Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্কটাপন্ন সময়ের বয়ান : উদ্বাস্তুর মতো ঘুরেছি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর কন্যা শেখ হাসিনার সঙ্কটাপন্ন সময়ের বয়ান : উদ্বাস্তুর মতো ঘুরেছি

জাকির হোসেন

 

আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল একজন রাজনীতিবিদ নন, লেখক হিসেবেও তার পরিচয় সর্বজনবিদিত। ইতোমধ্যে তার যেসব বই প্রকাশিত হয়েছে তা পাঠকমহলে সমাদৃত হয়েছে। রাজনীতি, দেশপ্রেম তার ধমনিতে প্রবাহিত, তেমনই সাহিত্যের প্রতিও তার অগাধ ভালোবাসা প্রবহমান। রাজনীতিবিদ হিসেবে দেশ ও দেশের মানুষের সুখ-দুঃখের কথা তার লেখায় স্পষ্ট। তিনি লিখেছেন ১৫ আগস্টের শোকাবহ ঘটনা নিয়েও। ১৫ আগস্ট ট্র্যাজেডির পর তার নির্বাসিত জীবন‘উদ্বাস্তু’র মতো ছিল বলে তিনি উল্লেখ করেছেন গত বছর প্রকাশিত ‘মুজিব বাংলার, বাংলা মুজিবের’ শীর্ষক গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন, ‘আমি ও আমার ছোট বোন শেখ রেহানা বিদেশে ছিলাম। সব হারিয়ে রিক্ত-নিঃস্ব হয়ে রিফিউজি হিসেবে যখন পরাশ্রয়ে জীবনযাপন করি, তখনও পত্রিকা জোগাড় করেছি। এবং নিয়মিত পত্রিকা পড়েছি। ১৯৮০ সালে দিল্লি থেকে লন্ডন গিয়েছিলাম। রেহেনার সঙ্গে ছিলাম বেশ কিছুদিন।

তখন যে পাড়ায় আমরা থাকতাম, ওই পাড়ায় ৮-১০ জন ছেলেমেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিতাম। ছুটি হলে সবাইকে নিয়ে আবার ঘরে পৌঁছে দিতাম। বাচ্চাপ্রতি ১ পাউন্ড করে মজুরি পেতাম। ওই টাকা থেকে সর্বপ্রথম যে খরচটা আমি প্রতিদিন করতাম তা হলো কর্নারশপ থেকে একটি পত্রিকা কেনা। বাচ্চাদেরস্কুলে পৌছে দিয়ে ফেরার সময় পত্রিকা, রুটি ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে বাসায় ফিরতাম।’

বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রেক্ষাপট সৃষ্টির জন্য তিনি জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলকে দায়ী করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সব থেকে দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হলো, নিজের ছাত্র সংগঠনের বিভক্তি। ছাত্রলীগ ভেঙে জাসদ সৃষ্টি করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েমের ঘোষণা দেওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করা হয়। একদিকে চরম ডান ও বাম এক হয়, এর সঙ্গে যুক্ত হয় জাসদের নেতৃত্বে কিছু মুক্তিযোদ্ধা। সরকারের গঠনমূলক কাজে এরা প্রতিনিয়ত বাধা দিতে থাকে। লুটপাট থেকে শুরু করে খুন- খারাবি পর্যন্ত শুরু করে। অন্যদিকে স্বাধীনতাবিরোধী এবং পরাজিত পাকিস্তানি গোয়েন্দারা গোপনে এদের অর্থ ও পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করে। জাসদের জনসভায় লোক সমাগম থেকে শুরু করে সব কর্মকাণ্ডে পর্দার আড়ালে এরা যে সহযোগিতা করে, তার দৃষ্টান্ত একটাই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর এই শ্রেণির আর জাসদের প্রয়োজন ছিল না। তাই তারাও হাত গুটিয়ে নেয়। জাসদের সেই জৌলুসেও ভাটা পড়ে। অর্থের জোগানও বন্ধ বা সীমিত হতে থাকে। জনসমাগমও হ্রাস পায়। আর ১৫ আগস্টের শোকাবহ দিন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা লিখেছেন, ‘৩২নং সড়কে ৬৭৭-নং প্লটের বাড়ি। যে বাড়িতে বসবাস করেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ বাড়ি থেকেই তিনি ১৯৭১ সালে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই বাড়ি লক্ষ্য করে স্বাধীন বাংলাদেশে গুলি চালানো হলো। তাঁর বড় ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল গুলির আওয়াজ শুনে নিচে নেমে আসে। সামনে দেখে অতি পরিচিত মুখ, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গী, সেনা অফিসার। কামাল বলতে শুরু করে ‘আপনারা এসে গেছেন, দেখুন কারা যেন বাসা আক্রমণ করেছে।’ তার কথা আর শেষ হয় না। সেই সেনা অফিসারের গুলিতে কামাল লুটিয়ে পড়ে সামনের বারান্দায়। খুনিরা দোতলায় ওঠার জন্য এগিয়ে যায়। দায়িত্বরত এএসপিএসবি সিদ্দিকুর রহমান বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করলে তাকেও গুলি করে। সঙ্গে থাকা আরেকজন অফিসার আমিনুল হক গুলিবিদ্ধ হন। সিদ্দিকের সেখানেই মৃত্যু হয়। এরপর তারা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে থাকে। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ওদের দেখেই জিজ্ঞেস করেন : কী চাও তোমরা? মেজর হুদাকে চিনতে পারেন। তার বাবার নাম ধরে বলেন তুমি না… কথা শেষ হয় না। সুবেদার মোসলেমউদ্দীন ও মেজর নূর চৌধুরী তখনই ওপরে ওঠে আসে এবং গুলি চালিয়ে দেয়। সিঁড়ির ওপর লুটিয়ে পড়েন বাংলার স্বাধীনতার মহাপুরুষ শেখ মুজিব। ঘাতকের দল দোতলায় ওঠে আসে।

গোলাগুলির আওয়াজ শুনে ছুটে আসেন বেগম ফজিলাতুন নেছা। সামনে ঘাতকের দল। সিঁড়িরকাছাকাছি এসে তিনি দেখেন তাঁর প্রিয়তম স্বামী সিঁড়িতে পড়ে আছেন। তিনি ছুটে কাছে যেতেচান। ঘাতকের দল বাধা দেয়। তাঁকে বলে আমাদের সঙ্গে চলেন। তিনি বলেন : ‘আমি কোথাওযাব না। তাঁকে মেরেছ, আমাকেও মারো।’ গর্জে ওঠে ঘাতকের অস্ত্র। লুটিয়ে পড়েন তিনি মাটিতে।

একে একে হত্যা করে মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার লে. শেখ জামালকে, জামালের নবপরিণীতা বধূপারভিন জামাল রোজীকে, শেখ কামালের নবপরিণীতা বধূ সুলতানা কামালকে। বাসার কাজেরছেলে রমার (রহমান) হাত ধরে ছোট্ট রাসেল বাড়ির নিচে অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়ায়। ‘মায়ের কাছে যাব’ বলে রাসেল কাঁদছিল। রমা ওকে চুপ করাতে চেষ্টা করে। একজন সৈন্য ওরকথা শুনে বলে, ‘চলো তোমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাই। রাসেলকে বাবা-মা-ভাইয়ের লাশডিঙ্গিয়ে দোতলায় মায়ের শোবার ঘরে নিয়ে যায় ঘাতকরা। সেখানেই গুলি করে হত্যা করে ছোট্টশিশুকে।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একমাত্র ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ নাসেরকে নিচে অফিস রুমেনিয়ে যায়। সেখানে পাশের বাথরুমে তাকে গুলি করে হত্যা করে।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ