বিভুরঞ্জন সরকার
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ৫ সেপ্টেম্বর ভারতে যাচ্ছেন। ৫ থেকে ৮ সেপ্টেম্বরের এই সরকারি সফরের সময় তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করবেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু, উপরাষ্ট্রপতি জগদীশ ধনকড়ের সঙ্গেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেখা করবেন। দুই দেশের প্রতিনিধি পর্যায়ে আলোচনা শেষে বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তুতি চলছে বলেও গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, এই সফর দুই দেশের সম্পর্ককে আরও জোরদার করবে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি করবে। ২০১৯ সালের অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর করেছিলেন। দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দুই দেশের সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো আসতে পারে। সেক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার–পরবর্তী পরিস্থিতি আলোচনায় আসাটা স্বাভাবিক।
বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ তিস্তার পানি বন্টন ও সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়ের প্রতি। জানা গেছে, তিস্তার বিষয়টি বাংলাদেশ এবারও তুলবে
তবে অন্য যাই হোক না কেন, বাংলাদেশের মানুষের আগ্রহ তিস্তার পানি বন্টন ও সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়ের প্রতি। জানা গেছে, তিস্তার বিষয়টি বাংলাদেশ এবারও তুলবে। এর পাশাপাশি ৫৪টি অভিন্ন নদীর মধ্যে মনু, মুহুরী, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমারের পানিবণ্টনের রূপরেখা নিয়ে সমঝোতার বিষয়টি তুলবে বাংলাদেশ। এ ছাড়া গত ২৫ অগাস্ট যৌথ নদী কমিশনে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নতুন আটটি নদীর পানিবণ্টনের কথা বলা হয়েছে। শীর্ষ বৈঠকে এই বিষয়টিও আলোচনায় আসবে।
দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের পর সেচের জন্য কুশিয়ারা নদী থেকে পানি প্রত্যাহারের বিষয়ে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হতে পারে। এ ছাড়া গঙ্গার পানির সদ্ব্যবহারে দুই দেশের যৌথ সমীক্ষার ঘোষণা আসতে পারে শীর্ষ বৈঠক শেষে। সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য সব সময়ই উদ্বেগের। সেজন্য বাংলাদেশ ও ভারতের যেকোনো পর্যায়ের আলোচনায় সীমান্ত হত্যা এবং শান্তিপূর্ণ সীমান্ত ব্যবস্থাপনা অন্যতম ইস্যু। সাম্প্রতিক মাসগুলোতে সীমান্ত হত্যা কমে এসেছে। এবারের আলোচনায়ও সীমান্তে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা পুরোপুরি বন্ধের বিষয়ে বাংলাদেশ জোর দেবে। সমন্বিত সীমান্ত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে যাতে মানব, মাদক ও সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ থাকে, সে প্রসঙ্গ আলোচনায় আসতে পারে।
দুই শীর্ষ নেতার বৈঠকে দ্বিপক্ষীয় বিষয়গুলোর পাশাপাশি আঞ্চলিক এবং বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে দুই দেশের সহযোগিতার প্রসঙ্গগুলো আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে উপ-আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদারের পাশাপাশি দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং আফগানিস্তান থেকে মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহার–পরবর্তী পরিস্থিতি আলোচনায় আসবে।
বাংলাদেশের বড় প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত। বলা হয়ে থাকে, এই দুই দেশের সম্পর্ক রক্তের বন্ধনে বাধা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের কথা মনে রেখেই রক্তের বন্ধনের কথাটা বলা হয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানকে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী ঘুমন্ত নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু কারার পর বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীনতা ঘোষণার পরই একদিকে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানি সেনারা গ্রেফতার করে, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের আহ্বান অনুযায়ী যার যা আছে তা নিয়ে শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধও। সমস্ত বিষয়টি খুব সহজ ও স্বাভাবিক ছিল না।
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির এক চরম দুঃসময়ে ভারত ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাশে এসে দাঁড়িয়ে বিপদেই বন্ধুর পরিচয় দিয়েছিলেন। মুজিবনগর সরকার গঠন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহ, শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য দেওয়া, বিশ্বব্যাপী জনমত গঠনের মতো কঠিন কাজগুলো যদি ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত সরকার না করত, তাহলে আমাদের দুর্ভোগ আরও বাড়ত।
নয় মাসের যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনী ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করে এবং বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবও বিশ্বজনমতের চাপের কারণে পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি পান। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরে আসেন। দেশে ফেরার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানানো হয় ভারত সরকারের পক্ষ থেকে। দিল্লি বিমান বন্দরে সংক্ষিপ্ত ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “আপনাদের সরকার, আপনাদের সৈন্যবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য ও সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছেন, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলবে না”।
বঙ্গবন্ধুর এই আশাবাদের ব্যত্যয় যে ঘটেনি তা নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কেরও পালাবদল হয়। ভারতবিরোধী রাজনীতির পালে হাওয়া লাগে। জিয়া, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার শাসনামলে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খুব উষ্ণ ছিল না। এরা দ্বিমুখী নীতি নিয়ে অগ্রসর হয়েছে। প্রকাশ্যে ভারতবিরোধী কথাবার্তা বেশি বলেছে, গোপনে দিল্লিকে তোয়াজ-তোষামোদও করেছে। পাকিস্তানের হয়ে ভারতের সঙ্গে ঝামেলা বাধিয়েছে। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আশ্রয় দিয়েছে, সহযোগিতা করেছে। গণবিরোধী ও প্রতিক্রিয়াশীল শাসকেরা নিজের নাক কেটে পরের যাত্রাভঙ্গের নীতি-কৌশলের খেলা খেলছে। তবে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২১ বছর পর ক্ষমতায় ফিরলে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কেও নতুন মাত্রা যোগ হয়। দুই দেশের মধ্যে বিরোধীপূর্ণ ইস্যুগুলোর শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে হাঁটতে থাকে দুই দেশই।
এমন একটি ধারণা একসময় আমাদের এখানে প্রচলিত ছিল যে, ভারতের ক্ষমতায় কংগ্রেস দল এবং বাংলাদেশের ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ থাকলেই দুই দেশের সম্পর্কের উষ্ণতা বাড়ে। কিন্তু এই ধারণা যে সত্য নয়, তা প্রমাণিত হয়েছে বিজিপি ক্ষমতায় আসার পরও। নরেন্দ্র মোদী ভারতের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর বিএনপিসহ আওয়ামী লীগবিরোধী মহলে উল্লাস দেখা গিয়েছিল। ভাবা হয়েছিল, মোদী সরকার আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে মাখামাখির সম্পর্ক রাখবে না।
অথচ সত্য এটাই যে, ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও বাংলাদেশের বর্তমান সরকার প্রধান শেখ হাসিনার আন্তরিক প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ও ভারতের দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত অনেক সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে। বিশেষ করে স্থল সীমান্ত ও সমুদ্র সীমানার মতো জটিল বিষয়গুলো বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে সুষ্ঠু সমাধানের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত প্রতিবেশি রাষ্ট্রের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কোনো ধরনের সংঘাত ও সহিংসতা ছাড়া শান্তিপূর্ণভাবে সীমান্ত সমস্যার সমাধান করা সত্যিই বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
শুধু সীমান্ত সমস্যার সমাধান নয়, গত কয়েক বছরে বাংলাদেশ ও ভারত একে অপরের বৃহত্তম বাণিজ্যের ও উন্নয়ন অংশীদার হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে ভারত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। ফলে ভারতে উৎপাদিত বিদ্যুৎ বাংলাদেশের লাখ লাখ বাড়িঘর এবং কারখানা আলোকিত করছে। বাংলাদেশ ও ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের আরেক দৃষ্টান্ত হচ্ছে, বিগত যেকোনও সময়ের চেয়ে স্থল, জল, বিমান, রেল ও পাইপলাইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর এই যোগাযোগ বাংলাদেশ ও ভারতের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা পরিবর্তনে বিরাট ভূমিকা রাখছে।
কিন্তু তার মানে আবার এটা নয় যে, দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোনো টানাপোড়েন নেই, অস্বস্তি নেই। বাংলাদেশ ভারত সম্পর্কের শীতলতা বা অস্বস্তি নিয়ে বিভিন্ন সময়ে নানা জল্পনা-কল্পনা যে চলে না তা-ও নয়।
অনাস্থা ও অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি হলে উভয় পক্ষ থেকেই আলোচনার মাধ্যমে ভুল বোঝাবুঝির অবসানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কূটনীতিক ও বিশ্লেষকরা এটা স্বীকার করেন যে, দুই দেশের মধ্যে এখন আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় ভালো সম্পর্ক রয়েছে। কেউ কেউ এটাকে দুই দেশের সম্পর্কের ‘সোনালি অধ্যায়’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।
তবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের পারদ ওঠানামা কেন করে, বাংলাদেশের মানুষের ভারতের কাছে চাওয়া কি তা বড় প্রতিবেশী হিসেবে ভারতকে বুঝতে হবে এবং সংবেদনশীলতার সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। যেহেতু ভারত বড়, সেহেতু দায়িত্ব তারই বেশি।
বাংলাদেশের সচেতন মহল থেকে শুরু করে অনেক সাধারণ মানুষও মনে করেন যে, সীমান্ত হত্যা বন্ধ, তিস্তা চুক্তি, রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশ কাক্সিক্ষত সমর্থন ভারতের কাছে পায়নি। তারপরও প্রতিবেশীদের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভালো বন্ধু যদি কেউ থাকে সেটা বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ কখনোই আগ বাড়িয়ে কোনো পদক্ষেপ নেবে না যেখানে ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়।
কোনো কোনো বিশ্লেষক এটা মনে করেন যে, ভারতের আচরণের কারণে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে চীন একটা জায়গা করে নিতে পারছে। এই অঞ্চলে নেপাল-শ্রীলংকার মতো ভারতের প্রতিবেশী দেশ কেন চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে ভারতকেই। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে সম্পর্কের ঘাটতির বিষয়টা হয়তো ভারত অনুধাবন করতে পারছে বলেই বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের শীতলতা তৈরি হওয়ার আগেই উষ্ণতা তৈরির তৎপরতা লক্ষ করা যায়।
সময় যেমন স্থির থাকে না, তেমনি এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের সম্পর্কও সব সময় এক রকম যায় না। চিরদিন কেউ যেমন কারো শত্রু থাকে না, তেমনি চিরস্থায়ী বন্ধুত্বও হয় না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়টি নির্ধারিত হয় নানা বিষয়কে কেন্দ্র করে। রাষ্ট্র পরিচালনায় নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে যেমন পরদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব হতে পারে, তেমনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও পারস্পরিক স্বার্থের ভিত্তিতেও এক দেশের সঙ্গে আরেক দেশের মৈত্রী ও বন্ধুত্ব হতে পারে, হচ্ছেও। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির মূল কথা: সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়। তবে এর সঙ্গে নিশ্চয়ই বিপদ বা দুর্দিনের বন্ধুদের প্রতি দুর্বলতা একটু থাকে বৈকি! কিন্তু এই দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ নিয়ে কৌশলের খেলা মেনে নেওয়া যায় না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফরের ইতিবাচক ফল দেখতে চায় দেশের মানুষ।