Search
Close this search box.

ইতিহাসের কালো অধ্যায়

ইতিহাসের কালো অধ্যায়

মো. সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা একটি কালো অধ্যায় হিসেবে পৃথিবীব্যাপী পরিচিতি পেয়েছে। জাতি হিসেবে যা আমাদের জন্য লজ্জার ও অস্বস্তির। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রকাশ্য জায়গায় কোন রাজনৈতিক দলের সমাবেশে এ ধরনের নজিরবিহীন ঘটনা কোন সরকারের সময়ই ঘটেনি, একমাত্র ব্যতিক্রম ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এ আহূত আওয়ামী লীগের সমাবেশটি। সমাবেশ উপলক্ষে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতৃবর্গ মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে জড়ো হয় এবং ব্যাপক লোকসমাগম হয় জনসভাটিতে। সমাবেশে দলটির সভানেত্রী ও তৎকালিন বিরোধী দলীয় নেত্রীর ভাষণ প্রদানের সময় রাজনৈতিকভাবে অপশক্তি, ষড়যন্ত্রের হোতা, জঙ্গিবাদি গোষ্ঠীর মদদদাতাদের আশ্রয় প্রশ্রয়ে হামলাটি পরিচালিত হয়। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই মুহুর্মুহু গ্রেনেড বিস্ফোরণে মানুষ হতবিহবল হয়ে পড়ে। ইতিহাসের এ জঘন্য হামলায় ২৩ জন মানুুষ নিহত হয় এবং আহত হয় ৫০০ জন। অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, আহতদের যেন ঠিকভাবে চিকিৎসা প্রদান করা না হয় সে ব্যবস্থাও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রটি সম্পন্ন করেছিল। মহিলা লীগের নেত্রী আইভি রহমানের চিকিৎসার গাফিলতির চিত্র তাদের স্বজনদের মাধ্যমে আমরা জেনেছি। আহতদের অনেকেই এখনো এ হামলার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন, প্রত্যেক বছরে ২১ আগস্টের প্রাক্কালে আহতদের করুণ আর্তনাদের চিত্র সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ হামলায় কানে ব্যাপকভাবে আঘাত পান এবং সেটির রেশ তিনি এখনো বয়ে বেড়াচ্ছেন। হামলাকারীদের মূল টার্গেট-ই ছিল শেখ হাসিনাকে হত্যা করা এবং সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতে সকল পক্ষ একত্রিত হয়ে হামলাটি পরিচালনা করে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় ভাগ্যগুণে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রাণে বেঁচে যান, তবে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে রক্ষা করতে যেয়ে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতারা যে মানবঢাল তৈরি করেছিলেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সেটি খুবই তাৎপর্য বহন করে।

১৫ আগস্টে যেভাবে জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যা করা হয় (বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা বিদেশে থাকায় প্রাণে বেঁচে যান) ঠিক তেমনিভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকে নিশ্চিহ্ন করার মানসিকতায় প্রতিক্রিয়াশীল গোষ্ঠী ২১ আগস্টের সমাবেশে গ্রেনেড হামলা ঘটিয়ে ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এ দিনে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জাতির জনকের জ্যেষ্ঠ কন্যা, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ দলের নেতাদের পুরোপুরি নিঃশেষ করার সকল প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেছিল চক্রটি। অথচ হামলার পরপরই জাতীয় সংসদে এ ঘটনার জন্য তৎকালিন সরকার প্রধান আওয়ামী লীগকেই দোষারোপ করে। এখন সবকিছুই প্রকাশ্যে চলে এসেছে, মিথ্যা জজ মিয়া নাটকেরও অবসান হয়েছে। মামলার রায়ে যে সকল রাঘববোয়ালদের শাস্তি হয়েছে তাতে সহজে প্রতীয়মান হয় যে, ঐ সময়ে বিরোধীদলীয় নেত্রীর রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার সঙ্গে রাষ্ট্রযন্ত্র সরাসরি জড়িত ছিল। এ মামলার অন্যতম মুখ্য আসামী হিজবুত তাহরীর নেতা মুফতি হান্নানের সাক্ষ্য গ্রহণের মাধ্যমেই মামলার গতিবিধি নতুন রূপ পায় এবং মামলার রায়ে বিজ্ঞ আদালত তৎকালিন সময়ের দায়িত্বপ্রাপ্তদের দোষী সাব্যস্ত করে।

সংসদীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে শক্তিশালী বিরোধী দল গণতন্ত্রের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করে, সেক্ষেত্রে বিরোধী দল সরকারের নানাবিধ ভুল ত্রুটিকে সামনে নিয়ে এসে সরকারকে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করে। এমনটিই হয়ে থাকে সাধারণত, কিন্তু একটি রাজনৈতিক দলকে ধ্বংস করে দেওয়ার যে মহাপরিকল্পনা সেটির সুস্পষ্ট উদাহরণ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে নির্ণীত করা সম্ভব হয়। এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকাসহ পুরো দেশের মানুষ ভয়ে ভীত স্বন্ত্রস্ত্র হয়ে পড়েছিল, যে কোন সময় যে কোন ধরনের বোমাবাজি কিংবা হামলার স্বীকার হওয়ার সম্ভাবনা ছিল আপামর জনসাধারণের। কেননা ২০০১-২০০৫ সরকারের শাসনামলে জঙ্গিদের কার্যক্রম পরিচালনার স্বর্ণযুগ ছিল, পুরো দেশে তারা তাদের কার্যক্রমকে বেগবান করতে সক্ষম হয়েছিল। জেএমবির শীর্ষস্থানীয় দুই নেতা বাংলা ভাই ও আব্দুর রহমানের সঙ্গে তৎকালিন সময়ের মন্ত্রীদের যোগসাজশের বিষয়টি পরবর্তীতে খোলাসা হয়। ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করার সিঁড়ি হিসেবে তারা জঙ্গিদের মদদ দিয়েছিল। এদিকে, মুফতি হান্নানের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে গ্রেনেড হামলায় অভিযুক্ত তৎকালিন মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আব্দুস সালাম পিন্টুকে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।

মৌলবাদি অপশক্তি সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে ফায়দা লুটার প্রচেষ্টায় লিপ্ত থাকে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ভাগ বসানোর উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে জনবিরোধী কর্মকান্ড পরিচালনা করে থাকে। তাদের এ প্রচেষ্টাকে যখন রাষ্ট্রযন্ত্র মদদ প্রদান করে তখন সেটি নিশ্চিতভাবেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস (ংঃধঃব ঃবৎৎড়ৎরংস)। সুতরাং ২১ আগস্টের ঘটনাটিকে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হিসেবে আখ্যায়িত করা যায়। কেননা তাদের যে দূরভিসন্ধি ছিল সেটি সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হলে সাধারণ মানুষ ভয়ের সংস্কৃতিতে নিমজ্জিত হয়ে যে কোন সময় যে কোন পরিস্থিতিতে আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে তটস্থ থাকত। ২১ আগস্টের ঘটনাটি ছিল পূর্বপরিকল্পিত, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় টিকে থাকার কৌশলের অংশ, দেশি বিদেশী চক্রান্তের মিলিত উদ্যোগ, বিরোধী শক্তিকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলোর একীভূত ইন্ধনই গ্রেনেড হামলার ক্ষেত্রে ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করেছে। তাছাড়া স্বাধীনতা বিরোধীরা বঙ্গবন্ধু কন্যাকে চিরতরে নি:শেষ করে দেওয়ার জন্য অসংখ্যবার চেষ্টা করেছে, কারণ তারা জানে বঙ্গবন্ধুর রক্ত যার শরীরে তিনি স্বাধীনতা বিরোধীদের জন্য শক্তিশালী প্রতিপক্ষ হয়ে জনগণকে একাত্ন করে গণআন্দোলনের ডাক দিবেন। তাই তাদের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকে শেষ করে দিয়ে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে স্থায়ী সংকট সৃষ্টি করে ক্ষমতার মসনদ পাকাপোক্ত করা। ইতিহাসবিদ মুনতাসির মামুন বলেন, ‘এদেশে শেখ হাসিনাকে ২৩ বার হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে’। স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত শক্তিরা বিশ^াস করে ও জানে, বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্থ করতে হলে শেখ হাসিনাকে শেষ করে দিতে হবে এবং এর কারণেই তারা বিভিন্নভাবে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

এবারের আগস্টে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, গ্রেনেড হামলার বিচারে যাদের শাস্তি প্রদান করা হয়েছে তাদের প্রত্যেককে বিচারের মুখোমুখি করে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। ঘোষিত রায়ে যাদেরকে পলাতক দেখানো হয়েছে কিংবা যারা পলাতক আছে তাদেরকে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা জানি, বিশ্ব রাজনীতি (global politics) ও বিশ্বায়ন (globalization)-এর কারণে জঙ্গিবাদের নেটওয়ার্ক বিশ^ব্যাপী বিস্তৃত এবং জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো এ সুযোগকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে জঙ্গিরা অনলাইন মাধ্যমে প্রচার প্রচারণার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও প্রদান করে থাকে এবং উচ্চশিক্ষিত বিপথগামী ছেলেমেয়েরা যুক্ত হচ্ছে। এছাড়া, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হতে জঙ্গিরা প্রশিক্ষণ নিয়ে বাংলাদেশে এসে তাদের কর্মপরিধিকে বিস্তৃত করার প্রয়াসের প্রচেষ্টা আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি। তবে বর্তমান সরকার জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় বিশে^ রোল মডেল এবং যে কেউ এক বাক্যে এতে সরকারের সাহসিকতা ও বিচক্ষণতার প্রশংসা করতে বাধ্য। তথাপি গ্রেনেড হামলায় দোষী সাব্যস্ত পলাতকদের দেশে ফেরত এনে বিচার নিশ্চিত করতে হবে, না হলে ষড়যন্ত্রের কলকাঠি নেড়ে জঙ্গিদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তারা কাজ করবে এবং বাংলাদেশকে একটি অপরাধের অভয়ারণ্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার নেপথ্য কারিগর হিসেবে কাজ করবে।

পঁচা আপেল তত্ত্বানুযায়ী, যখন কোন আপেল পঁচে যায় তখন সেই পঁচা আপেলটিকে সরিয়ে ফেলতে হয়, না হলে পঁচা আপেলের কারণে অন্যান্য আপেল নষ্ট হয়ে যায়। ঠিক তেমনিভাবে যারা ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার অভিযোগে অভিযুক্ত তাদের থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে, উদীয়মান তরুণ সমাজকে রক্ষা করতে হবে, দেশের মানুষকে রক্ষা করতে হবে এবং তার জন্যই তাদের বিচারকাজ আইন, বিধি-বিধান ও প্রক্রিয়া অনুসরণ করে দ্রুত রায় কার্যকর করতে হবে। অন্যদিকে যে বিষয়টি খুবই জরুরী তা হচ্ছে জঙ্গি সংশ্লিষ্ট যারা জামিনে আছেন কিংবা সাজা শেষে মুক্ত হয়ে চলাচল করছেন তাদের বিষয়ে ব্যাপক খোঁজখবর রাখতে হবে। একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত তাদেরকে মনিটরিং এর আওতায় রাখতে হবে এবং যখন নিশ্চিত হওয়া যাবে তিনি বা তাদের মাধ্যমে কোনরূপ অপকর্ম হওয়ার সুযোগ নেই তখন তাদের থেকে নজরদারি সরিয়ে নিলেও হবে। কেননা জঙ্গিবাদ সবসময় একটি বৈশি^ক হুমকি হিসেবে আমাদের মোকাবেলা করতে হবে। সে জন্য স্কুল কলেজের পাঠ্যপুস্তকে জঙ্গিবাদ নিয়ে প্রবন্ধ, গল্প অন্তর্ভুক্ত করে এর ভয়াবহতা ও প্রভাব নিয়ে শিক্ষার্থীদের সচেতন করার কাজটি জোরালোভাবেই করতে হবে। জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণু নীতির যে ধারাবাহিকতা চলমান সেটি বজায় রাখতে হবে, আপনি যেই হোন না কেন জঙ্গি কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করা, জঙ্গিদের মদদ দেওয়া, আর্থিক সাহায্য প্রদান, তথ্যসহ জঙ্গিদের যে কোন ধরনের সহযোগিতার প্রমাণ সাপেক্ষে আপনার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইনে দ্রুতগতিতে বিচারকাজ শেষ করে শাস্তি প্রদান করতে হবে। তড়িৎগতিতে আইনি প্রক্রিয়ায় শাস্তি প্রদানের মাধ্যমে সাধারণত অন্যদের জন্য বার্তা ও উদাহরণ সৃষ্টি করা যায়। আমরা মনে প্রাণে চাই, বাংলাদেশ কখনোই অপরাধীদের অভয়ারণ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হউক, ২১ আগস্টের ন্যাক্কারজনক ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটুক এ দেশে এবং সাথে সাথে ২১ আগস্টের হোতাদের যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত এবং যাদের বিরুদ্ধে রায় ঘোষিত হয়েছে প্রত্যেকের শাস্তি নিশ্চিত করা হউক।

লেখক-সহকারী অধ্যাপক ও সভাপতি, ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ