Search
Close this search box.

বেগম ফজিলাতুন নেসা : শেখ মুজিবের জীবনে অর্ধেকেরও বেশি

১৫ আগস্ট: নেপথ্যের কুশীলব কারা

মনজুরুল আহসান বুলবুল

 

১.
’ সাম্যের গান’ গাইতে গিয়ে কবি নজরুল বলেছিলেন ’ বিশ্বে যা-কিছু মহান সৃষ্টি চির-কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’ দৃশ্যতই কবি এখানে পূর্ণাঙ্গতার চিত্র একেঁছেন। নারী পুরুষ আধাআধি হলেই পূণাঙ্গ হয় এমনিই কবির সরল সমীকরণ। কিন্তু সমীকরনেরও ব্যতিক্রম হয়। কবির কল্পচিত্রের চাইতে কখনও কখনও ভিন্ন সত্য প্রতিষ্ঠিত হয় প্রবলভাবে।

যেমন, ১৯৭২ সনের ১০ জানুয়ারী, জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যখন কবি গুরু রবীন্দ্র নাথের ’ .. সাড়ে সাতকোটি বাঙ্গালীরে হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছো বাঙালী করে মানুষ করোনি ” মন্তব্যের সামনে আবেগময় কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন : কবি গুরু, আজ এসে দেখে যান, বাঙ্গালী আজ মানুষ হয়েছে, আপনার কবিতা মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।’ তখন কি নতুন এক সত্য দৃশ্যমান হয় না ?
আজ এমন একজন নারীকে নিয়ে আলোচনা, যিনি তাঁর জীবনসঙ্গী পুরুষটিকে পূর্ণতা দিয়েছিলেন, তবে তাঁর জীবনের অর্ধেক হয়ে নয় বরং তার অনেক বেশিই হয়ে। পুরুষটি পূর্ণ হয়েছিলেন সত্যি, তবে তাঁর জীবনে এই নারীর অবস্থান অর্ধেকের চাইতে বেশি।
বলছি, শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন নেসার কথা ।

২.
বাবা শেখ জহুরুল হকের দুই কন্যা। জিন্নাতুননেসা ও ফজিলাতুন নেসা রেনু। আমাদের কাহিনী এগুবে রেনুকে অনুসরণ করেই।
বাবার ইচ্ছে দুই মেয়েকেই বি,এ, পাস করাবেন। কিন্ত হঠাৎ মারা যান শেখ জুহুরুল হক। রেনুর বয়স তখন মাত্র দুই বছর। বাবা হারানের কিছুকালের মধ্যেই মাকে হারান রেনু। পারিবারিক নানা সমীকরনে শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হয় রেনুকে বিয়ে দিতে হবে। কনে রেনুর বয়স তখন তিন বছর আর পাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ১৩ বছর। বিয়ে হলে গেল। শেখ মুজিবুর রহমান বলছেন :’ .. মুরুব্বির হুকুম মানার জন্যই রেনুর সাথে আমার বিবাহ রেজিস্ট্রি করে ফেলা হলো। আমি শুনলাম আমার বিবাহ হয়েছে’। আজকের হিসেবে ’বাল্য বিবাহ’ই বটে!

বিয়ের পর বাবা মা হারা রেনু তাঁর শাশুড়িকেই ’বাবা’ বলে ডাকতেন। এই শাশুড়ি যেমন মা হিসেবে তাঁর পুত্রকে গড়ে তুলেছেন, তেমনি পুত্রবধূর মধ্যেও ছড়িয়েছেন আলো। শিশু থেকে কৈশোর পার হয়ে তারুণ্যে পা রাখার সময়ই রেনুকে তাঁর শাশুড়ি মাথায় ঢুকিয়ে দিচ্ছেন ’… কেউ দ্বারে এলে যতটুকু পারো দিয়ো। ফিরায়ে দিয়ো না। .. অন্যের জিনিস দেখে অজ্ঞান হয়ে যেয়ো না। … মানুষকে কখনো গর্ব দেখাবে না। এমন কিছু করবে না যাতে মানুষ কষ্ট পায়।’
পাঠক, লক্ষ্য করুন, মায়ের এই দর্শন শেখ মুজিব ধারণ করেছেন, তা’ সঞ্চারিত হয়েছে পুত্রবধূর মধ্যেও। নানী, বাবা – মা হয়ে এই জীবনাচার কি আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তাঁর বোন শেখ রেহানার মধ্যেও দেখতে পাই না ? পরিবারিক সংস্কৃতি এভাবেই প্রবাহিত হয় প্রজন্মের হাত ধরে।
মা সম্পর্কে শেখ রেহানা বলছেন : ’.. মায়ের রূচি ছিল অসাধারণ। ঘরদোর সব সময় থাকতো সাজানো গোছানো। রান্না বান্না সেলাই ফোঁড়াই সব কিছুতে তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত । .. বাড়ির মশারী থেকে শুরু করে লেপের কভার পর্যন্ত সবই সেলাই করতেন। আর ভালোবাসতেন গান শুনতে। .. মা ছিলেন অসম্ভব ধীমান। সিরাজউদদৌলার সংলাপ, এমনকি মাইকেল থেকেও তিনি মুখস্ত শোনাতেন আমাদের। তাঁর এই প্রতিভা পরবর্তীকালেও খুব কাজে লাগে। জেলখানায় বাবার সঙ্গে দেখা করতে গেলে বাইরের সব খবর তিনি অবিকল পৌঁছে দিতেন।..’

৩.
শেখ রেহানার বর্ণনায় তাঁর মাতৃগুনের বাস্তবচিত্র দেখবো আরও পরে।
বয়স যাই হোক, রেনুর জীবন বাধা হয়ে যায় এই দেশের রাজনীতির এক ঝড়ের পাখী শেখ মুজিবের সাথে। বালিকাবধূ টুঙ্গীপাড়ার অজ পাড়াগায়ে বড় হচ্ছে, আর অন্যদিকে, কৈশোর পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখা শেখ মুজিব কলকাতায় এঁকে চলেছেন রাজনীতি ঘেরা তাঁর জীবনের চিত্র ।
বঙ্গবন্ধু লিখেছেন “কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। লেখাপড়া তো মোটেই করি না। ভাবলাম কিছুদিন লেখাপড়া করব। মাহিনা বাকি পড়েছিল, টাকা-পয়সার অভাবে। রেণুর কাছে আমার অবস্থা প্রথমে জানালাম। আব্বাকে বললে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন মনে হলো। কিছুই বললেন না। টাকা দিয়ে আব্বা বললেন, ‘কোনো কিছুই শুনতে চাই না। বিএ পাস ভালোভাবে করতে হবে। অনেক সময় নষ্ট করেছ, ‘পাকি¯তানের আন্দোলন’ বলে কিছুই বলি নাই। এখন কিছুদিন লেখাপড়া কর।’ আব্বা-মা, ভাই-বোনদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ’রেণুর ঘরে’ এলাম বিদায় নিতে। দেখি কিছু টাকা হাতে করে দাঁড়িয়ে আছে। ‘অমঙ্গল অশ্রুজল’ বোধহয় অনেক কষ্টে বন্ধ করে রেখেছে। বলল, ‘একবার কলকাতা গেলে আর আসতে চাও না। এবার কলেজ ছুটি হলেই বাড়ি এসো।’ এভাবেই সারাজীবন ’রেনুর ঘর’ ছিল শেখ মুজিবের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ।

১৯৫৪ সনে পূর্ববঙ্গের রাজনীতির এক টালমাটাল সময়ে ঢাকায় চলে আসেন ফজিলাতুন নেসা, তখন তিনি দুই সন্তানের মা। পেছনে ফেলে আসেন স্মৃতিময় এক আটপৌরে পারিবারিক জীবন। যে জীবনে তাঁর স্পর্শে উজ্জল ছিল। শশুর – শাশুড়ী নিয়ে এক বিশাল সুখী পরিবার। একটাই অসম্পূর্ণতা ছিল, ঝড়ো হাওয়ার পাখী, রাজনীতিতে সর্বাত্মক নিবেদিত জীবন সঙ্গীকে সার্বক্ষনিক কাছে না পাওয়া। ঢাকায় এসেই শুরু হলো রেনুর উথাল পাতাল নতুন জীবন। ওঠলেন রজনী বোস লেনের ভাড়া বাড়িতে। এর মধ্যেই একটু সুখের ঝলক। তরুন নেতা শেখ মুজিবুর রহমান হলেন যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রী। বাড়ি পেলেন মন্ত্রীপাড়ায়। কিন্তুু সুখ কপালে সইলো না। সরকার ভেঙ্গে দেয়া হলো, বাড়ি হারালেন মন্ত্রী, উদ্বাস্ত হলেন রেনু । ১৯৫৬ সনে শেখ মুজিব আবার মন্ত্রী, আবার মন্ত্রী পাড়া কিন্তু আবার বাড়ি ছাড়া। শেখ মুজিব হলেন টি বোর্ডের চেয়ারম্যান, আবার সরকারী বাড়ি। ১৯৫৮ তে সে সামরিক শাসন। গ্রেফতার হলেন শেখ মুজিব, আবার সরকারী বাড়ি গেল। এবার নতুন বিপদ। শেখ মুজিবের পরিবারকে কেউ বাড়ি ভাড়া দিতে চায় না। শেখ মুজিব ব্য¯ত রাজনীতি নিয়ে, সংসারের উথাল-পাতাল সামাল দিচ্ছেন রেনু, তাঁর স্বভাবসুলভ ধীরতা দিয়ে। শেষে শুভানুধ্যায়ীদের সহযোগিতায় পাওয়া গেল এক টুকরো জমি, কিন্তু টাকা কই জমি কেনার। শিষ্য শেখ মুজিবকে দেয়া গুরু সোহরাওয়ার্দীর গাড়িটি বিক্রি করে কেনা হলো জমি। কিন্তু বাড়ি তৈরির ্ উপায় কি ? সে এক কাহিনী। যক্ষায় আক্রান্ত এক আওয়ামী লাগ কর্মী নূরুল ইসলামকে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন শেখ মুজিব। এই কর্মী হাসপাতালে শুয়ে শেখ রেহানার নামে গেট এ ওয়ার্ড খেলতে গিয়ে পেলেন আট হাজার টাকা। সেই টাকা তুলে দেয়া হলো রেনুর হাতে। সেই টাকায় তিন তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে মুলি বাঁশের বেড়া দিয়ে বাড়ি বানিয়ে ১৯৬১ সনে নিজ বাড়িতে বসত গড়লেন ফজিলাতুন নেসা। পরে ধানমন্ডির সেই বাড়ি হয়ে ওঠলো বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। বাঁশের বেড়ার এই বাড়িটিকে আসল বাসযোগ্য বাড়ি বানাতে ইট কাঠ লোহা সিমেন্টের যোগান নিশ্চিত করতে ফজিলাতুননেসার যে অবিরাম পরিশ্রম ও নিষ্ঠা সে আরেক ইতিহাস।

৪.
সংসারে প্রধান পুরুষ কখন জেলে কখন বাইরে তাঁর হিসেব রাখা মুশকিল। এভাবেই ফজিলাতুন নেসার সংসার হলো চারটি : টুঙ্গীপাড়ায় শ্বশুর- শ্বাশুড়ি নিয়ে একটি, ধানমন্ডিতে পুত্রকন্যা সমেত একটি, শেখ মুজিবের জেল জীবন নিয়ে একটি আর এই তিন নম্বরটির সাথে যুক্ত হলো শেখ মুজিবের রাজনীতির খোঁজ খবর রাখা, দলের নেতাকর্মীদের সাথে সমন্বয় নিয়ে চার নম্বর সংসার। দেখা যাবে এ চার সংসারেই সফল হলেন ফজিলাতুন নেসা।

টুঙ্গীপাড়ার পরিবার : পুত্রবধূ ও শশুর শাশুড়ির পারস্পরিক নির্ভরতার কথা জানি সেই টুঙ্গিপাড়া কাল থেকে। মূলত; ফজিলাতুন নেসাই একসময় হয়ে ওঠেন এই বড় পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু। এক পর্যবেক্ষক বলছেন : ’ ..বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফুর রহমানের দায়িত্বশীলতার কোন তূলনা হয় না। তিনি পুত্রের সংসার ভালোভাবে চালানোর জন্য দেশ থেকে চালডাল সব পাঠাতেন। পাশাপাশি রেনুর পৈত্রিক সম্পত্তির আয়ের সম্পূর্ণ টাকা তিনি রেনুর হাতে তুলে দিতেন। তা’ দিয়ে রেনু ভালোভাবেই সংসার চালাতেন, তবে বিপত্তি বাঁধতো রেনুর কাছে কেউ কোন সাহায্য চাইলে । তিনি তাদেরকে না বলতে পারতেন না। এমনও হয়েছে, তাঁর হাতে টাকা নেই, তখন তিনি সংসারের একটি প্রয়োজনীয় জিনিস বা গহনা বিক্রি করে সেই জরূরী প্রয়োজন মিটিয়েছেন। কাউকে তিনি বুঝতে দেননি অভাবের কারনে তাঁকে এই কাজটি করতে হয়েছে। দেবরের বিয়ে, শশুর শাশুড়ির চিকিৎসা, শেখ মুজিবের বোনদের নানা সমস্যার সমাধানে নিজ যোগ্যতাতেই পরিবারের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠেছিলেন ফজিলাতুন নিসা ।

পুত্র-কন্যাদের নিয়ে সংসার : ফজিলাতুন নেসা কিভাবে চালাতেন এই দ্বিতীয় সংসার ? শেখ রেহানার বর্ণনা থেকে শুধু কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করি। তিনি বলছেন : ’ .. ছোটবেলায় আমি নাচতাম। যখনকার কথা বলছি তখন বাবা কারাগারে। উকিল-পত্তরের খরচ, বাড়ির এতোগুলো মানুষের নানা রকম খরচ নিয়ে মায়ের উপর তখন ভীষন অর্থনৈতিক চাপ। এর ভেতর ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিউটে একটি অনুষ্ঠান, সেখানে আমার নাচার কথা। সেজন্য ঘুঙুর চাই। চামড়ার উপরে বসানো বকলেস লাগানো ঘুঙুরের অনেক দাম। মা তখন নিজেই কাপড়ের উপর ঘুঙুর বসিয়ে দিলেন, বললেন: নরম কাপড়ে পায়ে ব্যথা লাগবে না । আমিও খুশি, সবদিক শান্তি । পরে বুঝতে পেরেছি, পয়সা বাঁচিয়ে মা এইসব দিক সামলাতেন।

তখনতো আর গ্যাস ছিলনা, কেরোসিনের চুলাও ছিল ব্যয়বহুল। রান্নার একমাত্র ভরসা শুকনো লাকড়ী। কিন্তু বর্ষায় বিপদ। তাই ফজিলাতুন নেসা পাটকাঠির ওপর গোবর দিয়ে ঘুঁটে বানিয়ে শুকিয়ে রাখতেন। একবার নাকি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এগুলো দেখে বলেছিলেন : ’এত শিক কাবাব বানিয়েছ কেন বৌমা’ !
শেখ মুজিব জেলে গেলে ফজিলাতুন নেসার কাজ বেড়ে যেতো। পুত্র কন্যা আত্মীয় স্বজনতো আছেই, মাওলানা ভাসানীর শরীর খারাপ, ছুটো খাবার দাবার ফলমূল নিয়ে। খন্দকার মুশতাক জেলে, তার অসুস্থ স্ত্রীকে লন্ডন পাঠানোর যাবতীয় দায়িত্ব ফজিলাতুননেসার।
শেখ মুজিব রাজনীতির জন্য সংসারে সময় দিতে পারেন না, আবার জেলে গেলেতো সবই বন্ধ। এ সময় গুলোতে অর্ধেক নয়, শেখ মুজিবের পুরো দায়িত্বই পালন করতেন ফজিলাতুন নেসা।

শেখ মুজিব যখন জেলে : এ আরেক সংসার ফজিলাতুনেসার। পরিসংখ্যান বলছে শেখ মুজিবে জেল যাত্রা শুরু ১৯৩৮ সন থেকে। নানা মাত্রার বিরতি দিয়ে এটি চলেছে ১৯৭২ সনের ৮ জানুয়ারী পর্যন্ত। একথা বলাই যায়, ফজিলাতুননেসা যে সময়ে তাঁর বিয়ের কথা বুঝতে শুরু করেছিলেন, সে সময় থেকেই এটিও বুঝতে শুরু করেছিলেন তাঁর স্বামী আর জেলখানা সমার্থক। জেলখানা বুঝি তাঁরও জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়ায়। শেখ মুজিবের এই জেল যাত্রা কেমন ছিলো? শেখ রেহানার বর্ণনা : [ পুলিশ এলে] ’… মাঝে মাঝে বিদ্রোহী হতেন শেখ হাসিনা, কিছুতেই পুলিশকে ঢুকতে দেবেন না, যেতে দেবেন না বাবাকে। .. শেখ মুজিব বলতেন, যেতেতো হবেই। .. তবে মা ঘাবড়াতেন না কখনো, কেবল মুখটা বিমর্ষ হয়ে ওঠতো। অন্যভাবেও বুঝা যেতো তাঁর কষ্ট। বাবা যত দিন জেলে থাকতেন ততদিন ভালো বা রঙ্গিন শাড়ি পড়তে ইচ্ছে হতো না তাঁর। বাবা ফিরলে সব ঠিক।’
রাজনৈতিক কারনে স্বামী জেলে। সরকার তাঁকেও শত্রু গণ্য করতো, নজরদারিতে রাখতো। কিন্তু ফজিলাতুন নেসাতো হাল ছেড়ে বসে থাকতে পারেন না। শেখ কামাল ম্যট্রিক পাস করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে চায়। কিন্তু মোনায়েম সরকারের বাধা, শেখ মুজিবের ছেলেকে ঢাকা কলেজে ভর্তি করা যাবে না। বাবার দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এলেন মা, বেগম ফজিলাতুননেসা। ফোন করলেন সরাসরি প্রিন্সিপালের কাছে। শেখ কামালের ভর্তি সমস্যার সাধান হলো।

জেলখানায় বন্দী শেখ মুজিবকে দেখতে যাওয়াই ছিল পরিবারের একমাত্র আনন্দের সময়। কিন্তু ধীমান ফজিলাতুন নেসা এই সময়টুকুও কাজে লাগোতেন অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাথে। দল ও বাইরের রাজনীতির খবরাখবর যতটুকু পারতেন ততটুকু মুখে বলতেন, আর নিয়ে যেতেন ছোট ছোট চিরকুট। শেখ রেহানা আর ছোট রাসেল ব্যস্ত রাখতো এসবির লোককে, খোকা [ শেখ হাসিনা- শেখ রেহানার চাচা ] সবাইকে চা নাস্তা খাওয়াতেন সবাইকে, এই ফাঁকে ফজিলাতুন নেসা শেখ মুজিবের হাতে তুলে েিদন চিরকুট গুলো।
জেলখানায় ফজিলাতুন নেসার খাবার পাঠানোতো বিশেষভাবে আলোচনার মতই। শেখ মুজিবের সহবন্দী কারো কিছু খেতে ইচ্ছে করলে শুধু শেখ মুজিবকে বলার অপেক্ষা। সাথে সাথেই অর্ডার চলে যেতো ফজিলাতুন নেসার হেঁশেলে, বাকি টুকু শুধু বাস্তবায়ন।

ফজিলাতুন নেসা কখনই তাঁর কোন দায়িত্ব পালন থেকে এতটুকু সরে আসেননি। আগরতলা মামলার সময় গুজব ছড়ানো হলো ফজিলাতুন নেসাকেও আটক করা হবে। নিজের আটক হওয়া নয়, ফজিলাতুন নেসা চিন্তিত হলেন বিয়েযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়ে। এর মধ্যেই পাত্রের সন্ধান হলো, জেল থেকে শেখ মুজিবের সন্মতিও আনা হলো। ১৯৬৭ সনের ১৭ নভেম্বর আক্দ হলো শেখ হাসিনার। কিন্তু কন্যা সম্প্রদানতো করতে হবে। সেই কঠিন দু:সময়ের মধ্যেও মেয়ে জামাই নিয়ে কারাগারে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন বেগম ফজিলাতুননেসা। নিয়ে গেলেন কলম, ঘড়ি, মিষ্টি আর দুটি ফুলের মালা। বাবা শেখ মুজিব এভাবেই সম্প্রদান করলেন তাঁর আদরের জ্যেষ্ঠা কন্যাকে। বৈরী সময় আর কঠিন বাস্তবতার মধ্যেও ফজিলাতুননেসা পালন করলেন মা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব, স্ত্রী হিসেবে তাঁর দায়িত¦। আড়ম্বর হয়তো হলো না কিন্তু কোন অপূর্ণতা রইলো না শেখ মুজিবের দায়িত্ব পালনে।

শেখ মুজিবের রাজনৈতিক জীবন জুড়ে কতটা জড়িয়ে আছেন বেগম ফজিলাতুন নেসা? যদিও বলছি সেটি তাঁর চতুর্থ সংসার। কিন্ত দেখা যাবে শেষ পর্যন্ত এই চতুর্থ সংসারই হয়ে ওঠেছে তাঁর সবচাইতে বড় সংসার। পরবর্তী অধ্যায় জুড়েই সেই আলোচনা ।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সাবেক সভাপতি বিএফইউজে। চলবে…..

তথ্য সূত্র:
১. অসমাপ্ত আত্মজীবনী : শেখ মুজিবুর রহমান
২. কারাগারের রোজনামচা: শেখ মুজিবুর রহমান
৩. শেখ মুজিব আমার পিতা : শেখ হাসিনা
৪. বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ : এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া
৫. অন্তরঙ্গ আলোয় বঙ্গবন্ধুুর পরিবার : সঞ্চিতা
৬. রেনু থেকে বঙ্গমাতা : নাছিমা বেগম
৭. শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার স্মৃতিচারণমূলক রচনা ও বক্তব্য
৮. বেগম সুফিয়া কামাল, এ বিএম মুসা, আবদুল গাফফার চৌধুরী, নীলিমা ইব্রাহিমের স্মৃতিচারণ।
৯. প্রথম আলো, কালের কন্ঠ, জনকন্ঠ সহ বিভিন্ন প্রকাশনায় প্রকাশিত বহুজনের লেখা ।
১০. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ওয়েব সাইট

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ