Search
Close this search box.

১৫ ও ২১ আগস্টের নৃশংসতা হচ্ছে মহাকালের মহা অপরাধ

১৫ ও ২১ আগস্টের নৃশংসতা হচ্ছে মহাকালের মহা অপরাধ

রাশেক রহমান

২১ আগস্ট ২০০৪। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পথপরিক্রমার ইতিহাস ও ক্যালেন্ডারে আরেকটি রক্তস্নাত দিন বা তারিখ। পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্টের পরে সবচেয়ে নৃশংসতম প্রাণপাত ঘটনা। ২১ আগস্টের গ্রেনেড ও বন্দুক হামলার যুগপৎভাবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট আছে। এ হামলার পেছনে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টাকে সাদা চোখে দেখা যায়। তবে যা দেখা যায়নি বা উপলব্ধি করতে আমরা এখনও সক্ষম হয়নি সেটা হলো– শেখ হাসিনাকে হত্যা করে সন্ত্রাসবাদী কুশীলবরা কোন লক্ষ্যে পৌঁছাতে চেয়েছিল বা তাদের সুদূরপ্রসারী এজেন্ডা কী ছিল?

দৃশ্যমান প্রেক্ষাপটে মনে হয় যেন, তারেক জিয়া স্থায়ীভাবে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য তার মায়ের সহযোগিতায় এই জঙ্গিবাদী ঘটনাটি ঘটিয়েছে। কিন্তু সে প্রেক্ষাপটের পাশাপাশি আরও গভীর ও সূক্ষ্ম অনেক কারণ এবং উদ্দেশ্য ছিল, যা আজও জাতির কাছে অজানা। ২১ আগস্টের ঘটনাকে শুধু সেদিন বিকালের দৃশ্যপটে বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করলে হবে না। তাহলে অনেক কিছুই আড়ালে চলে যাবে। এটির পূর্বাপর অনেক বিষয়কে এই ঘটনার সূত্রে মেলাতে হবে। যেমন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল চট্টগ্রামের সিইউএফএল ঘাট থেকে ১০ ট্রাকভর্তি অস্ত্রের চালান আটক হওয়ার ঘটনা। বিচারিক পর্যবেক্ষণ ও রায়ে যে ঘটনার সঙ্গে জড়িত হিসেবে সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির, যুদ্ধাপরাধী মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়া, দুটি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৪ জনকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে এ ঘটনার পরিসর ও পর্দার আড়ালের কুশীলবদের তালিকা আরও বড়। সেটা উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন। এছাড়া, ২০০৩ সালে বগুড়ার কাহালু থানায় আনারস বোঝাই একটি ট্রাক থেকে প্রায় ৪০ হাজার অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করে পুলিশ। এত অস্ত্র এত গোলাবারুদ কেন? সে সময়ে দেশে তো কোনও গৃহযুদ্ধ চলছিল না! তাহলে কি আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করতে এই বিপুল অবৈধ অস্ত্রের আমদানি? এ প্রশ্ন সঙ্গত।

ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থান খুবই গুরুত্ব বহন করে। ভারত, মিয়ানমার, চীন সবার জন্য বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে ভারতের উত্তর ও পূর্ব, পশ্চিম অঞ্চলের যে ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-নিরাপত্তা বিষয়ক বাস্তবতা তার সঙ্গে ২১ আগস্টের একটি সূক্ষ্ম সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ১৯৯৬-২০০১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বৈশ্বিক পরিমণ্ডল তথা আঞ্চলিক ভূ-কৌশলগত সমীকরণে যে অগ্রগতি ও সক্ষমতা অর্জন করেছিল, তা ছিল ঈর্ষণীয়। আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আঞ্চলিক শান্তি যখন বিশ্ব দরবারে এগিয়ে যাওয়ার অন্যতম নিয়ামক বা শর্ত, সে সময় ভারত বাংলাদেশ তথা সার্কভূক্ত অঞ্চলে নতুন অশান্তি দানা বাঁধাতে পারা মানে চিরকালীন অপশক্তিসমূহের সমকালীন উদ্ভবের নতুন পথ সৃষ্টি হওয়া। ঠিক সেভাবেই অপশক্তিসমূহ বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তায় বাংলাদেশকে আবারও পিছিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সে চক্রান্তের বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে বাংলা ভাই, শায়খ আব্দুর রহমান গংদের আস্ফালন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা, ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশব্যাপী পাঁচ শতাধিক বোমা হামলা। তবে ২১ আগস্টের ঘটনাটি অন্য সকল সন্ত্রাসবাদী দৃষ্টান্তকে ছাপিয়ে চরম মাত্রা ধারণ করে। এ হামলায় যে মারণাস্ত্র বা গ্রেনেড জঙ্গিরা ব্যবহার করেছিলো তা কতটা বিধ্বংসী ছিল? সেগুলো কারা দিয়েছিল? কেন দিয়েছিল সে প্রশ্ন করা খুবই প্রাসঙ্গিক। তবে আজ ২১ আগস্ট ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে পাঠকের কাছে এই প্রশ্ন উপস্থাপন করাই যায় যে, মামলার বিচারিক কার্যক্রম ও দণ্ড তথা নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে ২১ আগস্টকে পেছনে ফেলে আমরা কি সামনে এগিয়ে যেতে পারবো? অবশ্যই পারবো না। কারণ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পেছনের সবকিছু উদঘাটনকল্পে যেমন ট্রুথ কমিশনের কোনও বিকল্প নেই, ঠিক তেমনই জাতির পিতার কন্যাকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অপশক্তিসমূহ কী কী অপলক্ষ্য অর্জন করতে চেয়েছিল, তা জানার জন্য আরেকটি ট্রুথ কমিশন খুবই প্রয়োজন।

আরেকটি বিষয় এখানে বিবেচনায় আনা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, শপথনির্ভর কাঠামোর দায়িত্বশীলতা ও জবাবদিহি। এ কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ, বিচার বিভাগ তথা মাঠ প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। যারা শপথ নিয়েছেন দেশ, জাতি, সংবিধানকে সমুন্নত রাখার। ২১ আগস্টের ঘটনায় তাদের সবার ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। সেজন্য এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার ও পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী, পেছনের অপশক্তি এবং শপথনির্ভর কাঠামোর ব্যর্থতাকে বিচারবিভাগীয় বিবেচনায় নিতে হবে। কেননা, বঙ্গবন্ধুকন্যা একদিকে যেমন বাঙালির আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক মুক্তির প্রতীক এবং গণতন্ত্রের মানসকন্যা, অন্যদিকে ঠিক তেমন তৎকালীন প্রধান বিরোধী দলীয় নেত্রী যার নিরাপত্তার বিষয়টি সংবিধান দ্বারা নিরূপিত ও নিশ্চিত। কিন্তু সেদিন শপথনির্ভর কাঠামো এবং রাষ্ট্রের প্রত্যেকটি স্তর তাকে যেমন নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে ঠিক তেমনভাবে তার ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এখন এসবের মধ্যে কোনটি ব্যর্থতা, কোনটি দুর্বল চিত্তের বহিঃপ্রকাশ, কোনটি ইচ্ছাকৃত এবং কোনটি পরিকল্পিত সে বিষয়গুলো উন্মোচন হওয়া প্রয়োজন এবং সে জন্য প্রয়োজন ট্রুথ কমিশন বা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিশন। হয়তো সবকিছু উন্মোচন নাও হতে পারে, তবে এই উদ্যোগ বা প্রচেষ্টা জারি থাকলে শুদ্ধিকরণের যে অভিযাত্রা সেটি সহজ থেকে সহজতর হবে অবশ্যই। কারণ ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যে প্রজন্মের যোগসাজশ রয়েছে বা যে প্রজন্মের দায় রয়েছে তাদেরকে বিলীন না করা পর্যন্ত যেমন বাংলাদেশ সহজ পথে চলবে না। ঠিক একইভাবে ২১ আগস্টের ঘটনায় হাতে হাতিয়ার তুলে দেওয়া বা হাতে হাতিয়ার দেখে চুপ করে থাকা অথবা হাতিয়ার প্রয়োগ করার পরও নিষ্ক্রিয় থাকায় যে প্রজন্মের সংশ্লিষ্টতা ও দায় রয়েছে, তাদেরকেও যতক্ষণ না চিহ্নিত বা দূরীভূত করা যাবে ততক্ষণ বাংলাদেশ নিরাপদে এগোতে পারবে না। আজ যখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজ মুখে বলেন যে, চারিদিক থেকে চক্রান্ত হচ্ছে তাঁকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য, তখন আমার পূর্বোক্ত কথাটিই প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অদম্য স্পৃহায় এগিয়ে যাচ্ছে। এই অভিযাত্রা গত এক দশকের। তবে এ যাত্রা মসৃণ নয়। এ যাত্রা শ্বাপদসংকুল। দেশবিরোধী শ্বাপদরা নানারূপে ও ভূমিকায় বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা রুখতে চেষ্টা করেছে এবং করছে। শাপলা চত্বরে হেফাজতের তাণ্ডব, ২০১৩-১৪ সালে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বে পেট্রোল বোমার লেলিহান ও মানুষ পোড়ানোর নষ্ট রাজনীতি, নাসিরনগর ও রামুতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, ফেসবুকে গুজব সৃষ্টি করে সংখ্যালঘুদের ওপরে হামলা, পদ্মাসেতু নিয়ে মিথ্যাচার ও নির্মাণকর্ম বন্ধের অপচেষ্টাসহ এমন নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে এবং হচ্ছে। তবুও দেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং যাবে। করোনার মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকালীন বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলা করে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।

সবশেষে বলতে চাই, ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্টের নৃশংসতা হচ্ছে মহাকালের মহা অপরাধ। এই বর্বরতার বিচারের ব্যপ্তি সম্প্রসারণ বড় বেশি প্রয়োজন যেখানে অভিযুক্ত ও অপরাধ প্রতিরোধে নির্লিপ্ত সকলেই দায়ী হবে। এই সম্প্রসারণের মধ্যেই আছে সংকট প্রতিরোধের সম্ভাবনা। এই সম্প্রসারণের মধ্য দিয়েই নিশ্চিত হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাস্নাত নিরাপদ ও শান্তির বাংলাদেশ।

লেখক: বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় প্রচার ও প্রকাশনা উপকমিটির সদস্য।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ