সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
রাজনৈতিক জোট মানেই লাভ-ক্ষতির হিসাব। শেখ হাসিনার সরকার ও তার দল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর ঐক্য ঐতিহাসিক সেটা জানতে দুই দলের গঠনতন্ত্র পড়ার দরকার নেই। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের আমল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তাদের সব রসায়ন সে কথাই বলে। ১৯৯০-এ স্বৈরাচার এরশাদের পতনের পর সব নির্বাচনে জোট বা আসন-সমঝোতা হয়েছে এদের এবং তার সুফল দুপক্ষই ভোগ করেছে। এমনকি ২০০৮-এর নির্বাচনের পর থেকে বিরোধী অবস্থানে গিয়েও সেই ঐক্যে সমস্যা হয়নি। বিএনপি এবং জামায়াতসহ চারদলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এটি ২০-দলীয় জোটে রূপ নেয়।
কিন্তু হঠাৎ রাজনৈতিক প্রাঙ্গণে ব্যাপক আলোচনা বিএনপি-জামায়াতের রসায়ন নিয়ে। জামায়াতে ইসলামীর আমিরের একটি বক্তব্য নিয়েই এই আলোচনা। জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের যে বক্তব্য সামাজিক মাধ্যমে এসেছে, তাতে বলা হয়েছে জোটকে সক্রিয় করার কোনও চিন্তা নেই প্রধান শরিক বিএনপির এবং সে কারণে এখন বাস্তবতা হচ্ছে নিজস্ব অবস্থান থেকে আল্লাহর ওপর ভরসা করে পথ চলা।
এই বক্তব্য থেকে পরিষ্কার হয় না সত্যি সত্যি জামায়াত বিএনপিকে ছাড়ছে নাকি ধরে থাকবে। তবে অভিমানের স্বর স্পষ্ট। বিএনপি কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি। তবে বেশি প্রতিক্রিয়া এসেছে শাসক দল আওয়ামী লীগের অনেক নেতা থেকে। তবে বিভিন্ন আলোচনা থেকে এটি পরিষ্কার, জামায়াত রাজনৈতিকভাবে ত্যাগ করছে না বিএনপিকে, তবে জোটেও থাকছে না। সরকারবিরোধী আন্দোলন সমান্তরালভাবে করবে।
বিএনপির ওপর জামায়াতের নাখোশের কারণ প্রধানত দুটি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধের বিচারের উদ্যোগ নেয়। বিএনপির কয়েকজন নেতা এই বিচারে পড়লেও জামায়াতের প্রথম সারির বেশ কয়েকজনকে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়। এই বিচার ঠেকাতে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা বলতে গেলে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। সারা দেশে ব্যাপক সহিংসতা হয়, যানবাহন, সরকারি অফিস, বিদ্যুৎকেন্দ্র, রেলগাড়ি ও স্টেশন পোড়ানো ছাড়াও জামায়াত কর্মীদের সহিংস সংঘাত হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে। জামায়াত মনে করে, সে সময় বিএনপি সেভাবে এই বিচারের বিরুদ্ধে তাদের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়নি। সরকারবিরোধী পুরো আন্দোলনটি, বিশেষ করে ২০১৩-১৪ সালের পেট্রোলবোমায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটিয়ে সরকার পতনের প্রচেষ্টায়ও বিএনপি জামায়াত ও শিবিরের কর্মীদের মতো মাঠে থাকেনি। দ্বিতীয় কারণটি হলো ২০১৮ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনের সময় বিএনপি গণফোরামসহ ধর্মনিরপেক্ষ কিছু রাজনৈতিক দলের সাথে গিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে ২০-দলীয় জোটকে অকার্যকর করে ফেলে। যাদের সাথে বিএনপি গিয়েছিল ফ্রন্টে তারা সবাই জামায়াতবিরোধী বলেই দলটি মনে করে। ২০১৮ সালেই বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। জঙ্গিবাদবিরোধী অবস্থান পরিষ্কার করতে আন্তর্জাতিক মহলে বিএনপিও দেখাতে চেয়েছে যে জামায়াতের সাথে তাদের আগের মতো সম্পর্ক নেই। এসব হিসাব জামায়াত নেতৃত্বের মাঝে বরাবরই আলোচনায় ছিল। ২০-দলীয় জোট নিয়ে জামায়াত ছাড়াও অন্য অনেক ছোট রাজনৈতিক দলের নেতারাও বিভিন্ন সময় বিএনপির একলা চলো নীতি বা ঐক্যফ্রন্ট গঠনের সমালোচনা করেছে। জামায়াতের ৩-৫ শতাংশ নিজস্ব ভোটকে বিএনপি তার ব্যাংক হিসেবে বিবেচনা করেছে এবং সেটা প্রতিটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে পেয়েছে। আর বিএনপির ভোটকে কাজে লাগিয়ে জামায়াত স্বাধীনতাবিরোধী দল হয়েও বিএনপির কাছ থেকে মন্ত্রিত্ব বাগিয়ে তাদের বড় নেতাদের বাড়িতে ও গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে। তাই সহজেই বলা যায় তাদের সম্পর্ক পাটিগণিতের এবং এই অঙ্কের ওপর ভর করেই তারা জোট বেঁধেছে, একত্রিত থেকেছে সবসময়। দুই শরিকের নিজস্ব ভোটের যোগফল আওয়ামী লীগকে বরাবরই বিপদে ফেলেছে, চিন্তায় ফেলেছে।
সেই বিচারে জামায়াত যদি বিএনপি থেকে বিচ্ছিন্ন হয় তাহলে কিছুটা হলেও স্বস্তি আওয়ামী লীগের জন্য। তবে শাসক দলের নেতাদের অনেকে যেটা বলেছেন যে জামায়াতকে কখনও বিএনপি থেকে আলাদা করা যায় না, সেটাও উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ এই দলের শুভাকাঙ্ক্ষীরা মনে করেন, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দৃশ্যমান করতে না চাইলেও বিএনপি জামায়াতকে ছাড়বে না। নির্বাচন কমিশনে জামায়াতের নিবন্ধন নেই। ফলে নির্বাচন করতে তাদের বিএনপির টিকিটেই করতে হবে। তাই সম্পর্কের ইতি টানা সহজ কাজ নয় বলেই মনে করা হচ্ছে।
বিএনপির ভেতরে জামায়াতকে নিয়ে স্বস্তি যেমন আছে, তেমনি অস্বস্তি আছে অনেকের মাঝে। দলের ভেতরের একটা বড় অংশই জামায়াত নেতার বক্তব্যে অখুশি হয়নি। কারণ, দীর্ঘদিন ধরেই জামায়াতকে নিয়ে বিএনপিতে একটা অস্বস্তি রয়েছে। তারা সবসময় চায় জামায়াতকে বাদ দিয়েই বিএনপি চলুক। এবং সে চাওয়াটা সম্পর্কেও জামায়াত অবগত।
তবে গত কয়েক বছরের তুলনায় আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জামায়াত রাজনীতিতে অনেক বেশি দৃশ্যমান হবে বলেই মনে হচ্ছে। এবং সেখানে কী ধরনের বক্তব্য আসে সেটাই পরিষ্কার করবে জামায়াত-বিএনপির প্রেম ও বিচ্ছেদের গল্প।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন