অরুণ কুমার গোস্বামী
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ অর্জন করেছিল অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার। এসব মৌলিক আদর্শ হত্যা করার জন্যই কি পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যা করা হয়েছিল? সেই কালরাতের পরদিন সকালে বেতারে মেজর ডালিম ঘোষণা দিয়েছিলেন, খন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবহিনী ক্ষমতা দখল করেছে এবং সামরিক আইন জারি করা হয়েছে। এরপরই তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ এখন থেকে ইসলামি প্রজাতন্ত্র।’ যে রাষ্ট্র গঠনে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ৩০ লাখ শহিদ আত্মত্যাগ করেছিলেন, সেই রাষ্ট্রকে তারা কোন পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছিল— এই বক্তব্যটি কি যথেষ্ট মাত্রায় সেটিরই ইঙ্গিত দেয় না?
এই প্রশ্নের উত্তরের জন্য বঙ্গবন্ধুর ত্যাগী ও সংগ্রামী জীবনের কাহিনি উপলব্ধির পাশাপাশি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস ও বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তী পরিস্থিতির দিকে লক্ষ করতে হবে। পাশাপাশি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হবে মানুষের জন্য জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর অনুভূতি, বাঙালিদের স্বাধীনতা ও মুক্তির জন্য তার আন্তরিকতাপূর্ণ প্রতিশ্রুতি ও আত্মত্যাগ এবং সর্বোপরি একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের জন্য তার দৃঢ়চেতা, সংগ্রামী, ঐতিহাসিক ও অনন্য সাধারণ অবদানের কথা। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ থেকে আমরা জানতে পারি, মানুষ হিসেবে সমগ্র মানবজাতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু ভাবতেন। একজন বাঙালি হিসেবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাই তাকে গভীরভাবে ভাবিয়েছে। আর এই নিরন্তর সম্পৃক্তির উৎস হচ্ছে ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা, যে ভালোবাসা তার রাজনীতি ও অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তুলেছে। বঙ্গবন্ধু প্রথমে বাঙালি, তারপর মানুষ এবং তারপর মুসলমান হিসেবে তার পরিচয় তুলে ধরেছেন।
বঙ্গবন্ধু তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ গ্রন্থের ৭৮ নম্বর পৃষ্ঠায় ‘মিশন উইথ মাউন্টব্যাটেন’ শীর্ষক একটি বইয়ের কথা উল্লেখ করেছেন। ১৯৫১ সালে প্রকাশিত বইটি লিখেছিলেন ব্রিটিশ ভারতের শেষ গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেনের প্রেস অ্যাটাশে, ব্রিটেনের লিবারেল পার্টির রাজনীতিক ও সাংবাদিক অ্যালান-ক্যাম্পবেল জনসন (১৯১৩-১৯৯৮)। বইটির মুখবন্ধে তিনি বলছেন, ‘লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব হচ্ছে সম্ভবত একটি সমাধান বের করা, আসন্ন বৈপ্লবিক সংকটের ঝড়ে টিকে থাকার যথেষ্ট সারবত্তা ও আনুকূল্য যার মধ্যে নিহিত আছে এবং দেশভাগ হওয়া সত্ত্বেও অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে যা গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ বজায় রাখবে।’
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের যুগ অবসানের ৭৪ বছর, পাকিস্তানের ধর্মীয় ঔপনিবেশিক শোষণ অবসানের ৫০ বছর এবং বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ৪৬ বছর পর বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উত্থান ও বর্তমান পরিস্থিতি অনুধাবনের জন্য ‘অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ’ সংযোগস্থাপনকারী বিষয়গুলোর দিকে আমাদের নজর দেওয়া প্রয়োজন।
আমাদের জীবদ্দশায় দেখা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের সর্বজনস্বীকৃত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কর্মকাণ্ড বা বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সমসাময়িক বিভিন্ন গবেষক ও বিশ্লেষকের লেখাগুলো এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে গৃহীত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর লেখা ডায়েরি থেকে ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’, ‘কারাগারের রোজনামচা’, ‘আমার দেখা নয়াচীন’ গ্রন্থগুলোর কথাও আসবে সবার আগে। আর সবশেষ পাকিস্তানের গোয়েন্দারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্বন্ধে সুদীর্ঘ ২৪ বছর ধরে যেসব গোপন রিপোর্ট দিয়েছিল, সেসব রিপোর্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টায় ‘সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য ন্যাশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান’ শিরোনামে হাক্কানি পাবলিশার্স এবং পরে বিশ্বখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা রুটলেজের মাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার কারণে অনেক অজানা তথ্য প্রকাশ পেয়েছে এবং তা আমরা জানতে পারছি।
‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পাঠে জানা যায়, ১৯৩৬ সালের দিকে বঙ্গবন্ধু যখন মাদারীপুর ছিলেন তখন তার চোখের চিকিৎসার জন্য পড়ালেখা বন্ধ ছিল। ওই সময় তিনি নেতাজী সুভাষ বোসের ভক্ত হতে শুরু করেছিলেন। তিনি স্বদেশি আন্দোলনকারীদের সঙ্গেই মেলামেশা করতেন (পৃষ্ঠা ৯)। বঙ্গবন্ধুর জীবনে ১৯৩৮ সালে প্রথম জেল খেটেছিলেন ৭ দিন। যে মামলায় তিনি জেল খেটে ছিলেন সেটি হিন্দুরা দিয়েছিল। কিন্তু ঘটনার বিবরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়— মামলার বাদী-বিবাদী সবাই পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ভিন্ন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও। এ ঘটনায় হক সাহেব ও সোহরাওয়ার্দী সাহেবকে টেলিগ্রাম করা হয়েছিল। কলকাতায়ও লোক চলে গিয়েছিল। কিন্তু বাইরের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি মীমাংসা হয় এবং মামলা না চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল (পৃ.১৩)।
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময় তিনি ইসলামিয়া কলেজের বেকার হোস্টেলের আবাসিক ছাত্র। ‘হোস্টেলে যা বাঁচে দুপুরে ও রাতে বুভুক্ষুদের বসিয়ে ভাগ করে দেন’ (পৃ. ১৮)। হিন্দু নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জীর সঙ্গে মন্ত্রিসভা গঠন সত্ত্বেও শেরে বাংলা এ কে ফজলুর হকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর পিতা ও অন্যান্য গ্রামবাসীর প্রবল সমর্থনের কথা জানা যায় (পৃ.২১-২২)। নিঃস্বার্থ স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ত্যাগী যেসব নেতা ইংরেজকে তাড়ানোর আন্দোলন করেছেন, তাদের প্রতি বঙ্গবন্ধুর ছিল গভীর শ্রদ্ধাবোধ। তবে তিনি ‘হিন্দু ও মুসলমানদের মিলনের চেষ্টা’র ঘাটতির কারণে এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে তিক্ততা বৃদ্ধির বিষয়টি লক্ষ করেছেন। বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘হিন্দু নেতাদের মধ্যে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ এবং নেতাজী সুভাষ বসু এ ব্যাপারটি বুঝেছিলেন…। এ কথাও সত্য, মুসলমান জমিদার ও তালুকদাররা হিন্দু প্রজাদের সঙ্গে একই রকম খারাপ ব্যবহার করত… (পৃ.২৪)।’
আবার ৩৭ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘ইসলামিয়া কলেজে গরিব ছেলেদের সাহায্য করার জন্য একটি ফান্ড ছিল। সেই ফান্ড দেখাশোনা করার ভার ছিল বিজ্ঞানের শিক্ষক নারায়ণ বাবুর। তিনি যদিও জানতেন, বঙ্গবন্ধু প্রায় সবসময়ই ‘পাকিস্তান’, ‘পাকিস্তান’ করে বেড়াতেন। তবু নারায়ণ বাবু বঙ্গবন্ধুকে স্নেহ করতেন। ইসলামিয়া কলেজের সব ছাত্রই মুসলমান। একজন হিন্দু শিক্ষককে সবাই এই কাজের ভার দিত কেন? বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘কারণ, তিনি সত্যিকারের একজন শিক্ষক ছিলেন। হিন্দুও না, মুসলমানও না। যে টাকা ছাত্রদের কাছ থেকে উঠত এবং সরকার যা দিত, তা ছাড়াও তিনি অনেক দানশীল হিন্দু-মুসলমানদের কাছ থেকে চাঁদা তুলে জমা করতেন এবং ছাত্রদের সাহায্য করতেন।’ বঙ্গবন্ধু বলছেন ‘এরকম সহানুভূতিপরায়ণ শিক্ষক আমার চোখে খুব কমই পড়েছে (পৃ.৩৭-৩৮)।’
বঙ্গবন্ধুর শৈশব, কৈশোর ও যৌবনের শিক্ষা তথা তার ত্যাগী ও সংগ্রামী জীবনের ঘটনা পর্যালোচনা করে অসাম্প্রদায়িকতার প্রতি বঙ্গবন্ধুর আন্তরিকতাপূর্ণ ও দৃঢ় অবস্থান আমরা উপলব্ধি করতে পারি। স্বাভাবিকভাবেই তিনি ১৯৪৬ সালে মুসলিম লীগ আহুত ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’তে হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু কলকাতার বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন (পৃ.৮১)।
আবার দেখা যাচ্ছে, ফরিদপুর জেলে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন মাদারীপুরের ফনিভূষণ মজুমদার এবং গোপালগঞ্জের চন্দ্র ঘোষ (বোস)। চন্দ্র বোসের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘…আমি মানুষকে মানুষ হিসেবেই দেখি। রাজনীতিতে আমার কাছে মুসলমান, হিন্দু ও খ্রিষ্টান বলে কিছু নাই। সকলেই মানুষ (পৃ.১৯১)।’ অন্যান্য নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর প্রচেষ্টায় ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ১৯৫৫ সালে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘আওয়ামী লীগ’ করা হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু ধর্মের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানের বিরুদ্ধে, ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ফলে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগ বাংলাদেশে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে।
এরপর ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রধান আসামি শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর বাংলার জনগণের পক্ষ থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে আয়োজিত ভাষা আন্দোলনের স্মরণ সপ্তাহের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন— ‘রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি নয়, মূলত শুরু হয়েছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। এই দিনই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়। একমাত্র কুমিল্লার শ্রী ধীরেন্দ্রনাথ দত্তই উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদ করেন এবং উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা দাবি জানান। কোনো বাঙালি মুসলমান প্রতিবাদ করেননি। এটা লজ্জাজনক ইতিহাস।’
ভাষা আন্দোলনের রক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে, স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে আন্দোলনের পরিণতিতে চূড়ান্ত পর্যায়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে উপনীত হয়েছি। তাই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুধু ভাষার আন্দোলনই ছিল না, বাঙালির অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক তথা সার্বিক স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত (রায় ২০২১, ৮২)।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ও ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে সমগ্র বাংলাদেশে পাকিস্তানের হানাদার দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। দীর্ঘ প্রায় ১০ মাস রক্তাক্ত যুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই— বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশের কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকবে (পৃ.১৬৪)।’
স্বাধীনতার পর ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে বাংলাদেশের ১৯৭২ সালের সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৫-৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের অধিবেশনে অংশগ্রহণের সময় সৌদি বাদশা ফয়সালের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয় (মুকুল ১৯৮৫)। বঙ্গবন্ধু এসময় বাদশা ফয়সালকে বলেন, ‘এক্সিলেন্সি, আপনি জানেন এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিচ্ছে না?’ জবাবে বাদশা ফয়সাল বলেন, ‘আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা ছাড়া আর কারও কাছে জবাবদিহি করি না। তবু আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি— সৌদি আরবের স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।’
তখন বঙ্গবন্ধু বলেন, “এই শর্ত অন্তত বাংলাদেশের জন্য প্রযোজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতো অমুসলিম রয়েছে। সবাই একইসঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পোহায়েছে। তাছাড়া এক্সিলেন্সি, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে— পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালা তো শুধু ‘মুসলেমিন’ নন, তিনি হচ্ছেন ‘রাব্বুল আলামিন’। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশের নামও তো ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক সৌদি আরব না। এই মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা কেউই তো এ নামে আপত্তি করিনি।”
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতিরপিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টির প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে সামরিক শাসকেরা রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার শুরু করে। আমরা জানি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশ থেকে তার নাম মুছে ফেলে। বাংলাদেশকে পাকিস্তানিকরণ তথা একটি সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য অতীতের সামরিক-বেসামরিক সরকারগুলো ও তাদের অনুসারীরা ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখে। অন্যদিকে, পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তার সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা কণ্টকাকীর্ণ পথেও ঘাতক ও তাদের সহযোগী সামরিক-বেসামরিক সরকার এবং তাদের দোসরদের বিরুদ্ধে জীবনপণ সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। এ পর্যন্ত ১৯ বারেরও বেশি হত্যাচেষ্টা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্রষ্টার অসীম কৃপা ও বাংলার মানুষের আন্তরিক দোয়া ও আশীর্বাদে বেঁচে গিয়েছেন।
বঙ্গবন্ধুর খুনি দেশদ্রোহী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের কদর্য মুখাবয়ব এ এল খতিব-এর ‘হু কিলড মুজিব?’ এবং বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার বাদী আ ফ ম মহিতুল ইসলামের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা কী নিষ্ঠুর পৈশাচিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের সবাইকে হত্যা করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত পাকিস্তানি শক্তি ও তাদের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক শক্তির যৌথ ষড়যন্ত্রের ফলে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে ভিন্ন ধরনের এক জাতীয়তাবাদের আমদানি করা হয়, যা স্পষ্টত ধর্মভিত্তিক দ্বি-জাতি তত্ত্বে প্রত্যাবর্তনের বিপজ্জনক ইঙ্গিত দেয়। সংবিধান পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশের বাঙালিদের পরিচিতির ক্ষেত্রেও পরিবর্তনের সূচনা হয়। ১৯৭৬ সালের নভেম্বরে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী করেন। এর মাধ্যমে সংবিধানের ১২ নম্বর অনুচ্ছেদ অপসারণ করা হয়। এই অনুচ্ছেদ দ্বারা সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব এবং/অথবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্ম বৈষম্য ও ধর্মের অপব্যবহার বিলোপ সাধন করে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের পথ সুগম করার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, সংবিধানের শুরুতে মুখবন্ধের আগে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযুক্ত করা হয়। ১৯৭৭ সালের মে মাসে সংবিধানের ৩৮ নম্বর অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করা হয়। এর ফলে, ধর্মের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল গঠন করার পথ সুগম হয়। সংবিধানের ২৫ নং অনুচ্ছেদ-এর সঙ্গে একটি নতুন উপঅনুচ্ছেদ যুক্ত করা হয়। যেখানে ‘ইসলামি সংহতির ভিত্তিতে মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক স্থাপনের কথা বলা হয়।’ পরবর্তীকালে, ১৯৮৮ সালের ৭/৯ জুন এরশাদের শাসনামলে ’ইসলাম’-কে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়। ২০১০ সালের সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালের জুন-জুলাইয়ে জাতীয় সংসদে পাস করা পঞ্চদশ সংশোধনী দ্বারা একে পুনরায় ফিরিয়ে আনা হয়। এছাড়া, রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ’ইসলাম’-কে বহাল রাখা হয়, যদিও সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ পুনরায় সংযোজিত হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর থেকে সংবিধান পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়। এই উদ্দেশ্যে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেয়া হয়েছিল এবং সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ সংযোজন করেছিল। আর অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘ইসলাম’কে রাষ্ট্রধর্ম সংযোজন করা হয়েছিল। এর সঙ্গে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার থামানো এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলাম রাজনীতি করার সুযোগ পায় সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের বদান্যতায়য়, যা দ্বিতীয় সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদও অব্যাহত রেখেছিলেন।
১৯৯০ সালের স্বৈরতন্ত্রবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অনুযায়ী দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক মৌলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। খুনিদের করা ইনডেমনিটি আইন বাতিল করে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার হয়েছে। একাত্তরের গণহত্যা ও মানবতাবিরোধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হওয়ার পর বিচারকাজ চলমান আছে। অবকাঠামো ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের দিক দিয়ে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্য কমছে। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২-এর সংবিধানে দেশ ফিরে আসায় হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মীয় সম্প্রদায় তথা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের মনে কিছুটা আস্থা ফিরে আসার পরিস্থিতির উদ্ভব হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মাবলম্বীদের ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে সংবিধানে অব্যাহতভাবে সংযোজিত থাকার কারণে তা অস্বস্তি বাড়িয়েছে এই কারণে যে এর ফলে সাম্প্রদায়িক শক্তি উসকানি পাচ্ছে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, জমি ও বসতবাড়ি থেকে সংখ্যালঘুদের উচ্ছেদের জন্য যখন তখন আক্রমণ করা হয়। দেশে যখনই কোনো রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়, তখন হামলা-নিপীড়নের টার্গেট করা হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং বিশেষভাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের। ১৯৯০ সালের শেষ দিকে সেনাশাসক এইচ এম এরশাদকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দিতে প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। সে সময়ে ভারতের বাবরি মসজিদকাণ্ডকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের অসংখ্য মন্দির ও মঠ আক্রান্ত হয়। সংখ্যালঘুরা শারীরিকভাবে হামলার শিকার হয়। অনেককে দেশত্যাগে বাধ্য করার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে ১৯৯২ সালে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর যাবতীয় দুষ্কর্মের সহযোগী দল জামায়াতে ইসলামীর সমর্থনে ক্ষমতায় আসে বেগম খালেদা জিয়ার দল বিএনপি। ২০০১ সালের অক্টোবরের সেই নির্বাচনের আগে ও পরে তারা আরও নারকীয় বর্বরতায় মেতে ওঠে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত অপরাধ ফের মাত্রা ছাড়ায়। ১৯৭১ সালের মতো হাজারে হাজারে প্রাণে মেরে ফেলার ঘটনা ঘটেনি, কিন্তু নির্যাতন, ধর্ষণ ও লুটপাট চলতেই থাকে। ভয়-ভীতি প্রদর্শন করে ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদের নতুন ব্লু-প্রিন্ট বাস্তবায়ন শুরু হয়। ২০১২, ২০১৩, ও ২০১৪ সালের পর এবং সাম্প্রতিক কালে দেশের বিভিন্ন স্থানে এরই ভয়ংকর রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজের প্রতিক্রিয়াতেও আমরা দেখি ব্যাপকভাবে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার উসকানি প্রদানের ঘটনা। সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি অতীতের অন্যায় আচরণের সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সংঘটিত ঘটনাবলিতে পার্থক্য লক্ষণীয়— এখন রাষ্ট্র থেকে সাম্প্রদায়িতাকে প্রশ্রয় দেওয়া হয় না। কিন্তু ষাটের দশকে এ ভূখণ্ডের রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি আইয়ুব-মোনায়েমের সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির নীতি ও অপকৌশলের বিরুদ্ধে যেভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল, এখন তা যেন কেবলই অতীতের বিষয়। প্রশাসন, রাষ্ট্র এবং অনেক ক্ষেত্রে সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও গোষ্ঠী সাম্প্রদায়িক অপরাধ ও অন্যায় প্রতিকারে আন্তরিক প্রচেষ্টা গ্রহণে উদ্যোগী হন না। প্রধান প্রধান রাজনৈতিক শক্তি সাম্প্রদায়িকতাকে গণতান্ত্রিক চেতনার পরিপন্থি মনে করে শুধু বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যে সীমিত না থেকে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন আমরা আশা করি।
জঙ্গিবাদের উত্থান
জামায়াতে ইসলামী দেশের প্রধান ইসলামি রাজনৈতিক দল। ভারত ও পাকিস্তানে এর সমান্তরাল শাখা বিদ্যমান আছে। এই দলটি উৎপত্তি লাভ করেছে মাওলানা আবু আলা মওদুদী (১৯০৩-১৯৭৯) প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জামায়াতে ইসলামী থেকে। এই দলটির প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ধর্মভিত্তিক এই দলটি পাকিস্তানের পক্ষে সক্রিয় থেকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে বাঙালিদের হত্যা করেছে এবং হত্যার সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছে। আরেকটি ইসলামি গোষ্ঠী হচ্ছে মাওলানা সাঈদুর রহমান উৎসাহিত জেএমবি। এই মর্মে রিপোর্ট আছে যে জেএমবি দিনাজপুরে সাতটি বোমা বিস্ফোরণের জন্য দায়ী। তারা মাদরাসার মাধ্যমে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে থাকে। আর এসব মাদরাসায় সমাজের দরিদ্র শ্রেণি থেকে আসা শিক্ষার্থীদের তারা তাদের দলে ভিড়িয়ে থাকে।
জানা যায়, বাংলাদেশসহ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো থেকে জঙ্গি ও তাদের সহযোগীরা কান্দাহারে বিন লাদেনের সহযোগী ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে বিশ্বব্যাপী জঙ্গিবিরোধী অভিযানে ৮০ জনেরও বেশি জঙ্গি ধরা পড়েছিল। এইসব দেশের মধ্যে আছে তানজানিয়া, কেনিয়া, সুদান ও ইয়েমেন থেকে শুরু করে পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া ও ফিলিপাইন। অতি সম্প্রতি পাকিস্তানের ক্রিকেটার শোয়েব আক্তার সামা টিভিতে প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘ইট ইজ রিটেন ইন আওয়ার স্ক্রিপচারস দ্যাট গাজওয়া-ই-হিন্দ উইল টেইক প্লেস।’ পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ‘দিজ রাইটিংস পোরট্রে সাউথ এশিয়া অ্যাজ দ্য ব্যাটল ফিল্ড।’ গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সূত্র উল্লেখ করে গণমাধ্যমগুলোতে পরিবেশিত সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে, গাজওয়া-ই-হিন্দ-এর লক্ষ্যে উপমহাদেশের জঙ্গিদের সঙ্গে বাংলাদেশের জঙ্গিরাও একযোগে কাজ করেছে। জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক শক্তির সহায়ক একটি শক্তিশালী লক্ষণ। আফগানিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সম্প্রতি তালেবান অধিষ্ঠিত হওয়ার কারণে পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি
সরকারি আদমশুমারি অনুসারে ১৯৪১ সালে মোট জনসংখ্যার শতকরা ২৮ দশমিক ৩০ ভাগ ছিল ধর্মীয় সংখ্যালঘু। এর মধ্যে এক কোটি ১৮ লাখ হিন্দু, এবং বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও এনিমিস্ট প্রভৃতি সংখ্যালঘু ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ছিল ৫ লাখ ৮৮ হাজার। অন্যদিকে ১৯৯১ সালের আদমশুমারির তথ্য বলছে, বাংলাদেশে মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা বেড়েছে শতকরা ২১৯ দশমিক ৫ শতাংশ, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেড়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি বজায় থাকলে ১৯৯১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়াত ৩ কোটি ২৫ লাখে। বাস্তবে এই সংখ্যাটি ১৯৯১ সালে ছিল এক কোটি ২৫ লাখ। এর অর্থ হচ্ছে, জনসংখ্যার মধ্য থেকে দুই কোটি হিন্দু হারিয়ে গেছে।
আবার ২০০১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২০ শতাংশ হিন্দু, শূন্য দশমিক ৭০ শতাংশ বৌদ্ধ, এবং শূন্য দশমিক ৩০ ভাগ খ্রিষ্টান। এর পরের ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী মোট জনসংখ্যার শতকরা ৮ দশমিক ৫০ ভাগ হিন্দু, শূন্য দশমিক ৬০ ভাগ বৌদ্ধ, শূন্য দশমিক ৩০ ভাগ খ্রিষ্টান, এবং শূন্য দশমিক ১০ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী।
বর্তমান সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতির সামান্য পরিবর্তন হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান তথা ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জীবন, সম্পত্তি ও স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ অব্যাহত আছে। সংখ্যালঘুদের নিত্যদিনের এসব সমস্যা নজরদারি করার জন্য প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো হচ্ছে— সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠা; সংখ্যালঘু কমিশন গঠন; সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন; ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের জন্য বার্ষিক বাজেটে পৃথক ব্যবস্থা রাখা; সংখ্যালঘুদের জন্য জাতীয় সংসদসহ প্রজাতন্ত্রের সব স্তরের অফিসে আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা; এবং বিদ্যালয়গুলোতে সংশ্লিষ্ট ধর্ম শিক্ষার জন্য নিজ নিজ ধর্ম থেকে শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা কড়াকড়িভাবে বজায় রাখা।
উপসংহার
পাকিস্তানের আইয়ুব-ইয়াহিয়ার শাসনের মডেলের খুব কাছাকাছি সামরিক একনায়কতন্ত্রের অধীনে বাংলাদেশে ১৯৭৫ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এবং পরবর্তীকালে ১৯৯১-১৯৯৬ ও ২০০১-২০০৮ পর্যন্ত সময় অতিবাহিত করেছে। এসময় রাষ্ট্র সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রত্যক্ষভাবে উৎসাহিত করেছে এবং আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়েছে। অনেক সংগ্রাম ও অন্যায় অত্যাচারের মুখোমুখি হয়ে নিজের জীবন বিপন্ন করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ থেকে ২০০১, এবং ২০০৯ থেকে আজ পর্যন্ত নির্বাচিত সরকারপ্রধান হিসেবে দেশ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এই সময়ে অনেক তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। রাষ্ট্র এখন আর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দেয় না। তারপরও সাম্প্রদায়িক শক্তি দেশের বিভিন্ন স্থানে এবং সমাজের বিভিন্ন স্তরে সক্রিয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যা পরবর্তীকালে বেসামরিক ও সামরিক শাসকরা অগণতান্ত্রিকভাবে অধ্যাদেশের মাধ্যমে সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র বাদ দেয়। সংবিধানের শুরুতে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করে। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার বন্ধ করতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেছে। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি চালু করে। পরবর্তীকালে এগুলো পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানে সংযোজিত করে দেয়। রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ‘ইসলাম’কে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২-এর সংবিধানে দেশ ফিরে এসেছে। কিন্তু এখনো সংবিধানের সাম্প্রদায়িক রূপ বলবৎ আছে। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী সংখ্যালঘুদের জন্য বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে।
লেখক : সাবেক ডিন, সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ ও সাবেক চেয়ারম্যান রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।