Search
Close this search box.

মনি ভাই আমাকে গেরিলা ট্রেনিং নিতে দেরাদুনে পাঠান

২১ আগস্ট ॥ ইতিহাসের কলঙ্কিত দিন

সৈয়দ আহমাদ ফারুখ; যিনি ছাত্ররাজনীতির মাঠ থেকে রণাঙ্গনের সৈনিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এসএম হলের ভিপি ছিলেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের কোষাধ্যক্ষ, ইংরেজি সাহিত্যের এই ছাত্র ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি’র খুব কাছের মানুষ। বর্তমানে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা।

১৯৭১ সালে কাজ করতেন দৈনিক দ্য পিপল-এ। ২৫ মার্চ রাত ১১টায় শেষ রিপোর্টটি জমা দিয়ে বের হয়ে যান হলের উদ্দেশে। তারপর রণাঙ্গন। আগরতলা থেকে ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ প্রকাশ করতেন কয়েকজন বন্ধু মিলে। রণাঙ্গনের খবর, মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কথন উঠে আসত এতে। বিশেষ করে বৃহত্তর কুমিল্লা, ফেনী, হবিগঞ্জ ও নরসিংদীর যোদ্ধাদের প্রেরণার উৎস ছিল পত্রিকাটি। দেরাদুন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রশিক্ষক হিসেবেও কাজ করেছেন কিছুদিন। গেরিলা ট্রেনিং নিয়েও মাঠে যুদ্ধ না করতে পারার বেদনা এখনও তাকে পীড়া দেয়। আহমাদ ফারুখের সঙ্গে রণাঙ্গনের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেন সাংবাদিক- দুলাল আচার্য

দুলাল আচার্য : এক উত্তাল রাজনৈতিক যুগে আপনাদের তারুণ্য- রাজনীতির শুরুটা বলবেন কী?

আহমাদ ফারুখ : ছাত্রলীগেই আমার রাজনীতির হাতেখড়ি। আমাদের ছাত্ররাজনীতির সময়টাই ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের যুগ। ’৬৯-এর গণআন্দোলন থেকে শুরু করে ৭০-এর নির্বাচন এবং ৭১-এর উত্তাল দিনগুলোতে রাজপথেই ছিলাম। আসলে স্বাধিকার আদায়ের কর্মসূচিগুলোতে আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তই আমাকে নাড়া দিত। বলতে পারেন রাজপথে বঙ্গবন্ধুর সৈনিক ছিলাম আমরা।

দুলাল আচার্য : আপনার সাংবাদিকতা এবং মুক্তিযোদ্ধা হয়ে ওঠার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু বলেন : 

আহমাদ ফারুখ : বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর বাঙালি যখন সশস্ত্র সংগ্রামের মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাধীনতার জন্য। মানুষ যখন ভাবছে, আর নয় এই পরাধীন জীবনÑ তখন সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমরাও একাত্ম হয়েছিলাম। আমি তখন এসএম হল ছাত্র সংসদের সহসভাপতি, ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ। পড়াশোনা করি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে। পাশাপাশি সাংবাদিকতা ইংরেজি দৈনিক দ্য পিপলে। পত্রিকাটি ছিল এই অঞ্চলের গণমানুষের ইংরেজি মুখপত্র। অবশ্য দ্য পিপলে আমি কাজ শুরু করি পত্রিকাটি যখন সাপ্তাহিক ছিল, তখন থেকেই। যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন সাপ্তাহিক দ্য পিপলের বার্তা সম্পাদক। মনি ভাইয়ের সঙ্গে আমি ও জগলুল চৌধুরী (পরে বাসস) সাব-এডিটর হিসেবে যোগ দেই। ২৫ মার্চ রাতে দ্য পিপলে আমার শেষ রিপোর্টটি জমা দিয়ে যখন বের হই, রাত তখন ১১টা। শাহবাগে অবস্থিত দ্য পিপল অফিস থেকে বের হয়ে হেঁটে হেঁটে সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে (ইকবাল হল) আসি। চারদিকে রাস্তাঘাটে ব্যারিকেড আর মুহুর্মুহু সেøাগানে মুখরিত সার্জেন্ট জহুরুল হক হল তখনও সরগরম। আমাদের হলে না থাকার জন্য সতর্ক করে দেওয়া হয়েছিল। ওই রাতেই পাকিস্তানি হানাদাররা নির্মম আঘাত হানল নিরীহ জনসাধারণের ওপর। এর পরের ইতিহাস সবারই জানা।

আমরা তখন যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে নিরাপদ অবস্থানে। এক পর্যায়ে আমরা ছাত্রলীগের কর্মীরা মিলিত হই। তখন দেশের বিভিন্ন স্থানে অল্পবিস্তর প্রতিরোধ শুরু হয়েছে। ঠিক তখনই কুমিল্লার বিশিষ্ট ছাত্রনেতা মাইনুল হুদা বলল, এভাবে চলতে পারে না। চল কিছু একটা করি। তার কাছে একটা সাইক্লোস্টাইল মেশিন আছে। ভাবলাম আমরা তো ইচ্ছে করলে আমাদের সাথীরা কোথায় কীভাবে প্রতিরোধ করছে, তা নিয়ে একটি ইশতেহার বের করতে পারি। তখন আমাদের নেতা সৈয়দ রেজাউর রহমান (বর্তমানে গ্রেনেড হামলা মামলার আইনজীবী ও আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য) বলেন, ইশতেহার কেন? আমরা তো একটি পত্রিকাই প্রকাশ করতে পারি। সবাই একমত হই যেÑ আমরা দুই পাতার একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করব। রেজা ভাইয়ের নেতৃত্বে মাইনুল হুদা, আকবর কবীর (বর্তমানে কানাডায় বসবাসরত), ছাত্রনেতা নাজমুল হাসান পাখী, ছাত্রনেতা রুস্তম আলী, ফজলুর রহমান ঝিনু (কবি), দীপক রায়সহ সবাই সিদ্ধান্ত নেই যে, নিজেদের খাবার পয়সা বাঁচিয়ে পত্রিকার প্রকাশনার ব্যয়ভার বহন করব। প্রথম দুই সংখ্যা সাইক্লোস্টাইল করেই বের করা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’। সম্পাদক হিসেবে প্রথমে একটি কাল্পনিক নাম দেওয়া হয়। পরে আগরতলার একটি প্রেস থেকে তা নিয়মিত প্রকাশ করা শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে বর্তমানে ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলর আবদুল মান্নান চৌধুরী সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। তিনি অবশ্য ছদ্মনামই ব্যবহার করেছিলেন।

 

আহমাদ ফারুখ
আহমাদ ফারুখ

 

দুলাল আচার্য : তাহলে সশস্ত্র যুদ্ধে ?

আহমাদ ফারুখ : হ্যাঁ ঠিক ধরেছেন, ইতোমধ্যে আমার সশস্ত্র যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা প্রবল হয়। শত্রুসেনাদের মোকাবিলা করার জন্য অদম্য ইচ্ছার কারণে আমি ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আগরতলা ফিরে যাই। আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব অনেকে শহরের কলেজ টিলার কোনো এক কলেজের ভবনে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে গিয়ে শেখ ফজলুল হক মনি ভাইকে পাই। আমার যুদ্ধে যাওয়ার ইচ্ছা শুনে তিনি প্রথমে প্রবল আপত্তি করেন। বললেন ওনার সঙ্গে থাকতে হবে। পরে আমার জোরাজুরিতে মনি ভাই আমাকে মুজিব বাহিনীর গেরিলা ট্রেনিং গ্রহণের জন্য দেরাদুনে পাঠান। তখন মুজিব বাহিনী কেবল রাজনৈতিক কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত হতো। প্রথম ব্যাচে আমরা আগরতলা থেকে ২৫ জন ট্রেনিংয়ে যাই। আমাদের ২৫ জনের মধ্যে তৎকালীন ছাত্রনেতা ও বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা নাজমুল হাসান পাখী, কামরুল ইসলাম (সাবেক খাদ্যমন্ত্রী), মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনসহ (বিএমএ নেতা) বৃহত্তর কুমিল্লা, সিলেট ও ঢাকার ছাত্রনেতারা ছিলেন। দেরাদুন গিয়ে দেখি ওখানে সারাদেশ থেকেই ছাত্রলীগ কর্মীরা জড়ো হয়েছে। যথারীতি ট্রেনিং শুরু হলো। এক মাসের ট্রেনিং। বিভিন্ন ধরনের বন্দুক চালনা, বন্দুকগুলো খোলা আবার জোড়া লাগানো, বিস্ফোরকের ব্যবহার, রাতের আকাশ দেখে কীভাবে চলাফেরা করতে হবে, গভীর জঙ্গলের মধ্যে চলাফেরার অনেক কায়দাকানুন শিখলাম। ট্রেনিং শেষ। আগরতলা ফিরব। দেশের অভ্যন্তরে যাব, যুদ্ধ করব। উত্তেজনার শেষ নেই। কিন্তু হায়! ভারতীয় প্রশিক্ষকরা ইতোমধ্যেই আমাদের মধ্য থেকে আটজনকে স্থানীয় প্রশিক্ষক হিসেবে নির্বাচন করলেন আমাদের ঊর্ধ্বতন নেতাদের সম্মতিতে: হাসানুল হক ইনু (সাবেক তথ্যমন্ত্রী), শরীফ নুরুল আম্বিয়া, আ ফ ম মাহবুবুল হক (বাসদ নেতা), যশোরের নোয়াপাড়ার খাইরুজ্জামান, সিলেটের মোহনলাল সোম ও আমি। ফলে যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করা আর হলো না আমার। আগস্ট-সেপ্টেম্বরের দিকে আমি মনি ভাইয়ের নির্দেশে আগরতলা ফিরে আসি। তখন মনি ভাই ও রেজা ভাই প্লাস ফ্যাক্টরি নামক একটি জায়গায় থাকতেন। মনি ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর তিনি খুব খুশি হলেন। তিনি বললেন, ‘ভালোই হলো। এবার তুমি যুদ্ধে যারা আহত হয়ে দেশ থেকে এখানে আসছে, তাদের দেখাশোনা করো। হাসপাতালগুলোয় যাও আর তাদের চিকিৎসা ও পথ্যের ব্যবস্থার দায়িত্ব নাও।’ মনি ভাইয়ের কথার অবাধ্য হওয়ার কোনো সুযোগই নেই। অগত্যা এবারও সশস্ত্র যুদ্ধে যাওয়া হলো না আমার। দুঃখ কেবল, আমার সঙ্গে যারা ট্রেনিং করেছে, তারা সবাই যুদ্ধ করছে। বন্ধুবর মনির চৌধুরীও (সাবেক সংসদ সদস্য ও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি) প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে আর আমি পারছি না। তবে যুদ্ধে অনেক প্রিয় কর্মীকে আমি হারিয়েছি। বন্ধু কামালের ছোটো ভাই, আমার প্রতিবেশী নিজামকে হারিয়েছি। সম্প্রতি নিজামের নামে কুমিল্লা পুলিশ লাইন থেকে কান্দিরপাড় পর্যন্ত সড়কটির নামকরণ করা হয়েছে।

দুলাল আচার্য : মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু বিষয়টি কীভাবে দেখেন?

আহমাদ ফারুখ : দেখুন, বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসের সঙ্গে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা-সংগ্রামÑ সবই পরিচালনা করেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর অসীম সাহসিকতা, দক্ষতা ও যোগ্যতায়। তাঁর ছিল মানুষকে কাছে টানার, মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার মতো অসাধারণ মোহনীয় শক্তি। অনলবর্ষী বক্তা হিসেবে তাঁর ছিল বিপুল খ্যাতি। তার অকৃত্রিম দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি গভীর ভালোবাসা, অমায়িক ব্যক্তিত্ব তাঁকে স্থান করে দিয়েছে অবিসংবাদিত নেতার সম্মানে। পাকিস্তানিদের ২৩ বছরের অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে ৩০ লাখ মানুষের রক্তস্নান আর পাঁচ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি তাঁর নেতৃত্বই স্বাধীনতা অর্জন করে। পাকিস্তানিদের সঙ্গে বাঙালির ২৩ বছরের এক অসম যুদ্ধের সমাপ্তি হয় সশস্ত্র স্বাধীনতা-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এই অসম যুদ্ধে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত লড়াই করে গেছেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সংগ্রাম আর অবদানে নিজ নিজ জাতির মুক্তিদাতা হিসেবে আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যান্ডেলা, কিউবার ফিদেল কাস্ত্রোর নাম বিশ^খ্যাত। তাদের নামের পাশে যুক্ত আছেন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ সংগ্রাম আর একনিষ্ঠ সাধনার মধ্য দিয়ে তিনি আজ ইতিহাসের বরপুত্র। তাঁর জীবনাদর্শে আমরা সংগ্রামী চেতনা ও কর্মনিষ্ঠার পরিচয় পাইÑ যা আমাদের অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির বিজয়, বাংলাদেশ কোনটাই বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া নয়। আমি মনে করি প্রতিটি শব্দই সমার্থক এবং একে অপরের পরিপূরক।

দুলাল আচার্য : আপনি যখন দেরাদুনে, ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ তখন কোন অবস্থায়?

আহমাদ ফারুখ : ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’ তখনও নিয়মিত প্রকাশ পাচ্ছে। আবদুল মান্নান চৌধুরী সম্পাদনা করছেন। মুক্তিযোদ্ধারা দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সময় বেশকিছু কপি নিয়ে যেত। সাপ্তাহিক বাংলাদেশে যুদ্ধের সব সেক্টরের খবর থাকলেও বিশেষ করে বৃহত্তর কুমিল্লা, ফেনীর একাংশ, হবিগঞ্জের একাংশ ও ঢাকার নরসিংদীর খবর বেশি গুরুত্বের সঙ্গে পরিবেশন করা হতো। কেননা এই এলাকাগুলোয় আমাদের যোদ্ধারা ছাড়াও মুক্তিকামী কিছু স্বেচ্ছাসেবকও ছিল, যারা জীবনের পরোয়া না করে পত্রিকাটি বিলি করতেন। পত্রিকাটি এতদঞ্চলের মুক্তিকামী সাধারণ জনতার মনোবল বাড়িয়ে দেওয়ার কাজ করেছে। ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা পাকিস্তানি হানাদারমুক্ত হয়। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমাদের যোদ্ধারা কুমিল্লার দিকে ছুটে যায়। সবকিছু গোছগাছ করে আমাদের যেতে কিছুটা দেরি হয়। স্থানান্তর, আনন্দ-উল্লাস, স্বজনদের সঙ্গে সাক্ষাৎÑ সবকিছু মিলিয়ে পত্রিকাটির প্রকাশনা তিন সপ্তাহ বন্ধ থাকে।

দুলাল আচার্য : দেশ স্বাধীনের পর সাপ্তাহিক বাংলাদেশ আবার কিভাবে শুরু করলেন?

আহমাদ ফারুখ : মুক্তিযুদ্ধের পর ঢাকায় এসে কোর্ট বিল্ডিংয়ের উলটো দিকে ১৩নং কারকুনবাড়ি লেনের একটি প্রেস থেকে পুনরায় প্রকাশনা শুরু হয়। ঢাকায় আসার পর সম্পাদক আবদুল মান্নান চৌধুরী বিশ^বিদ্যালয়ে অধ্যাপনায় নিয়োজিত হন। আমি তখন পত্রিকাটির প্রকাশক ও সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। এই ক্ষেত্রে কুমিল্লা প্যানোরমার আবু ভাই সার্বক্ষণিক সহযোগিতা করেছেন। এখানে উল্লেখ করা দরকার যে, ঢাকায় আসার পর তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানও একদিন দৈনিক বাংলাদেশ নাম দিয়ে পুনঃপ্রকাশের চেষ্টা করে। আমরা তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ করার পর সম্ভবত পরের দিনই তারা ‘দৈনিক বাংলা’ নাম নিয়ে পত্রিকা ছাপা শুরু করে।

অবশ্য ঢাকায় আসার পর আমরা ‘সাপ্তাহিক বাংলাদেশ’-এর মাস্ট হেডে একটা সংযোজন করি। ‘মুক্তাঞ্চলে প্রকাশিত প্রথম সাপ্তাহিক’ শব্দমালাটি বাংলাদেশ শিরোনামের উপরে সংযোজন করি। তবে অসুবিধা একটা দেখা দিল। অন্যের প্রেসে বসে তো আর একটা পত্রিকার যাবতীয় কাজ করা যায় না। একটা অফিস দরকার। আলাপচারিতায় তখন এগিয়ে এলেন তৎকালীন আদমজী ইন্স্যুরেন্স কোম্পানী লিমিটেডের চিফ ম্যানেজার সৈয়দ হাবিবুল হক। তিনি আদমজী বিল্ডিংয়ের নিচতলায় আমাদের অফিসের জন্য একটা স্পেস ব্যবস্থা করে দিলেন। অফিস তো পেলাম। ছাপাব কোথায়? খুঁজতে খুঁজতে পেলাম টয়েনবি সার্কুলার রোডে বুক প্রমোশন প্রেস। ম্যানেজার লোকটি অনেক সহযোগিতা করল। জানলাম, প্রেসটির মালিক পলাতক। পরে অবশ্য সরকার ফরিদপুরের একজন ভদ্রলোককে প্রেসের প্রশাসক নিয়োগ দেন। আমরা প্রশাসকের সঙ্গে সহযোগিতা করে পত্রিকাটি নিয়মিত প্রকাশের ব্যবস্থা করি। সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশনায় যা হয়Ñ মাঝেমধ্যেই টাকাপয়সার টানাটানিতে হয়তো সময়মতো ছাপাখানা থেকে বের করতে পারিনি।

এভাবেই চলছিল। মনি ভাই তখন যুবলীগ প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। আমরাও সম্পৃক্ত হলাম। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা হলো। সৈয়দ রেজাউর রহমান প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং আমি সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পাই। সম্পাদনার সঙ্গে সাংগঠনিক কাজও চালিয়ে যাচ্ছি। অর্থের অনটন তো আছেই। পত্রিকা সম্পাদনা করার সময় দুটো হেডলাইন এখনো আমার মনে পড়েÑ ‘বঙ্গবন্ধু ১০ই জানুয়ারী ঢাকা ফিরছেন।’ এই শিরোনামটি একমাত্র আমাদের পত্রিকাতেই এসেছিল। অপর শিরোনামটি ছিল: ‘মুক্তিযুদ্ধ কি কেবল সশস্ত্র বাহিনী করেছে?’ শেষ শিরোনামটি যুদ্ধপরবর্তী স্বাধীনতাযুদ্ধের শৌর্যবীর্য প্রদর্শনকারীদের পদক প্রদান উপলক্ষ্যে সাধারণ নাগরকিদের উপেক্ষার কারণে। অবশেষে পঁচাত্তরের জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ থেকে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। যতদিন পত্রিকাটি প্রকাশিত হয়েছে, আমরা সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে, সাহস নিয়েই পত্রিকাটি প্রকাশ করেছি।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ