯ আগস্ট হুমায়ূন রশীদ চৌধুরীকে জানান, দিল্লি থেকে নির্দেশ এসেছে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা এবং তাদের পরিবারকে সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। ২৩ আগস্ট সকালে ভারতীয় দূতাবাসের এক কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়াকে টেলিফোন করে জানান, ভারতীয় দূতাবাসের একজন ফার্স্ট সেক্রেটারি কার্লসরুয়েতে তাদের সঙ্গে দেখা করবেন। সেদিন দুপুর ২টার দিকে ওই কর্মকর্তা ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে দেখা করে বলেন, পরের দিন অর্থাৎ ২৪ আগস্ট সকাল ৯টায় তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় দূতাবাসের ওই কর্মকর্তা ২৪ আগস্ট তাদের ফ্রাঙ্কফুর্ট বিমানবন্দরে নিয়ে যান। তবে তাদের গন্তব্যের বিষয়টি সম্পূর্ণ গোপন রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে ২৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ৮টার দিকে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছান শেখ রেহানা, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া এবং তাদের দুই সন্তান জয় ও পুতুল। বিমানবন্দরে নামার পর তাদের প্রায় ৪ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়। মন্ত্রিপরিষদের একজন যুগ্ম সচিব তাদের স্বাগত জানান। তাদের প্রথমে ৫৬ নম্বর রিং রোডের একটি ‘সেফ হাউস’-এ রাখা হয়। পরে ডিফেন্স কলোনির একটি বাড়িতে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ওই বাসায় ছিল একটি ড্রইং-কাম-ডাইনিং রুম এবং দুটি বেডরুম। ওই বাড়ির বাইরে না যাওয়া, সেখানকার কারও কাছে তাদের পরিচয় না দেওয়া এবং দিল্লির কারও সঙ্গে যোগাযোগ না রাখা- ভারতের কর্মকর্তারা তাদের এই তিনটি পরামর্শ দেন। জরুরি অবস্থার কারণে বাংলাদেশ সম্পর্কে তেমন কোনো খবরাখবর ভারতের পত্রিকায় ছাপা হচ্ছে না। কাজেই তখন বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিলেন ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা।
১০ দিন পরে, ৪ সেপ্টেম্বর, ভারতের গুপ্তচর সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস উইং বা ‘র’-এর একজন কর্মকর্তা তাদের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বাসায় (১ নম্বর সফদর জং রোড) পৌঁছান। ইন্দিরা গান্ধীকে শেখ হাসিনা জিজ্ঞাসা করেন, ‘১৫ আগস্ট ঠিক কী হয়েছিল?’ সেখানে উপস্থিত একজন অফিসার শেখ হাসিনাকে বলেন, তার পরিবারের আর কেউ জীবিত নেই। এটা শুনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন শেখ হাসিনা।
ইন্দিরা গান্ধী হাসিনাকে জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। শ্রীমতী গান্ধী বলেন, ‘তোমার যা ক্ষতি হয়েছে, তা তো পূরণ করা যাবে না। তোমার তো এক ছেলে, এক মেয়ে আছে। আজ থেকে ছেলেকে নিজের বাবা আর মেয়েকে নিজের মা বলে মনে কোরো।’ অনেকেরই ধারণা শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থানকালে ওই একবারই ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তবে ‘র’-এর অফিসারদের কথা অনুযায়ী শেখ হাসিনা আর ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আরও কয়েকবার দেখা হয়েছে। প্রথম সাক্ষাতের দিনদশেক পরে শেখ হাসিনাকে ইন্ডিয়া গেটের কাছে পান্ডারা পার্কের ‘সি’ ব্লকে একটি ফ্ল্যাট দেওয়া হয়। ওই ফ্ল্যাটে তিনটি শোয়ার ঘর আর কিছু আসবাব ছিল। পরে তিনি নিজেই কিছু কিছু আসবাব কিনেছিলেন। শেখ হাসিনার ওপর কড়া নির্দেশ ছিল যে তিনি যেন ঘরের বাইরে না যান, অথবা কারও সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করেন। তার মনোরঞ্জনের জন্য একটা টেলিভিশন সেটও দেওয়া হয়। সেই সময়ে ভারতের টেলিভিশনে শুধু দুই ঘণ্টার জন্য দূরদর্শনের অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো।
‘র’-এর একজন প্রাক্তন অফিসারের ভাষ্যমতে, “শেখ হাসিনার নিরাপত্তার জন্য দুজনকে রাখা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন ছিলেন সত্য ঘোষ নামের এক ইন্সপেক্টর। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তাকে নিয়ে আসা হয়েছিল। অন্যজন ছিলেন ১৯৫০ সালের ব্যাচের ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস অফিসার পিকে সেন। ঘটনাচক্রে ইন্সপেক্টর সেনকে ‘কর্নেল’ হিসেবে, আর পদাধিকারবলে তার থেকে অনেক উঁচুতে, আইজি র্যাঙ্কের অফিসার পিকে সেনকে ‘ইন্সপেক্টর’ হিসেবে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার দায়িত্বে রাখা হয়। এই দুজন অফিসারই ছায়ার মতো শেখ হাসিনার নিরাপত্তার বিষয়টি দেখতেন।” ‘র’-ওই প্রাক্তন কর্মকর্তার ভাষ্যমতে, ‘শেখ হাসিনার সব খরচ ভারত সরকারই দিত। যদিও সেটা খুব সামান্যই ছিল। টাকাটা কলকাতায় তার এক পরিচিত চিত্তরঞ্জন সুতারের মাধ্যমে দেওয়া হতো। চেষ্টা করা হয়েছিল শেখ হাসিনা যে দিল্লিতে আছেন, সেই খবরটা যেন কেউ না জানতে পারে। তবে বাংলাদেশের সরকার তার অবস্থান জেনে গিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের মে মাসের গোড়ার দিকে বাংলাদেশের উপ-রাষ্ট্রদূত শামসুর রহমান আর তার স্ত্রী দেখা করতে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা আর শেখ রেহানার সঙ্গে। দুই বোন তাদের জড়িয়ে ধরে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিলেন।’
ছিয়াত্তরে শেখ রেহানার এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির জন্য তার পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭৬ সালের জুলাই মাসে শান্তিনিকেতনে তার ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে হয়। ১৯৭৬ সালের ২৪ জুলাই শেখ রেহানার বিয়ে হয় লন্ডন-প্রবাসী শফিক সিদ্দিকের সঙ্গে। কিন্তু শেখ হাসিনা এবং তার স্বামী ওই বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেননি।
শেখ হাসিনার নির্বাসিত জীবনে ইন্দিরা গান্ধী সরকারের মন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং তার পরিবার শেখ হাসিনার পরিবারের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন। জয় এবং পুতুলকে মাঝে মাঝেই প্রণব মুখার্জির সরকারি বাসভবনে খেলতে দেখা যেত। নিজের বই ‘ড্রামাটিক ডিকেড’-এ প্রণব মুখার্জি স্মৃতিচারণ করেছেন যে, দুটি পরিবারের মধ্যে মাঝে মাঝে শুধু দেখাই হতো না, দিল্লির বাইরে পিকনিকেও যাওয়া হতো। এরইমধ্যে ১৯৭৭ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী হেরে যান। নতুন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই ‘র’-এর কাজকর্মে খুব একটা আগ্রহ দেখাতেন না। রেহানাকে দিল্লিতে নিয়ে আসার ব্যাপারে কথা বলার জন্য শেখ হাসিনা এবং ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া ১৯৭৭ সালে মোরারজী দেশাইয়ের সঙ্গে দেখা করেন। মোরারজী দেশাই রেহানাকে দিল্লি নিয়ে আসার ব্যবস্থা করে দেন। রেহানা ১৯৭৭ সালের ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লি আসেন। পান্ডারা পার্কের ফ্ল্যাটে শেখ হাসিনার সঙ্গেই ছিলেন। তবে ধীরে ধীরে শেখ হাসিনার নিরাপত্তার ব্যবস্থা থেকে হাত গোটাতে শুরু করেন মোরারজী দেশাই। সেইসঙ্গে ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া ও শেখ হাসিনার ওপরে একরকম চাপ তৈরি করা হয়, যাতে তারা নিজেরাই ভারত ছেড়ে চলে যান। প্রথমে তাদের ফ্ল্যাটের বিদ্যুৎ বিল দেওয়া বন্ধ করা হয়। তারপর গাড়ির ব্যবস্থাও তুলে নেওয়া হয়। ডক্টর ওয়াজেদ নিজের ফেলোশিপটা এক বছর বাড়ানোর আবেদন করেন। প্রায় তিন মাস এর কোনো জবাব আসেনি। সে কারণে তাকে বেশ আর্থিক সমস্যায়ও পড়তে হয়। শেষমেশ মোরারজী দেশাই অবশ্য ঠিক এক বছরের জন্য তার ফেলোশিপ বাড়ানোর অনুমতি দেন। তবে ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে ইন্দিরা গান্ধী আবার ক্ষমতায় ফিরে আসেন। সেইসঙ্গে শেষ হয় শেখ হাসিনার সব দুশ্চিন্তা। ওই বছর আওয়ামী লীগের বেশ কয়েক নেতা শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করতে দিল্লিতে যান, অনুরোধ করেন তাকে ঢাকায় ফিরে আসার জন্য। ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া অবশ্য চাইছিলেন না যে, শেখ হাসিনা ঢাকা ফিরে আসুক। তিনি মনে করতেন শেখ হাসিনার সরাসরি রাজনীতিতে আসা উচিত নয়।
তবে শেষমেশ ১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনাকে নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ও কোরবান আলী ঢাকা আসেন। ঢাকা বিমানবন্দরে প্রায় ১৫ লাখ মানুষ তাকে স্বাগত জানাতে সেদিন হাজির হন। পরের বছর ১৯৮২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডক্টর ওয়াজেদ মিয়া বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনে যোগ দেওয়ার আবেদন জানান। মহাখালীতে দুই কামরার একটা ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেছিল পরমাণু শক্তি কমিশন। শেখ হাসিনা সেই ফ্ল্যাটেই স্বামীর সঙ্গে থাকতেন।
তথ্যসূত্র :
প্রামাণ্য চলচ্চিত্র এ ডটার’স টেল
জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য, ৭ জুন ২০১৭
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও
বাংলাদেশ : এমএ ওয়াজেদ মিয়া
লেখক- সাংবাদিক