জাফর ওয়াজেদ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার ষড়যন্ত্র নিরূপণে তদন্ত কমিশন করা হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবনের সবকিছু ত্যাগ করেছিলেন আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করতে। লক্ষ্যই ছিল বাঙালির স্বাধীনতা। সেজন্যই তিনি দলটিকে গড়ে তুলেছিলেন যুগোপযোগী করে। সময়ের সঙ্গে তালমিলিয়ে দলের খোলনলচেও বদল করেছেন। বাঙালিকে স্বাধীনতা এনে দেবেন, এই অভিপ্রায় থেকেই সংগঠন শক্তিশালী করতে কাজ করেছেন। কখনো সাইকেলে; কখনো হেঁটে, আবার নৌকায় চড়ে গ্রামগঞ্জে গিয়েছেন, নেতাকর্মীদের খোঁজখবর নিয়েছেন। শক্তিশালী সংগঠন ছিল বলেই দলকে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছিলেন ১৯৭১ সালে। এমনকি স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ে তুলতে পেরেছিলেন। তারও আগে মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষকে মোকাবিলা করেছেন সুকঠিনভাবে। সেই বঙ্গবন্ধুকে কী কারণে বা কেন হত্যা করা হয়েছিল, তার প্রকৃত ভাষ্য মেলে না। কিন্তু এটা প্রশ্নাতীত যে, বিদেশি ও দেশি শক্তিগুলো একত্রে কাজ করেই তবে নির্মমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। আওয়ামী লীগের একাংশ যেমন, তেমনি আরও রাজনৈতিক দল হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্র তৈরি ও ষড়যন্ত্রে জড়িত কিংবা সহায়ক ছিল।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক আলোকপাত করেছেন, জিয়া-মোশতাকের ভূমিকা ছিল এই হত্যাকাণ্ডে। তাঁর মতে, বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়াউর রহমানের প্রত্যক্ষ মদত ছিল। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে জিয়ার সব কর্মকাণ্ড বিশ্লেষণ করলে এটি পরিষ্কার যে, তিনি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। ছিলেন পাকিস্তানের ভাবাদর্শের একজন ব্যক্তি। তার আসল রূপ ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে। তাই বঙ্গবন্ধু হত্যায় জিয়া ও মোশতাকের ভূমিকা উদ্ঘাটনের জন্য তদন্ত কমিশন গঠন করা প্রয়োজন। বিচারপতির মতে, জিয়া ক্ষমতা গ্রহণের পরই দেশকে পাকিস্তানে পরিণত করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছিল। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণের স্থান এবং পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের জায়গা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে শিশু পার্কে পরিণত করেছিল স্বাধীনতার সব চিহ্ন মুছে ফেলার জন্য। এছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বাঁচানোর জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি এবং তাদের পুরস্কৃত করেছে। বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর পর্যবেক্ষণ স্পষ্ট করে, জিয়া-মোশতাক একই লক্ষ্যে কাজ করেছে এবং হত্যাকাণ্ডে
রাজনীতির একটা সম্পৃক্ততা ছিল। আর তা ছিল বলেই মোশতাক-জিয়াকে হত্যাকাণ্ডের পর প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়নি। তারা পাকিস্তানি ভাবাদর্শে যে লালিত, তা তাদের কর্মে পরিস্ফুটিত। মোশতাক যুদ্ধকালেই পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যে দূতিয়ালি করেছিলেন তাতে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশনের প্রস্তাব ছিল। শেখ মুজিবের মুক্তির বিনিময়ে তিনি এই প্রস্তাবে সম্মত ছিলেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান মুজিবনগর সরকারপ্রধানরা। মোশতাকের তৎপরতা তারপরও থেমে থাকেনি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও শেষ পর্যন্ত বলেছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা উদ্ঘাটনে কমিশন গঠন করা হবে, যা এদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের দাবি। শুধু সামরিক নয়, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রই এই হত্যার পথ উন্মোচন করেছে। কমিশন হলে পরিষ্কার হবে, জাতির পিতা হত্যায় কারা কারা জড়িত ছিল। তাদের চিহ্নিত করা না গেলে জাতিকে কলঙ্কের ভার আরও বহুকাল বয়ে যেতে হবে।
স্বাধীনতার পূর্বাপর রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে প্রমাণিত হয় যে, রাজনীতিকরা হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত ছিল। দেশ যখন ছিল ব্রিটিশ কিংবা পাকিস্তানি উপনিবেশ, তখন দেশের মানুষ সবাই ছিল স্বদেশ অন্তঃপ্রাণ। যেন দেশমাতৃকার যোগ্য সন্তান হতে পারে, এই কামনা, প্রার্থনা, বাসনা ছিল। আর ব্রিটিশরা দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর পাকিস্তানি উপনিবেশের শিকার বঙ্গদেশ হয়ে পড়ে হতশ্রী, দরিদ্র এবং পশ্চাৎপদ এক অঞ্চল। যুদ্ধ জয়ের মধ্য দিয়ে পাওয়া দেশকে আপন করে তোলার কাজটি তো আর সহজ ছিল না। বরং স্বাধীন স্বদেশ পেয়ে দেশটাকে নিকুচি করার কাজে লোকের কমতি ছিল না।
স্বাধীন হওয়ার আগে বলা হতো, দীন দুঃখিনী মা যে মোদের, এর বেশি তার সাধ্য নেই। কিন্তু স্বাধীনতার পর আর তর সয়নি। সমস্বরে যেন বলা হয়, তোমার সাধ্যে কুলোক আর না কুলোক, তোমার ভাঁড়ারে কিছু থাকুক বা না থাকুক, আমাদের দাবি আগেভাগে মিটিয়ে দিতে হবে। ‘জয় বাংলা’ ধ্বনির মর্যাদা ভুলে গিয়ে দেখা গেছে, ‘লুটেপুটে খাই খাই’ স্বভাবটা সামনে এসে হাজির হয়েছে কারও কারও। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটা যে গড়ে তুলতে হবে এবং এই তোলার মধ্যেই যে রয়েছে স্বাধীনতার মাহাত্ম্য, লাখ লাখ মানুষের আত্মদানের মহিমা প্রতিষ্ঠা এবং মা-বোনদের সম্ভ্রমহানির গ্লানি মুছে ফেলা। কিন্তু নিজ দেশটাকে ‘ভাগাড়’ বানাতে কম কসুর করেনি একদল উঠতি সশস্ত্রজন।
অস্ত্রের ঝনৎকার তখন চারদিকে। সেই অস্ত্র নিয়ে পুলিশ ফাঁড়ি লুট, অস্ত্র লুট, শ্রেণিশত্রু খতমের নামে সাধারণ মানুষ হত্যা শুধু নয়, জনপ্রতিনিধিদের প্রাণনাশের ঘটনাও ঘটেছে। মোদ্দা কথা, পরাধীনতাকে, উপনিবেশকে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, স্বাধীনতাকে ততখানি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। পরাধীনতা যেমন অসহনীয়, অবাঞ্ছনীয়, স্বাধীনতা যে আবার তেমনই মহামূল্যধন, সে কথাটি মনে-প্রাণে অনুভব করেনি। খুব হালকাভাবে নিয়েছে। ভেবেছে দুঃখের দিন গেল, সুখের দিন এলো। অনেক কষ্ট করেছে, এখন আরাম করবে। অনেক ত্যাগ করেছে, এখন ভোগ করবে। এত দিন দাসত্ব করেছে, এখন প্রভুত্ব করবে। আর এখানেই হয়েছে মারাত্মক ভুল। পরাধীনতার পাপ বিদায় করতে যতখানি ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, স্বাধীনতার পুণ্যফল ভোগ করতেও আবার তেমনি কৃচ্ছ্রসাধন প্রয়োজন রয়েছে, তা বেমালুম ভুলে গেছে। যেমন ভুলেছে, দেশের কাজে আনন্দ আছে, আরাম নেই। দেশপ্রেম রজকিনী প্রেমের মতো নিকষিত হেম, স্বার্থ গন্ধ নাহিক তায়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে প্রাপ্য চাই বলে যারা হুলুস্থুল করেছিলেন, তারা বুঝতেই পারেননি দেশপ্রেম শুধু যুদ্ধজয় নয়, যুদ্ধশেষের ধ্বংসস্তূপে নতুন জীবন গড়ে তোলাও। দেশসেবার কোনো দৃষ্টান্ত তারা স্থাপন করতে পারেনি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি যে সম্পূর্ণ পরাজিত হয়নি, বরং বীরদর্পে শক্তি সঞ্চয় করে আবার সশস্ত্র হয়ে ফিরে আসবে, নেবে পরাজয়ের প্রতিশোধ, সে বোধ কারও মনে ঠাঁই পেয়েছে তা নয়। বরং একাত্তরে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগী বাঙালি চরদের বিচার কাজেও বাধা আসে গোড়াতে। দালাল আইন বাতিল করার জন্য বর্ষীয়ান নেতাও মাঠ গরম করে তুলেছিলেন শুধু নয়, অনশন কর্মসূচিও পালন করেছেন।
স্বাধীনতাকে মেনে নিতে না পারা চরমপন্থিরা সর্বত্র সশস্ত্র মহড়া দিয়ে লুটপাট, হত্যাযজ্ঞ বহাল রেখেছে। কিন্তু যুদ্ধজয়ী কারও মনে এমন বোধোদয় হয়েছে যে, পরাজিত শত্রুর কোনো চিহ্ন রাখতে নেই, তা নয়। বরং শত্রুদের আশ্রয় দিয়েছে রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায়। ওরা আবার সংগঠিত হতে থাকে নানারূপে, নানা কায়দায়। পাশাপাশি যাদের দৌলতে স্বাধীনতা লাভ, তাদের যথোচিত মর্যাদা দেওয়া হয়নি। তাদের পুনর্বাসন বা দেশগড়ার কাজে নিয়োজিত করা হয়নি। গ্রামের যে যুবকটি কোনো দিন সাধারণ রাইফেল বা বন্দুক দেখেনি, তার হাতে যখন স্টেনগান, এসএমজি, এলএমজি ওঠে আসে, তখন তার জীবন চেতনা বদলে যেতে বাধ্য। একাত্তর তার মধ্যে দেশপ্রেমের যে আগুন জে¦লে দিয়েছিল, যুদ্ধোত্তর দেশে সে আগুন নিভিয়ে দিয়ে তাকে বনসাইয়ে পরিণত করার প্রচেষ্টা হিতে বিপরীত হয়েছে। ফলে স্বাধীনতাকে যতখানি মর্যাদা দেওয়ার কথা, তা-ও দেওয়া সম্ভব হয়নি। স্বাধীনতার পর দেশময় বিশৃঙ্খলা, চুরি, ডাকাতি, খুনখারাবি, চোরাকারবারি, মজুতদারি, সবকিছু চলেছে অবাধে। তাই বঙ্গবন্ধুকে মজুতদার ও চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠে বলতে হয়েছে, এদের নির্মূল করতে হবে। দুর্বৃত্তরা তত দিনে আশ্রয় নিয়েছে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলে।
তারা জানত, তাদের এসব অন্যায় কাজে প্রশ্রয় দেবে দলীয় নেতারা, যদি অন্যায়কারীও দলের লোক হয়। যে কোনো কাজেরই সমর্থন পেয়েছে রাজনৈতিক দলের কাছে। এমনকি এরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ও যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের কাছেও আশ্রিত হয়েছে। দেশের স্বার্থ তত দিনে গৌণ হয়ে ব্যক্তিস্বার্থ সামনে চলে আসায় সমাজের শৃঙ্খল ক্রমশ শিথিল হয়ে পড়ে। যুদ্ধে ভঙ্গুর রাষ্ট্রযন্ত্রকে গড়ে তোলার কাজটি সুসম্পন্ন করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। বরং যে কোনো অপকর্মের অপরাধ থেকে মুরুব্বির জোরে রেহাই পেয়েছে। এরই ফলে সমাজের সব বাঁধন শিথিল হতে থাকে। সমাজ বলতে দেশের জীবন। সেই জীবনের মধ্যে জাতীয় চরিত্রের প্রকাশ। সেই চরিত্রটির অবস্থা এমন ক্ষণভঙ্গুর হতে থাকে যে, গোটা দেশটিকে আইনের শাসনের আওতায় আনার পথে পদে পদে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হতে থাকে। প্রশাসন পরিচালনার জন্য দক্ষ, অভিজ্ঞ, সৎ ও সাহসী মানুষের অভাব ছিল তীব্র। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া ও না নেওয়াদের মধ্যে এক ধরনের স্নায়বিক সংঘাত দেখা দেয়। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি বহুধাবিভক্ত হতে থাকে। আর পরাজিতরা শক্তি সঞ্চয় করতে থাকে নিজস্ব বিবেককে মুছে ফেলে। জাতীয় চরিত্রটির মধ্যে ভাঙন ধরেছে বলেই যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে সহস্র প্রতিকূলতার ভেতর গড়ে তোলার কাজটি এককভাবে করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকেই। নানা চিন্তা-চেতনায়, নানা মতবাদে আপ্লুতদেরও তিনি কাছে টানতে চেয়েছেন। পাকিস্তানি যুগের বিভেদকে ভুলে বাঙালির নিজস্ব রাষ্ট্রটি গড়ে তোলার জন্য সবার প্রতি ছিল উদাত্ত আহ্বান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে দেশে-বিদেশে নানা ফ্রন্টকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। দেশে দলের একটা প্রাগ্রসর অংশ বেরিয়ে সশস্ত্র পন্থায় ধাবিত হয়। তারা খাদ্য ও পাটগুদাম, কারখানায় অগ্নিসংযোগ, থানা, ফাঁড়িতে হামলা, অস্ত্র লুট, হত্যাযজ্ঞ চালায় বিপ্লবের নামে। মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী চীনের অনুসারী চরমপন্থিরা অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে সাধারণ কৃষক থেকে সংসদ সদস্য পর্যন্ত হত্যা করে।
গ্রামে গ্রামে ডাকাতি করা ছাড়াও পুলিশ ও থানা আক্রমণ লুটপাট চালাত। সারা দেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে আতঙ্ক ছড়ায়। এদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার মতো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে যখন গড়ে তোলা হচ্ছে, তাদের ওপর আক্রমণটা এমনই তীব্র হয় যে, দুর্গম অঞ্চলগুলো সশস্ত্র চরমপন্থিদের অভয়ারণ্য হয়ে ওঠে। বিধ্বস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা, পর্যাপ্ত যানবাহন ঘাটতি, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না থাকা, ইত্যাকার নানা সমস্যাক্রান্ত তখন পুলিশ বাহিনী। যে বাহিনীর ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ২৫শে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরেই হামলা চালিয়েছিল। সেই পথ ধরে গণবাহিনী, সর্বহারাসহ চরমপন্থিরাও স্বাধীনতার পরপরই পুলিশ বাহিনীকে আক্রমণের লক্ষ্যস্থলে পরিণত শুধু নয়, তাদের অস্ত্রশস্ত্রও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। দেশকে স্বাভাবিক পথে পরিচালিত করার ক্ষেত্রটি ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছিল। পরাজিত পাকিস্তানের থাবা তখনও বিদ্যমান। চীনপন্থিরা হয়ে ওঠে পাকিস্তানিদের ইচ্ছা-আকাক্সক্ষা ও ষড়যন্ত্র পূরণ এবং বাস্তবায়নের বাহন। বঙ্গবন্ধুকে এসব মোকাবিলা করতে হয়েছে ভঙ্গুর প্রশাসন দিয়ে। সেদিন শিক্ষিত ও বুদ্ধিজীবী সমাজ দেশ গড়ার প্রত্যয়ে এগিয়ে আসেনি। বরং বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সরকারের বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে লেগেছিল। অপপ্রচারের মাত্রা ছিল তীব্র। এই গোষ্ঠীটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের আদেশ-নির্দেশ উপেক্ষা করে পাকিস্তানি হানাদার শাসকদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ শুধু নয়, তাদের নির্দেশ মেনে চলেছিল। শেখ মুজিবের নামে এবং নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হোকÑ এমনটা চায়নি যারা, তারা স্বাধীনতার পরও বিরোধিতা করেছে। অনেকে অদ্যাবধি নিহত বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিষোদ্গার চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭১ সালে বিশুদ্ধ বাঙালিরা একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। স্বার্থের সংঘাত ছিল না। স্বার্থ ছিল দেশকে স্বাধীন করা, হানাদারমুক্ত করা এবং বাঙালির শাসন প্রতিষ্ঠিত করে সোনার বাংলা গড়ে তোলা। কিন্তু যেই না স্বাধীন হলো, অমনি স্ব স্ব সম্পর্কের স্বার্থ এমন মাত্রায় সজাগ হয়ে উঠল যে, পরাজিত শক্তিরা হালে পানি পেল। অর্থ, অস্ত্রবলে বলীয়ান হয়ে তারা নানাভাবে নানা রূপে এগিয়ে আসতে থাকে।
তাদের তৎপরতা গড়াতে গড়াতে বঙ্গবন্ধুর দলের ভেতরও অবস্থান নিতে থাকে। শেখ মুজিব দেশ গড়ার কাজে ডাক দিয়েছিলেন। অনেক আকুতি-মিনতি প্রকাশ করেছিলেন। দেশটি গড়ার জন্য তিন বছর সময় চেয়েছিলেন এবং তা পালনও করেছিলেন প্রবল প্রতিকূলতায়। দেশকে একটি জায়গায় এনে স্থিতিশীল করে তোলার প্রক্রিয়ায় অনেকটা পথ এগিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জাতির পিতা, তাই সব মানুষের প্রতি ছিল মমত্ববোধ। বিশেষত সাধারণ মানুষের প্রতি। যাদের জন্য তিনি নিজের জীবন, যৌবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাই সমন্বয়সাধন করতে চেয়েছিলেন। বিভেদ, পরশ্রীকাতরতা ভুলে সোনার বাংলা গঠন করার লক্ষ্যে যে কর্মসূচি নিয়েছিলেন, তার বিকাশমান পর্যায়ে নিষ্ঠুর আঘাতটি হানা হয়েছিল। যে সংহতি বঙ্গবন্ধু সংগঠিত করতে চেয়েছিলেন, তাকে সংহার করা হলো। দেশ ফিরে গেল একাত্তরপূর্ব পর্বে। সেদিন বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ এবং পরে সমর্থিত দল বাকশাল নেতাকর্মীরা এ ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তারা বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। যখন বঙ্গভবনে শপথ নিচ্ছে বঙ্গবন্ধুরই মন্ত্রিসভার সদস্যদের একটা বড়ো অংশ, তখন আরেক অংশকে ক্রমশ কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সামরিক অভ্যুত্থান হলে বাকশালের মন্ত্রীরা শপথ নেওয়ার কথা নয়, আইয়ুব স্টাইলে উর্দিওলারাই ক্ষমতার দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হতেন।
সেনাবাহিনীর কতিপয় সদস্য রাজনীতিকদের সহযোগিতায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে ক্ষমতায় আসীন করে তাদের মতাবলম্বীদের। সংবিধান ও সংসদ তখনও বহাল। রাষ্ট্রপতির অবর্তমানে পদটিতে দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি সংবিধানেই নির্ধারিত। সংসদ সদস্যরা ক্ষমতা দখলকারী খন্দকার মোশতাকের রাষ্ট্রপতি পদ দখল করার বিরোধিতায় একাট্টা হয়নি। স্পিকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সংসদ ডেকে পদক্ষেপ নিতে পারতেন কি না, সে প্রশ্ন আজও অবান্তর নয়। চলবে…
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)