Search
Close this search box.

রোহিঙ্গা : স্বদেশই হোক তাদের স্থায়ী ঠিকানা

দুলাল আচার্য 

বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের পঞ্চমবর্ষপূর্ণ হচ্ছে আজ। মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করতে সর্বশেষ পাঁচ বছর আগে এইদিনে তাদের ওপর নৃশংস হত্যা-ধর্ষণ, হামলা চালায় মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এর আগেও একাধিকবার মিয়ানমার সরকার তাদের নাগরিক রোহিঙ্গাদের অত্যাচার-নির্যাতন করে বাংলাদেশে তাড়িয়ে দিয়েছিল। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টে শুরু হওয়া ওই সেনা অভিযানের পরের পাঁচ মাসে প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে আরও প্রায় ৪ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করত। সেই ১৯৭৮ সাল থেকে শুরু করে শেষ পর্যন্ত প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে।

মানবিকতার চরমতম বিপর্যয়ের দৃষ্টান্ত মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। কয়েক যুগ ধরে তারা স্বভূমির সামরিক জান্তার নির্মমতার শিকার হয়ে বাংলাদেশে শরণার্থী হচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ হিসেবে এই মানবিক বিপর্যয় বাংলাদেশের জন্য সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে ব্যথিত করেছে এই মানবিক বিপর্যয়। তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন, নানাসময় ছুটে গেছেন আশ্রয় শিবিরে। নিজে দেখেছেন এই অমানবিক অপরাধের চিহ্ন। কথা শুনেছেন নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের। দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, মিয়ানমারের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চাই, তবে তাদের অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করা হবে না। এখনও সহায়তার দরজা খোলা রেখেছেন মানবিকতার ছায়ায়। তিনি বিভিন্ন সময় আশ্বাস দিয়ে বলেছেন, শরণার্থীদের পাশে তিনি আছেন। মায়ানমার ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত তিনি তাদের পাশে থাকবেন।

একথা সত্য যে, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে অবস্থা, তাতে এই বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে দীর্ঘ সময় আশ্রয় দেয়া আমাদের মতো দরিদ্র দেশের জন্য সত্যিই অসম্ভব। সীমিত সাধ্যের মধ্যেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শরণার্থীদের পাশে রয়েছেন। তাদের থাকা, খাওয়া এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করছেন। এই চাপ বাংলাদেশের জন্য সত্যিই চ্যলেঞ্জ। শেখ হাসিনা মানবিক হৃদয় দিয়ে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে চলেছেন। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি মানবিক মনোভাবের পরিচয় দেয়ায় বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ বিশ্বে একটি আলোচিত নাম। পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে নিজের অবস্থান আগেই তৈরি করেছেন। এখন মানবিকতায়ও। বর্বর নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয়-সেবা দিয়ে বিশ্বে ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ব্রিটিশ মিডিয়া চ্যানেল ফোর সে সময় তাকে আখ্যায়িত করেছিল ‘মানবতার মা’ হিসেবে। তিনি সর্বহারা রোহিঙ্গাদের পরম মমতায়, মাতৃস্নেহে যেভাবে আঁকড়ে ধরেছেন সেই দৃশ্য বিশ্ববাসীকে কাঁদিয়েছে, ভাবিয়েছে।

আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবতাবাদী নেতা ছিলেন। সারা বিশ্বে তার পরিচিতি ছিল শোষিত মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে। তার কন্যা শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায়। পাঁচ বছর অতিবাহিত হলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে সারা বিশ্বের দৃষ্টি এখনও বাংলাদেশ তথা শেখ হাসিনার দিকে। শেখ হাসিনা এখানে মধ্যমণি। তিনি আজ বিশ্বে শান্তিকামী মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে সমহিমায় উদ্ভাসিত।

মানবিক কারণে আশ্রয় দিলেও শুরু থেকেই বাংলাদেশের লক্ষ্য ছিল যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি। ২০১৭ সালের নভেম্বরেই মিয়ানমারের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে চুক্তি সই করেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, নানা সময়ে মায়ানমারের নানা অজুহাতে সময়ক্ষেপণে কারণে তাদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া এখনও শুরু করা যায়নি। শিগগিরই প্রত্যাবাসন শুরু হবে এমন কোনো লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে দুই দেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনাও শুরু হয়নি। সেই কোন আন্তর্জাতিক উদ্যোগও। অথচ মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের মূল হোতারা দেশটির ক্ষমতায় আসীন। তাদের পক্ষ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার কোনো বার্তা বা আভাস এখনও নেই।

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় গতি আনতে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের আগ্রহে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকায় যুক্ত হয় চীন। বাংলাদেশ-চীন-মিয়ানমার ত্রিপক্ষীয় আলোচনাও একাধিকবার হয়েছে। সেখানেও আশার বাণী শোনা যায় না। বরং প্রত্যাবাসনের আলোচনার চেয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের জীবনমান উন্নয়নেই তাদের মনোযোগ বেশি। যদিও চীনের সরাসরি মধ্যস্থতায় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার ২০১৯ সালের ২২ আগস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সময়সীমা ঠিক করেছিল। এ জন্য কক্সবাজারের শিবিরে গিয়ে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন চীনের কর্মকর্তারা। সে মোতাবেক তালিকাও করা হয়েছিল। কিন্তু মিয়ানমারের নাগরিকত্বসহ রোহিঙ্গাদের পক্ষে দেয়া শর্তগুলো পূরণ না হওয়ায় শেষমুহূর্তে থেমে যায় সবকিছু। এর আগে ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের প্রথম তারিখ ঠিক করেছিল বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, সেটিও ব্যর্থ হয়।

আজ এটা স্পষ্ট যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের শুরুর বাস্তব সম্ভাবনা এই মুহূর্তে দৃশ্যমান নয়। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে জোর দেয়া ছাড়া সামনে কোনো বিকল্প নেই। বিশ্লেষকরা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বাংলাদেশের প্রতি যতটা যৌক্তিক ও সহানুভূতিশীল আচরণ করা উচিত, সেটি তারা করছে না। উলটো বাংলাদেশকে রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকার নিশ্চিতের নানা পরামর্শ দিচ্ছে। এমনকি এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাষানচরে স্থানান্তরে বাংলাদেশের উদ্যোগকে ভালো চোখে দেখেনি কিছু সংস্থা। তাই ধারণা করা যায়, একটা লম্বা সময়ের জন্য রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে থেকে যাবে। তাই রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি বিশ্বের সামনে কূটনৈতিক পর্যায়ে নিয়ে আসা জরুরী। প্রত্যাবাসনের জন্য এককভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে জাতিসংঘসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন পক্ষকে সঙ্গে নিতে আরও সক্রিয় হওয়া দরকার। আমরা চাই, স্বদেশই হোক রোহিঙ্গাদের স্থায়ী ঠিকানা। বাস্তবে জাতির পিতার মতো ‘সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়’- এই নীতি ধারণ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিশ্বের যে কজন নেতাকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সম্মান ও গুরুত্ব দেয় শেখ হাসিনা তাদের অন্যতম। শুধু রোহিঙ্গা প্রসঙ্গই নয়, এ অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শেখ হাসিনার অনন্য ভূমিকা রেখে আসছেন। ১৯ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৯৭ সালের পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তি বাহিনীর সঙ্গে ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে পাহাড়ে পাহাড়ি-বাঙালির নিরাপদ আবাস গড়ে তোলেন তিনি। এই চুক্তি পাহাড়ে সশস্ত্র বিদ্রোহের অবসান ঘটায়। এর আগে দীর্ঘদিন এই অঞ্চলের মানুষ নিজদেশে পরবাসীর মতো জীবন যাপনে বাধ্য ছিল। শেখ হাসিনা প্রায় ৬৮ বছর পর ছিটমহলবাসীর বন্দি জীবনের অবসান ঘাটিয়ে নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়েছেন।

১৯৪৭ সালের পর ২০১৬ সালে এসে স্বাধীন দেশের নাগরিকত্ব পায় ১৬২টি ছিটমহলের হাজার হাজার মানুষ। শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভারতের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এই মানবতার মেলবন্ধন রচিত হয়। আমাদের বিশ্বাস, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানও শেখ হাসিনার হাত ধরে বেরিয়ে আসবে। কারণ, শেখ হাসিনার হাতেই বাংলাদেশ নিরাপদ। যদিও এই মুহূর্তে আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার পর আঞ্চলিক ও ভূরাজনীতিতে রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি সেভাবে আলোচনায় থাকবে না। কারণ, বিশ্ব মনোযোগ এখন আফগানিস্তানের দিকে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গা ইস্যু বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরতে কূটনৈতিক দৃঢ়তার পরিচয় দিতে হবে বাংলাদেশকে। এই ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ও আলোচনা দুটোই চালিয়ে যেতে হবে। আমরা চাই, রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণ প্রত্যাবাসন হোক- তাদের স্বদেশভূমিতে।

লেখক : সাংবাদিক

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ