Search
Close this search box.

পাহাড়ে আবার অশান্তির আগুন

 

 

ফিরোজ মান্না 

পাহাড়ে আবার ভ্রাতৃঘাতী সংঘাত শুরু হয়েছে। জেএসএস, ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ সংস্কার পন্থী ও জেএসএস সংস্কারপন্থী গ্রুপ গুলো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হয়নি এমন দোহাই দিয়ে পাহাড়কে আবার অশান্ত করে তুলেছে। নিজেদের মধ্যে দ্বন্ধ সংঘাত ছড়িয়ে দিচ্ছে সাধারণ পাহাড়ি উপজাতি ও বাঙালি আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। আইন শৃঙ্খলা বহিনীর পক্ষ থেকে পাহাড়কে শান্ত রাখতে যথাসাধ্য চেষ্টা করা হচ্ছে। এরপরেও পাহাড়ে ঘুম খুনের মতো ঘটনা চলছেই।

সম্প্রতি রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার বঙ্গলতলী ইউনিয়নে উত্তর বঙ্গলতলী গ্রাম ও ডুলুবন্যা মাঝামাঝি এলাকায় জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) মধ্যে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ও স্থানীয় বাসিন্দারা পক্ষ থেকে বলা হয়েছে শুক্রবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে উত্তর বঙ্গলতলী গ্রাম ও ডুলুবন্যা গ্রামের মাঝামাঝি এলাকায় জেএসএসের ১০ থেকে ১২ জনের একটি দল ঘোরাফেরা করছিল। তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে ইউপিডিএফের একটি গ্রুপ তাদের ওপর গুলি করে। এ সময় জেএসএস সদস্যরাও পাল্টা গুলি ছোড়ে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি চলে। এ ঘটনায় একজন নিহত হওয়ার খবর মিলেছে। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বিভিন্ন জায়গায় তল্লাশি চালালেও কারো লাশ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। এমন ঘটনায় পাহাড়ে শান্তি বিনস্ট হচ্ছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। বছরের পর বছর ধরে পাহাড়ে বিবদমান দু’টি গ্রুপের মাঝে প্রায় ১৯০টি সংঘর্ষ ঘটেছে। এসব সংঘর্ষে ৪৫০ পাহাড়ি উপজাতি ও বাঙালি প্রাণ হারান। অপহৃত হয়েছে সাড়ে আট শতাধিক মানুষ। হাজারো ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে বলে এক পরিসংখ্যানে জানা গেছে।

শান্তিচুক্তির পর এ পর্যন্ত পাহাড়ের সংঘর্ষগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় যে শান্তির অন্বেষায় ২৫ বছর আগে সশস্ত্র আন্দোলন বন্ধ হলেও শান্তি আসেনি পাহাড়ে। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ও তার পরবর্তীকালে পাহাড়ের নানা ঘটনা প্রবাহকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত। পার্বত্যবাসীর পক্ষে জনসংহতি সমিতি এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয় ২ ডিসেম্বর ১৯৯৭ এ। চুক্তিটি চারটি ভাগে বিভক্ত: (ক) সাধারণ, (খ) পার্বত্য জেলা স্থানীয় সরকার পরিষদসমূহ, (গ) পাবর্ত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও (ঘ) পুনর্বাসন, সাধারণ ক্ষমা এবং অন্যান্য বিষয়। চুক্তিটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য- পার্বত্য চট্টগ্রামকে উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চল হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া। চুক্তির ফলে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ’-এর জন্ম হয়। এর মাধ্যমে জেলা পরিষদগুলোকে শক্তিশালী করা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সৃষ্টি চুক্তির আরেক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। পাহাড়ে শান্তির ধারা ফিরিয়ে আনতে সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, উদ্বাস্তুদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব চুক্তিটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। এদিকে বন্দোবস্ত পাওয়া সরকারি খাস জায়গায় গড়ে তোলা ঘরবাড়িসহ সহায়-সম্পত্তি ফেলে পুনর্বাসিত বাঙালি পরিবারগুলোকে গুচ্ছগ্রামে আনার পর তারা জীবনে বেঁচে গেলেও শুরু হয় আরেক কঠিন জীবন সংগ্রাম। গুচ্ছগ্রামে বরাদ্দ পাওয়া জায়গা ও ঘর খুবই ছোট হওয়ায় গাদাগাদি করে থাকতে হয় তাদের। পরিবারপ্রতি বরাদ্দ পাওয়া মাত্র পাঁচ শতক জায়গায় বসবাস করা এসব পরিবারের সদস্য সংখ্যা বাড়তে থাকে। খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার পাহাড়ি ভূমি সোনামিয়া টিলায় ৮১২ পরিবারকে সরকার ১৯৮২ সালে পুনর্বাসন করে। ’৮৬-এর ভয়ানক পরিস্থিতির কারণে তাদের সাময়িকভাবে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়। শান্তিচুক্তির পর ভারত থেকে শরণার্থীরা এলে দ্বিতীয় দফায় ঘরবাড়ি ছাড়তে হয় তাদের।

পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি করছে। চাঁদা না দিলে করা হচ্ছে অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ। চাঁদার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও কৃষক। এমনকি মোবাইল অপারেটরদের প্রতিমাসে কোটি টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। বিভিন্ন অফিস ও ব্যক্তিকে চাঁদার পরিমাণ নির্ধারণ করে চিঠি দেয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে জেএসএস, ইউপিডিএফ ও জেএসএস সংস্কারপন্থী গ্রুপের হাতে চাঁদার টাকা পৌঁছে দিতে হয়। গত কয়েক মাস থেকে পাহাড়ে এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এদের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করার কারও সাহস নেই। যদি জানতে পারে কে অভিযোগ করেছে- তাহলে পরের দিন তার লাশ ফেলে দেয়া হচ্ছে। পাহাড় যেন ‘মগের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে। একটি গোয়েন্দা সূত্র জানায়, চাঁদা না দিলে পাহাড়ে কোন কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না। সরকারের উন্নয়ন কাজ থেকেও চাঁদা দিতে হচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি যাই হোক না কেন নির্দিষ্ট হারে চাঁদা দিতে হয় তিন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনকে। জনসংহতি সমিতি (জেএসএস-সন্ত লারমা গ্রুপ), জেএসএস সংস্কার পন্থী ও ইউনাইটেড পিপল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) নির্ধারিত চাঁদা দিতে অস্বীকার করলেই শুরু হয় অপহরণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, হত্যা, ধর্ষণ। জ্বালিয়ে দেয়া হয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বাড়ি-ঘর, যানবাহন। চাঁদার হাত থেকে রেহাই নেই সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও। বেতনের একটি অংশ চাঁদা হিসেবে দিতে হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলায় এমনই অবস্থা। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আবার চাঁদার রশিদও দিচ্ছে। অনেকটা প্রকাশ্যেই চাঁদাবাজি চলছে। এমনকি পাহাড়ী নৃ-গোষ্ঠীর কাছ থেকেও চাঁদা নেয়া হয়। তবে বাঙালীদের চেয়ে তাদের চাঁদার রেট কিছুটা কম। প্রতিদিনই পার্বত্য অঞ্চল থেকে সশস্ত্র উপজাতি গ্রুপগুলো এক থেকে দেড় কোটি টাকার চাঁদা আদায় করছে। আর বছর শেষে প্রতিটি গ্রুপই (জেএসএস-সন্তু, জেএসএস-সংস্কার ও ইউপিডিএফ) পার্বত্য অঞ্চল থেকে আদায় করছে সাড়ে চার শ’ কোটি টাকা। চাঁদা আদায়ে নিয়োজিত রয়েছে জেএসএস ও ইউপিডিএফের সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার সশস্ত্র প্রশিক্ষিত কর্মী। চাঁদার টাকায় কেনা হচ্ছে অত্যাধুনিক অস্ত্র গোলাবারুদ। চালানো হচ্ছে সংগঠনের অন্যান্য কার্যক্রম।

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা, রেশন, অবসরকালীন ভাতা, ক্ষতিপূরণ বাবদ ব্যয় করা হচ্ছে। এছাড়া পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠনগুলো চাঁদার অর্থে দেশ-বিদেশে বাঙালীবিদ্বেষী প্রচার কাজেও ব্যবহার করছে। পার্বত্য অঞ্চল ঘুরে লোকজন ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাঁদাবাজি চলছে প্রকাশ্যেই। চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে কেউ কোন কথা বলার সাহস রাখে না। ইতোপূর্বে দু’একজন চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় তাদের হত্যা করা হয়েছে। এমনকি তাদের পরিবারের সদস্যদের অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায় করেছে। মেয়েদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করেছে। এ সবের হাত থেকে বাঁচতে নীরবে চাঁদা দিয়ে যাচ্ছে। কেউ প্রতিবাদ করছে না। চাঁদার বিষয়টি পুলিশ স্বীকার করেছে। পুলিশ বলছে, কেউ যেহেতু অভিযোগ করে না। তাই কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া যাচ্ছে না। বাঙালী ও উপজাতি সম্প্রদায়ের কয়েকজনের সঙ্গে কথা হলে তারা বলেন, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, গাছের ফল, ক্ষেতের ফসল, ছোট-বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, কৃষক-শ্রমিক-মৎস্যজীবী, সব ধরনের যানবাহন, সরকারী-বেসরকারী চাকরিজীবী, স্থানীয় উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত পরিবার, দেশী ও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি, জমি কেনাবেচা, কাঠ-বাঁশ, মোবাইল অপারেটরসহ সবাইকেই চাঁদা দিতে হচ্ছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত থানায় এ নিয়ে কোন অভিযোগ দায়ের হয়নি। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তিন পার্বত্য জেলায় দৈনিক দেড় কোটি টাকার চাঁদা তুলে উপজাতিদের সশস্ত্র গ্রুপগুলো। দিনে দিনে এই চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। সরকারের কাছে দেয়া ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, জেএসএস (সন্তু), জেএসএস (সংস্কার) ও ইউপিডিএফের সন্ত্রাসী কর্তৃক চাঁদাবাজি ও অপহরণের ঘটনা গত কয়েক মাসে চরম আকার ধারণ করেছে। এভাবে চলতে থাকলে পার্বত্য চট্টগ্রামে জীবনযাত্রা অচল হয়ে পড়বে।

শান্তিচুক্তির বেশিরভাগ দফা বাস্তবায়ন হলেও নতুন করে জেএসএস স্বায়ত্তশাসন চেয়ে আন্দোলন শুরু করেছে। আর ইউপিডিএফ চাইছে পূর্ণ স্বাধীনতা। সংস্কারপন্থীরা কয়েকটি শর্তে মূলত স্বায়ত্তশাসন চাইছে। এই অযৌক্তিক দাবি তোলার বিষয়টি কেন তারা তুলছেন। তাদের সব দাবিই প্রায় বাস্তবায়ন হয়েছে।

লেখক-সম্পাদক, দৈনিক পথে প্রান্তরে

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ