Search
Close this search box.

বন্যা মোকাবিলায় গুরুত্ব দিতে হবে আন্ত:সীমান্ত নদ-নদীর দিকে

বন্যা মোকাবিলায় গুরুত্ব দিতে হবে আন্ত:সীমান্ত নদ-নদীর দিকে

আশীষ কুমার দে

বর্ষা মৌসুমে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ভারিবর্ষণের ফলে যে অস্বাভাবিক পরিমাণ পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে, তা ধারণ করার ক্ষমতা আমাদের নদীগুলোর না থাকায় প্রতি বছর বন্যা হয়। এর মাত্রা কোনো বছর কম, আবার কোনো বছর অনেক বেশি হয়ে থাকে। সুতরাং বলা যায়, বাংলাদেশ একটি বন্যাপ্রবণ ভূখণ্ড। এখানে প্রতি বছর কম-বেশি বন্যা হবেই। বিশেষজ্ঞরাও একই কথা বলে আসছেন। তবে এ বছরের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ। শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যয়কর। দুর্গত এলাকার সাধারণ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ-দুর্দশার কাহিনী দেশের সকল গণমাধ্যমে কয়েকদিন ধরেই প্রচার হচ্ছে। তাই সে চিত্র নতুন করে তুলে না ধরাই শ্রেয়।

সিলেট বিভাগের পাশাপাশি হাওর-অধ্যুষিত নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ জেলা এবং উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার পর বন্যার বিস্তৃতি দেশের মধ্যাঞ্চলেও দেখা দিয়েছে। পানিসম্পদ ও দুর্যোগ বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হচ্ছে, ঢাকার একাংশও প্লাবিত হতে পারে। ভারিবর্ষণ কমে যাওয়ায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও নেত্রকোনায় বন্যার পানি ধীরে ধীরে নামতে শুরু করলেও দেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলে কয়েকটি নদীর পানি বিভিন্ন পয়েণ্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া কিশোরগঞ্জের একাংশ নতুন করে বন্যাকবলিত হয়েছে।

তাহলে বাংলাদেশে কী প্রতি বছরই এমন বন্যা হবে? মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়বে? জমির ফসল ও মাছসহ ব্যাপক সম্পদহানি ঘটবে? শুরতেই বলা হয়েছে, ভৌগলিক ও ভূ-প্রকৃতিগত কারণে বাংলাদেশ একটি বন্যাপ্রবণ দেশ। তাই কম কিংবা বেশি যাই হোক, প্রতি বছর এখানে বন্যা হবে। সেই সঙ্গে সম্পদ রক্ষা ও জনদুর্ভোগ লাঘবের ব্যবস্থাও করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বন্যা মোকাবিলায় নিতে হবে যথাযথ পদক্ষেপ। তবে কী হতে পারে সে পদক্ষেপ? হ্যাঁ, আন্ত:সীমান্ত নদ-নদীগুলোর ওপর অধিক নজর দেয়াই হবে পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রধান কাজ।

বাংলাদেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত আন্ত:সীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৭। যদিও এই সংখ্যা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদী ভারতের লুসাই পাহাড় থেকে উৎপত্তির পর প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করলেও বাংলাদেশ-ভারত যৌথ নদী কমিশনের ওয়েবসাইটে আন্ত:সীমান্ত নদীর তালিকায় এ নামটি নেই। তবে এ বিতর্ক এখানে নিষ্প্রয়োজন। তালিকাভুক্ত ৫৭টি নদীর মধ্যে বাংলাদেশ-ভারত আন্ত:সীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪। অন্য ৩টি প্রবাহিত হয়েছে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের ওপর দিয়ে।

এ প্রতিবেদনের শিরোনামের সঙ্গে ৬টি নদীর নাম খুবই প্রাসঙ্গিক। সেগুলো হলো: সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা। সবগুলোর উৎপত্তি স্থল ভারত। এর মধ্যে প্রথম তিনটি সিলেট অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। শেষ তিনটি প্রবেশ করেছে রংপুর অঞ্চল দিয়ে। ভারতের আসাম, মেঘালয় ও পশ্চিমবঙ্গে অস্বাভাবিক ভারি বর্ষণের ফলে উপরোক্ত ৬ নদীর পানি বৃদ্ধিই এবারের বন্যার মূল কারণ। তবে এ বছর সিলেট অঞ্চলেও রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে।

প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে সুরমা, কুশিয়ারা ও মনু নদীর পানি বৃদ্ধি পায় এবং বৃহত্তর সিলেটের অনেক পয়েন্টে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। ভারত থেকে আসা এ তিন নদীর পানিপ্রবাহের সঙ্গে প্রচুর পরিমাণ পলি, পাথর ও নুড়ি আসে। পানি কমার পর এসব কঠিন বর্জ্য জমা হয় নদীর তলদেশে। এতে নদীগুলোর নাব্য হ্রাস পায়। নাব্য পুনরুদ্ধার ও সংরক্ষণে বিভিন্ন সময়ে প্রকল্প হাতে নেওয়া হলেও অপরিকল্পিত খনন ও দুর্নীতির কারণে এর সুফল স্থায়ী হয় না। এভাবে পলি, পাথর ও নুড়ি জমতে জমতে নদীগুলো পর্যাপ্ত পানি ধারণক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। এর ফলে প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ী ঢল ও ভারতের উজান থেকে আসা পানি তিন নদীর বুক ছাপিয়ে সিলেটের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত করে। তলদেশ ভরাট হয়ে গভীরতা হ্রাস পাওয়ায় এ পানি সহসা নদীতে নামতে পারে না।

রংপুর অঞ্চল দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলা নদীর চিত্রও অভিন্ন। প্রয়োজনীয় পলি অপসারণ ও পরিকল্পিত খননের অভাবে এসব নদীর বাংলাদেশ অংশের গভীরতা মারাত্মক হ্রাস পেয়েছে, নদীগুলো হারিয়েছে পর্যাপ্ত পানি ধারণক্ষমতা। এখানে একটু ভিন্নতাও আছে। তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানির সঙ্গে পর্যাপ্ত পলি আসলেও পাথর ও নুড়ি আসে না। তবে বর্ষা মৌসুমে ভারত মাঝেমধ্যে তিস্তা ব্যারাজ খুলে দেয়ায় পানিপ্রবাহের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। নদীগুলো পর্যাপ্ত পানি ধারণে সক্ষম না হওয়ায় দু’পাড়ের জনপদ বন্যাকবলিত হয়। এ অবস্থায় ভারি বর্ষণ হলে আরো বেড়ে যায় বন্যার ভয়াবহতা। এভাবে প্রায় প্রতি বছর এসব নদীতীরবর্তী রংপুর, লালমনিরহাট, নীলফামারী ও কুড়িগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। তবে তিস্তা, ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি শুধু উত্তরবঙ্গের ওইসব এলাকাকেই বন্যাকবলিত করে না। এর প্রভাব উত্তরাঞ্চলের আরো কিছু জনপদসহ মধ্যাঞ্চলের ওপরও পড়ে। যমুনা আন্ত:সীমান্ত নদী না হলেও দেশের অন্যতম এ বৃহৎ নদীর প্রবাহপথে বৃহত্তম নদ ব্রহ্মপুত্রের মিলনস্থল রয়েছে। তাই ব্রহ্মপুত্রের পানি অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়লে তা দ্রুতবেগে গড়িয়ে যমুনায় আসে এবং যমুনা ধারণক্ষমতা হারিয়ে তার দু’তীরের বিভিন্ন জনপদকে প্লাবিত করে। এভাবে বন্যার কবলে পড়ে বগুড়া, পাবনা, সিরাজগঞ্জ ও টাঙ্গাইল।

আবার প্রবাহপথে পদ্মার সঙ্গেও মিলনস্থল রয়েছে যমুনার। এছাড়া দেশের অন্যতম নদী ধলেশ্বরী হলো যমুনার একটি শাখা। তাই যমুনার পানি অস্বাভাবিক মাত্রায় বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হলে যৌক্তিক কারণে পদ্মা ও ধলেশ্বরী নদীর পানিও বৃদ্ধি পায়। এর ফলে পদ্মাতীরবর্তী ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, রাজবাড়ি, মানিকগঞ্জ এবং ধলেশ্বরী তীরের টাঙ্গাইল, মুন্সিগঞ্জ এবং ঢাকার অনেক অঞ্চল প্লাবিত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি এবং এসব এলাকা ইতোমধ্যে প্লাবিত হতে শুরু করেছে। প্রসঙ্গত, ব্রহ্মপুত্র নদ তার দীর্ঘ চলার পথে টাঙ্গাইল, নারায়ণগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জকে যেমন স্পর্শ করেছে, তেমনি ধলেশ্বরীর পাশপাশি প্রমত্তা যমুনাও ছুঁয়েছে টাঙ্গাইলকে। ঢাকা ও মুন্সিগঞ্জকেও স্পর্শ করেছে ধলেশ্বরী। এছাড়া দৌলতদিয়া পয়েন্টে পদ্মা ও যমুনা যৌথভাবে মানিকগঞ্জকে ছুঁয়েছে।

ওপরের পর্যালোচনায় এটা স্পষ্ট যে, প্রতি বছর আমাদের জীবনে বন্যার যে প্রাদুর্ভাব আসে তার পেছনে রয়েছে দুটি প্রধান কারণ। এক. বর্ষা মৌসুমে ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, সুরমা, কুশিয়ারা ও মনু নদী বেয়ে উজান থেকে প্রচুর পরিমাণ পানি প্রবেশ এবং দুই. উল্লেখিত ৬টি আন্ত:সীমান্ত নদীর বাংলাদেশ অংশের গভীরতা মারাত্মকভাবে হ্রাস। প্রথম সমস্যাটি বাংলাদেশের একার পক্ষে সমাধান করা যেমন অসম্ভব; তেমনি ভারতের সদিচ্ছা থাকলেও শতভাগ সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। কারণ, এর প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য জড়িত রয়েছে। দ্বিতীয় সমস্যাটির জন্য এককভাবে বাংলাদেশ অর্থাৎ আমরা নিজেরাই দায়ী। বন্যাসমস্যার সমাধান করতে হলে উল্লেখিত ৬ নদীর বাংলাদেশ অংশের পাশাপাশি যমুনা, করতোয়া, পদ্মা ও ধলেশ্বরীসহ অভ্যন্তরীণ গুরুত্বপূর্ণ নদ-নদীকে পরিকল্পিতভাবে খনন ও খরস্রোতা করতে হবে। সেই সঙ্গে নদীর ব্যবহার বাড়ানো ও রক্ষণা-বেক্ষণের স্বার্থে নৌপথের আয়তন বৃদ্ধি এবং নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ অপরিহার্য। তবে সংকট নিরসনে সর্বাগ্রে অধিক গুরুত্ব ও নজর দিতে হবে আন্ত:সীমান্ত নদ-নদীগুলোর ওপর।

তারিখ: ঢাকা, ২২.০৬.২০২২ ইং।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক ও অধিকারকর্মী। ashisptb@gmail.com  

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ