ফিরোজ মান্না
রোহিঙ্গা সমস্যা সহজেই দূর হচ্ছে না । আন্তর্জাতিক মহলের ওপর বাংলাদেশের কুটনৈতিক প্রভাব তেমন একটা পরেনি রোহিঙ্গা ইস্যুতে। ফলে সামরিক অভিযানে লাখ লাখ রোহিঙ্গা মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করার পর এ নিয়ে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে ২০১৭ সালের ২৫ আগষ্ট লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী প্রবেশ করে। পাঁচ বছর পার হলেও রোহিঙ্গা নিজ দেশে ফেরাতে দেশি বিদেশি কোন উদ্যোগ কাজে লাগেনি। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফেরত নেবে কিনা এমন কোন আলামত আপাত দেখা যাচ্ছে না। বরং বিষয়টি দিন যত যাচ্ছে তত জটিল হচ্ছে। পাশর্^বর্তী প্রভাবশালী দেশ গুলোও রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর বিষয়েও কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা হলে মিয়ানমারের জান্তা সরকার এ বিষয়ে কোন কর্ণপাত করছে না। এখন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জন্য নানা সমস্যার কারণ হয়ে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে কুটনৈতিক তৎপরতাও তেমন উল্লেযোগ্য নয়। মিয়ানমার থেকে কয়েক লাখ লাখ মানুষ প্রবেশ করে বাংলাদেশে।
সেই সময় মিয়ানমার সরকার দাবি করে রাখাইন রাজ্যে দেড়শোর মতো মুসলিম জঙ্গি এক যোগে বিভিন্ন পুলিশ স্টেশন, সীমান্ত ফাঁড়ি এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালানোর পর অন্তত ৭০ জন নিহত হয়েছে। মিয়ানমারের নেত্রী অন্য সান সু চির অফিস থেকে বলা হয়, নিহতদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্য রয়েছে। এই খবর যখন সংবাদমাধ্যমের প্রচার হচ্ছিল তখনো ধারণা করা যায়নি। পরে গোটা রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গাদের নির্মম নির্যতন করে তাড়ানো হয়। একই দিন মিয়ানমার বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা টেকনাফের নাফ নদী দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রবেশের চেষ্টা করে। বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয় তারা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে এবং কোনভাবেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে প্রবেশ করতে দেবে না। প্রথম কয়েক দিন বাংলাদেশ সীমান্ত বাহিনী বাংলাদেশে প্রবেশের ক্ষেত্রে কড়াকড়ি করলেও পরে তাদের প্রবেশ করতে দেয়। এর পর থেকেই পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। শুরু হয় সীমান্ত পাড়ি দিয়ে স্রোতের মত রোহিঙ্গা মুসলমানদের বাংলাদেশে প্রবেশ। নাফ নদী পার হয়ে ছোট ছোট নৌকায় তারা আসতে থাকেন দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা জুরে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা মুসলমান জনগোষ্ঠী আশ্রয় নেয় বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের জেলা কক্সবাজারের বিভিন্ন উপজেলায়। তার মধ্যে টেকনাফ এবং উখিয়া অন্যতম।
বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থী বা উদ্বাস্তু বলতে মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে আগত রোহিঙ্গা শরণার্থী বা উদ্বাস্তুদের বুঝানো হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসের হিসেব অনুযায়ী, ২৫ আগস্ট ২০১৭ সালে মায়ানমারের সামরিক বাহিনীর দ্বারা শুরু হওয়া গণহত্যা থেকে পরিত্রাণ পেতে প্রায় ৬ লাখ ৫৫ হাজার থেকে ৭ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। বিগত তিন দশক ধরে মায়ানমার সরকারের সহিংস নির্যাতন থেকে আরও ৩ লাখের বেশি অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসে অবস্থান করছে। এ মুহূর্তে কক্সবাজারে সব মিলিয়ে অন্তত ১২ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে। তাছাড়া, ভারতের হায়দ্রাবাদের রোহিঙ্গারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে, ফলে মায়ানমারের মতো তারাও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে। ৭৩ তম জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন যে বাংলাদেশে এখন ১ দশমিক ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থী রয়েছে। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলিতে সাম্প্রতিক জনসংখ্যার উপচে পড়া ভিড় তার পরিকাঠামোয় এক চাপ সৃষ্টি করেছে। শরণার্থীদের পরিষেবা, শিক্ষা, খাদ্য, পরিষ্কার জল এবং সঠিক স্যানিটেশনের অ্যাক্সেসের অভাব রয়েছে। তারা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং সংক্রামক রোগ সংক্রমণেও ঝুঁকিপূর্ণ। ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি ও স্যানিটেশন, দুর্যোগ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, এবং সামাজিক সুরক্ষা সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলায় আর্থিক সহায়তায় ৫০ মিলিয়ন ডলার ঘোষণা করেছে। ২০১৯ সালের মার্চে বাংলাদেশ ঘোষণা করেছে যে তারা আর নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীদের গ্রহণ করবে না। ২০১৮ সালের আগস্টে একটি সমীক্ষায় অনুমান করা হয়েছে যে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট ‘নিধন কার্যক্রম’ শুরু হওয়ার পর থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের দ্বারা ২৪ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছিল। এটি আরও অনুমান করা হয়েছিল যে কমপক্ষে ১৮হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম মহিলা ও মেয়ে ধর্ষণ করা হয়েছে। এক লাখ ১৬ হাজার রোহিঙ্গাকে মারধর করা হয়েছিল এবং ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ৩৬ হাজার রোহিঙ্গাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
রোহিঙ্গা মায়ানমারের একটি মুসলিম সংখ্যালঘু জাতি, যাদেরকে অনেক মায়ানমারি বৌদ্ধরা বাংলাদেশের অবৈধ অভিবাসী হিসাবে হিসেবে গণ্য করে। রোহিঙ্গারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে মায়ানমারে বসবাস করে আসছে এবং বাংলাদেশ সরকার মায়ানমার শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার জন্য বলছে। মায়ানমারে তাদের নাগরিকত্ব প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে এবং তাদেরকে বিশ্বের সবচেয়ে অত্যাচারিত সংখ্যালঘু হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। রোহিঙ্গারা মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী এবং চরমপন্থী বৌদ্ধদের হাতে নির্যাতিত। মায়ানমার রোহিঙ্গাদের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। ১৯৭০ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থীরা বাংলাদেশে উদ্বাস্তু হয়ে বাস করতে শুরু করে। ২০১৭ সালের হিসাব অনুযায়ী আনুমানিক ১২ লাখের মতো শরণার্থী বাংলাদেশে অবস্থান করছে। অধিকাংশ শরণার্থী টেকনাফ-কক্সবাজার হাইওয়ে বরাবর অবস্থিত নাফ নদীর সমান্তরালে বাস করে, যা বাংলাদেশ ও মায়ানমার সীমান্তে অবস্থিত। বেশিরভাগ শরণার্থীরা কক্সবাজার বা এর কাছাকাছি অবস্থিত, পর্যটনশিল্পের উপর নির্ভরশীল একটি উপকূলবর্তী এলাকায় বসবাস করছে তারা। বাংলাদেশ মনে করে শরণার্থীদের দ্বারা এলাকাটির পর্যটন প্রত্যাশা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। শরণার্থীদের অপরাধ এবং কক্সবাজারে ২০১২ সালে রামু সহিংসতার জন্যও দোষারূপ করা হয়। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের এদেশে অনাগমনমুখী নীতি তৈরির অনুসরণ করছে। অধিকাংশ শরণার্থী অনিবন্ধিত রয়ে গেছে, শুধুমাত্র ৩২ হাজার শরণার্থী নিজেদের ইউএনএইচসিআর এবং বাংলাদেশ সরকারের সাথে নিবন্ধন করেছে। আনুমানিক ২ লাখের বেশি শরণার্থী অনিবন্ধিত অবস্থায় বাংলাদেশে বসবাস করছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল রিপোর্ট, ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে একটি প্রতিবেদনে বলেছে,মায়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী ধর্ষণ, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, এবং রোহিঙ্গাদের বাসভবন দখলে তত্ত্বাবধান করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে শরণার্থীরা আদিবাসী জনগোষ্ঠী সরিয়ে দিচ্ছে। এছাড়াও তাদের ইয়াবা আমদানি করার জন্য নিন্দা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ সরকার মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। কিন্তু এই মানবিকতার কারণেই এখন নানা ঝুঁকিতে পড়েছে বাংলাদেশ। খুব সহসাই এ সংকটের সমাধান হবে না বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে সারাদেশে রোহিঙ্গাদের ছড়িয়ে পড়ছে। তারা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিভিন্ন দেশে যাচ্ছে। তাদের নিয়ন্ত্রণ করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্প গুলোতে প্রতিনিয়ত অপরাধ কর্মকান্ড সংগঠিত হচ্ছে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধে জড়িয়ে যাচ্ছে। গোলাগুলি করে নিজেরা নিজেরা খুন হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে আছে এইডস আক্রান্ত মানুষ । বাংলাদেশে এখন কলেরা না থাকলেও রোহিঙ্গাদের মধ্যে রয়েছে সেই সমস্যাও । বন উজার হচ্ছে, পাহাড় কেটে ধ্বংস করছে তারা। দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক ঝুঁকিও আছে এর সঙ্গে। আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক সমস্যাও প্রকট হতে পারে, বাড়তে পারে নিরাপত্তা ঝুঁকিও । সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এই সমস্যাগুলো কীভাবে মোকাবেলা করবে সেটা ঠিক করাই এখন একটা চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, রোহিঙ্গাদের নিয়ে সরকারকে এবার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে । না হলে দেশকে কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ৯৭ জন এইচআইভি পজেটিভ। ফলে ওই অঞ্চলে এইডস-এর ঝুঁকি বাড়ছে। তাই এইচআইভি ছড়ানো ঠেকাতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। গত ২৫ আগস্ট থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে সাত লাখের মতো রোহিঙ্গা। নতুন আর পুরোনো মিলে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার বসবাস।
রোহিঙ্গাদের কারণে বাংলাদেশ বড় ধরনের আর্থিক চাপে পড়তে পারে বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সিনিয়র গবেষক ড. নাজনীন আহমেদ তিনি বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পেছনে বাড়তি মনোযোগ দিতে হয়৷ সেজন্য সেখানে পুলিশ, সেনাবাহিনী, বিজিবিসহ বিভিন্ন বাহিনীর লোকজন নিয়োগ করতে হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যয় বাড়ছে। আর এই ব্যয়টা খরচ হচ্ছে বাজেট থেকে। অথচ রোহিঙ্গা সমস্যা না থাকলে এই টাকা অন্য জায়গায় ব্যয় করা যেত। সেটা করা গেলে দেশের কিছু মানুষ তো অন্তত ভালো থাকত। রোহিঙ্গাদের ওই এলাকা থেকে বাইরে আসতে না দিলে ভালো হবে। তাঁদের জন্য আমাদের বড় আকারে সাহায্য দেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেই আমরা এই খরচগুলো পাব। তবে তাঁদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতসহ অন্যান্য কাজে আমাদের কিছু লোকবল ওখানে দেয়া লেগেছে। সেজন্য প্রশাসনিক ব্যয় কিছুটা বাড়তে পারে।
কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে এখন স্থানীয় নাগরিকরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন। দিন দিন পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠছে। এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ জরুরি। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে এক পর্যায়ে দেশ নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়বে। সংকট দীর্ঘমেয়াদি হলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় একসময় এ সব ভুলে যাবে। অন্য সমস্যার ভিড়ে তখন এটা ক্ষুদ্র ইস্যুতে পরিণত হবে৷ পরিবেশ এবং বনভূমির কথা চিন্তা করলে রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ । ওই এলাকায় নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে। ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর স্বাভাবিক জীবন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নিয়ম অনুযায়ী আশ্রিতরা কোনো কাজে নিয়োজিত হতে পারবে না, কিন্তু তারা অল্প পারিশ্রমিকের বিনিময়ে লবণ মাঠ, চিংড়ি হ্যাচারি, চাষাবাদের কাজসহ বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত হয়েছে। এতে স্থানীয় দরিদ্র শ্রমিকরা কর্মহীন হয়ে পড়েছে। উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার আশ্রয় কেন্দ্রগুলোর আশেপাশে শিক্ষাব্যবস্থা একদম ভেঙে পড়েছে৷ অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আশ্রয় কেন্দ্র গড়ে উঠেছে, কিছু কিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেনাবাহিনীসহ অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা অবস্থান করছেন। সেখানে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকেরও কম। স্থানীয় কট্টরপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের কর্মী যোগাতে অনেক রোহিঙ্গা যুবককে কাছে টানছে বলেও অভিযোগ আছে। রোহিঙ্গারা যদি রাজনীতিতে ঢুকে পড়ে তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। এর জন্য তাঁরা দেশীয় দালালদের সহায়তায় ভুয়া জন্মনিবন্ধন সনদ ও জাতীয় পরিচয়পত্র সংগ্রহ করছেন। মাত্র ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে এক সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ন্যাশনাল আইডি (এনআইডি) পাচ্ছে রোহিঙ্গারা। এভাবে এনআইডি নিয়ে তারা সারা দেশে ছড়িয়ে পড়বে। কোনো সম্প্রদায়কে একটি নির্দিষ্ট স্থানে দীর্ঘদিন আটকে রাখা যায় না। ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা তরুণরা সপ্তাহে একদিন রেশন তুলবে আর বাকি দিনগুলো বসে থাকবে, তা হবে না। তাদের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা দেখা দেবে। তারা ক্যাম্প থেকে গোপনে বেরিয়ে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়বে।
রোহিঙ্গাদের অবস্থান দীর্ঘস্থায়ী হলে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্পে ধস নামতে শুরু করেছে। এখনই রোহিঙ্গা নারীদের কক্সবাজারে অবাধে চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে। অনেকে দেহ ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে। এ নিয়ে স্থানীয়রা উদ্বিগ্ন, উদ্বিগ্ন । প্রশাসনও মনে করছে এভাবে চলতে থাকলে কক্সবাজারকে অনেকেই পাশ কাটিয়ে অন্য পর্যটনকেন্দ্রে চলে যেতে পারেন৷ এমনটা হলে কক্সবাজারের পর্যটনে ভয়াবহ ধস নামতে পারে। কক্সবাজারে সাড়ে তিনশ’ হোটেল, মোটেল, গেস্ট হাউস ও কটেজ রয়েছে। পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা নারীদের অনেককেই হোটেল-মোটেলে দেহব্যবসায় পাওয়া যাচ্ছে। এঁদের মধ্যে এইডস আক্রান্তরাও রয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে পর্যটকসহ হোটেল-মোটেল শ্রমিকদের শারীরিক মেলামেশায় বিভিন্ন ধরনের রোগ ছড়িয়ে পড়তে পারে। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, এইডস আক্রান্ত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে স্থানীয় অনেকে দৈহিক সম্পর্কে লিপ্ত হওয়ায় দেশে এইডস ছড়ানোর আশঙ্কা আছে। চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসহ আশপাশের জেলায় তাঁরা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকছেন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের কাছেও তাঁরা আশ্রয় নিচ্ছেন। পুরনো রোহিঙ্গারা স্থানীয় প্রভাবশালীদের ‘ম্যানেজ’ করে নানা রকম অবৈধ ও অনৈতিক কাজে লিপ্ত রয়েছেন। কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বিভিন্ন এলাকায় ইতিমধ্যে অভিযান চালিয়ে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে আটক করে ক্যাম্পে ফেরত পাঠিয়েছে পুলিশ। অভাব অনটনে পড়া রোহিঙ্গা নারীরা যদি কক্সবাজারে অবাধে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে অনেকেই সেখান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারেন। এমনকি দেশের মানুষও পরিবার নিয়ে সেখানে যেতে অনাগ্রহ দেখাবেন৷
দিনে দিনে নিরাপত্তা ঝুঁকি বাড়ছে। রোহিঙ্গাদের মধ্যে কট্টরপন্থি মনোভাবাপন্ন যুবকদের কাছে টানার চেষ্টা করছে বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন। এত বেকার যুবকের মধ্যে হতাশা কাজ করা স্বাভাবিক। জঙ্গি সংগঠনগুলো এই সুযোগ কাজে লাগাতে চাইলে ভয়াবহ বিপর্যয় হতে পারে। মৌলবাদী দলগুলোও যে এই সুযোগ কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে, এমন তথ্যের কথা জানিয়েছেন গোয়েন্দারা৷ রোহিঙ্গা যুবকরা মাদক পাচারে আগে থেকেই জড়িত। বাংলাদেশে ইয়াবা যা ঢোকে তার ৯০ ভাগই মিয়ানমার থেকে। ইয়াবা এখন বাংলাদেশের অন্যতম বড় সমস্যা। তাঁদের এ সব কাজের সুযোগ করে দিচ্ছে এ দেশের কিছু মানুষ। অভিযোগ রয়েছে, এবারও পালিয়ে আসার সময় অনেক রোহিঙ্গা সঙ্গে করে কিছু ইয়াবাও এনেছেন। তাঁরা যখন দলে দলে এখানে ঢোকেন, তখন তাঁদের তল্লাশি করে ঢোকানোর কোনো সুযোগ ছিল না। বলা হচ্ছে আরসার ২০০ সদস্য দা-কুড়াল এবং কিছু ছোট অস্ত্র নিয়ে একই সময়ে সেনা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারসহ ৩০টি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালিয়েছে। তারা এক সময়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। তেমনটা হলে এটা শুধু মিয়ানমারের জন্যই নয়, আশ্রয়দাতা দেশের জন্যও নেতিবাচক হতে পারে। তাই ওইসব শিশুর প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। কক্সবাজারের উখিয়া থেকে টেকনাফ পর্যন্ত সড়কের দু’পাশে কালো রঙের পলিথিন দিয়ে বানানো হয়েছে শত শত ঝুপড়িঘর৷ যতদূর চোখ যায় একই চিত্র। পাহাড়-বনাঞ্চল এখন আর কিছুই চোখে পড়ে না। পাহাড়গুলো কেটে এই ঝুপড়িঘরগুলো বানানো হয়েছে। বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সাড়ে চার হাজার একর পাহাড় কেটে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বসতি করা হয়েছে। এই ঝুপড়িঘরগুলো রোহিঙ্গারা নিজেরাই তৈরি করেছে। ফলে ওই এলাকায় ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটু ভারী বৃষ্টিপাত হলেই ধসে পড়তে পারে পাহাড়। এতে বহু মানুষ হতাহতের আশঙ্কাও করা হচ্ছে।
মানবিক কারণে আমরা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু পাহাড়গুলো কেটে তারা যে আবাসস্থল বানাচ্ছে, তাতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেছে। এক সময় হয়ত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, নতুন করে হয়ত গাছও লাগানো যাবে, কিন্তু পাহাড়গুলোর ক্ষতি আর পূরণ করা যাবে না। অন্য জায়গা থেকে মাটি এনে তো আর পাহাড়ের কাটা জায়গা পূরণ করা যাবে না৷ এই পাহাড়গুলো ১৫-২০ মিলিয়ন বছরের (দেড় থেকে দু’কোটি বছর) পুরনো । পাহাড়গুলো কাটার ফলে এখন বৃষ্টি হলে পাহাড়ের মধ্যে পানি ঢুকে পড়বে । এতে যে কোনো সময় পাহাড় ধসে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটে যেতে পারে। ফলে ক্ষতি যা হওয়ার তা তো হয়েছে । আর যাতে ক্ষতি না হয় সে দিকে নজর দিতে হবে। এখনই ব্যবস্থা না নিলে আমাদের এই ক্ষতি আর পূরণ করা সম্ভব হবে না।
লেখক- সম্পাদক ও প্রকাশক, দৈনিক পথে প্রান্তরে