সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) খন্দকার লাবণি আক্তার আত্মহত্যা করেছেন। একই দিন তার সাবেক দেহরক্ষী মাহমুদুল হাসান মাগুরা পুলিশ লাইন্স ব্যারাকের তিনতলা ছাদে পুলিশের পোশাকে নিজের মাথায় সরকারি অস্ত্র দিয়ে গুলি করে আত্মহত্যা করেন। আরও কয়েকটি খবর এমন– মোটরসাইকেল না পেয়ে কিশোরের আত্মহত্যা, স্ত্রীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডা, তাই যুবকের আত্মহত্যা, বখাটেদের উৎপাতে কিশোরীর আত্মহত্যা।
প্রতিদিনই আত্মহননের খবরের আসে গণমাধ্যমে। এবং এমন একটা অবস্থা হয়েছে যেন এগুলো স্বাভাবিক মৃত্যু। কিন্তু এগুলো তো স্বাভাবিক নয়। আত্মহত্যা মানে নিজেকে শেষ করে দেওয়া। বিশিষ্টজন বা সাধারণ মানুষ — আত্মহনন যেই করুক সেটি সমাজের পক্ষে এক মর্মান্তিক বিয়োগান্তক অভিঘাত। পরিবার, পরিজন ও প্রতিবেশী— এই বিপর্যয়ের ক্ষত কখনও কাটিয়ে উঠতে পারে না। আত্মহত্যার প্রবণতা এ সমাজে আছে। কিন্তু ধারণা করছি এখন অনেক বেশি মানুষ আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে নিজেদের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে চলেছেন। প্রতিটি আত্মহত্যার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক ব্যর্থতার প্রয়াস। তারা বেঁচে থাকেন এই প্রয়াসজনিত শারীরিক ও মানসিক আঘাত অথবা পঙ্গুত্বকে নিয়ে।
এত বেশি আত্মহত্যার ঘটনা কেন ঘটছে তার স্বরূপ ও কারণ চিহ্নিত করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। কারণ, আত্মহত্যা করে যিনি জীবনের অপচয় ঘটান সেই সমাজবদ্ধ মানুষটি আত্মহত্যায় দুঃখভোগের শরিক হন তার আত্মীয়, পরিজন, বন্ধু, সহকর্মী, পরিচিত অনেকেই এবং ক্ষতির শিকার হয় এই সমাজ। আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে যেমন থাকে বিষাদ ও বেদনা, তেমনই তার কারণকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে অনেক প্রশ্নও। প্রশ্ন এমন – আমরা কী এমন এক সমাজ নির্মাণ করেছি যেখানে মানুষ বাঁচবার আশা ছেড়ে নিজেই নিজেকে জীবন থেকে সরিয়ে নিচ্ছে? বর্তমান বাংলাদেশে মানুষের অস্বাভাবিক মৃত্যুর ধরনগুলোর অন্যতম এই আত্মহত্যা। এই প্রবণতা কতটা সামাজিক ও মানুষের মনোজগতের সমস্যা, আর কতটা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি সে হিসাব করা দরকার। স্বাভাবিকভাবে বলা হয় পৃথিবীর সব আত্মহত্যার পেছনেই রয়েছে আত্মহত্যাকালীন ব্যক্তির বিষণ্নতা, নানা প্রকার বিকার, সিজোফ্রেনিয়া ধরনের অসুখ, মাদকাসক্তিসহ মানসিক অবসাদ। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় এই রোগগুলোর প্রতি এক ধরনের উপেক্ষা আছে আমাদের। পাগলের বদনাম জড়িয়ে থাকায় সংকোচের কারণে মানুষের এসব রোগের চিকিৎসা করতে সচেষ্ট-উৎসাহিত না হওয়াও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতি বছর আট লাখে বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে। অর্থাৎ সারা বিশ্বে প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন আত্মহত্যা করেন। বাংলাদেশে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে ২ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রতি বছরই এ হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন মানুষ আত্মহত্যা করছে। একটি লেখায় দেখলাম, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের বরাতে বলা হয়েছে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১০ হাজার ৭৪৯ জন।
২০১৭ ও ২০১৮ সালে দেশে আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে যথাক্রমে ১০ হাজার ২৫৬ ও ১১ হাজার। ২০১৯-২০ সময়কালে করোনার সময়ে বাংলাদেশে আত্মহত্যা করেছে ১৪ হাজার ৪৩৬ জন, যাদের মধ্যে ২০-৩৫ বয়সীরাই সবচেয়ে বেশি। স্বাভাবিক সময়ে মেয়েদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি হলেও এ সময়ে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের আত্মহত্যার পরিমাণ ছিল তিনগুণ। ডিএমপি সূত্রে আরও জানা যায়, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের ৩১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ঢাকায় আত্মহত্যাজনিত অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে ২ হাজার ১৬৬টি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সূত্রে জানা যায়, ২০২১ সালে ১১ হাজারের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করেছে। পুলিশ সদর দফতরের হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার মানুষ শুধু ফাঁসিতে ঝুলে ও বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করে। কয়েকটি নতুন প্রবণতা বেশ উদ্বেগের। গত ৪ জুলাই জাতীয় প্রেস ক্লাব এলাকায় জনসম্মুখে নিজের গায়ে আগুন দিয়ে এক ব্যবসায়ীর আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। পরে তিনি মারা গেছেন। আরেকটি মর্মান্তিক পন্থা হলো ফেসবুক লাইভে এসে আত্মহত্যা করা। ৬ জুলাই গণমাধ্যমে প্রকাশিত আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) কর্তৃক দেশের জাতীয় পত্রিকার তথ্যের ভিত্তিতে করা জরিপের সূত্রমতে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন সময়কালে দেশে হত্যা ও বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হওয়া ৮০৭ শিশুর মধ্যে হত্যা হয়েছে ১৫২ শিশু, আত্মহত্যা করেছে ২৬, লাশ উদ্ধার হয়েছে ৫৬, রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে ১৩ এবং বলাৎকারে ব্যর্থ হয়ে এক শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। দেশে বেকারত্ব বাড়ায় তরুণদের মধ্যে হতাশা বাড়ছে। যৌতুক ও নির্যাতনের কারণে নারীরা আত্মহত্যার পথে যাচ্ছে, পরীক্ষায় অকৃতকার্য বা আশানুরূপ ফল না করায় পারিবারিক তিরস্কারে অনেক কিশোর-কিশোরী আত্মহত্যা করছে, প্রাপ্তি ও প্রত্যাশার ব্যবধান এবং ধর্মান্ধতার কারণেও আত্মহত্যার দিকে তরুণ-তরুণীদের অধিকমাত্রায় ধাবিত করছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমরা এই প্রবণতা রুখতে চেষ্টা করছি কম। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ায় শিশুকাল থেকে বাস্তবতার কাঠিন্যে জীবন প্রবাহের অসঙ্গতিকে ধারণ করা বা খাপ খাইয়ে নেওয়ার শিক্ষা কৌশল চোখে পড়ছে না।
আত্মহত্যা নিবারণযোগ্য। প্রশাসনের, সমাজের এ ব্যাপারে সচেতন হওয়ার দরকার আছে। এখানে অভিভাবকদেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। প্রয়োজন আছে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিংয়েরও। শুধু সামাজিক সমস্যা হিসেবে না দেখে আত্মহত্যাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করা দরকার। সামাজিক সচেতনতা ও সহমর্মিতার। মানসিক স্বাস্থ্য এবং আত্মহত্যার ব্যাপারে সংস্কার কাটিয়ে এ ব্যাপারে খোলামেলা আলোচনার যেমন প্রয়োজন, তেমন প্রয়োজন চিকিৎসার জন্য এগিয়ে আসার। মনে রাখা দরকার, আত্মহত্যা আটকানো যায়।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন