Search
Close this search box.

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বই

সুভাষ সিংহ রায়

পুরো নাম আব্দুল লতিফ খতিব, এএল খতিব নামে বিশেষভাবে পরিচিতি পেয়েছিলেন। বাঙালি না হয়ে বঙ্গবন্ধুকে ও বাংলাদেশেকে ভালবেসে ফেলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র সপরিবারের হত্যাকান্ড তাঁকে ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল। ১৯৮১ সালে মার্চ মাসে প্রকাশিত হয় ‘যিড় শরষষবফ গঁলরন? কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই বাংলা সংস্করণের ভূমিকা লিখেছিলেন। বেস্ট সেলারের তালিকায় এই বইটা ছিল, পাকিস্তানে অনুমোদিত উর্দু ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। কয়েক দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ঘটনার পূর্বাপর তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় ছিল। বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকান্ডের পিছনের খলচরিত্রগুলো তাঁর এই বইতে স্পষ্টকরে ফুঁটিয়ে তুলেছেন। ধরে নেওয়া হয়, এই বই লেখার কারণে তাঁকে অনেক বিরম্বনা সহ্য করতে হয়েছিল। ২০১১ সালে পেঙ্গুইন থেকে লেখক নীতিশ সেনগুপ্তের বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে একটা অন্যরকম বই বেরিয়েছে । Land of two rivers : A history of Bengal from mahavharata to mujib.  জ্যাকব এফ ফিল্ড খ্রীষ্টপূর্ব ৪৩১ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ৪২ টি ভাষণ নিয়ে একটা গবেষণাধর্মী বই রচনা করেছেন। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধু’র ৭ মার্চের ভাষণ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণভাবে ফুঁটে উঠেছে । বইটি নাম we Shall fight on the beaches , the speeches that  inspired the history. প্রথম ছোট গল্প লিখে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের প্রতিবাদ জানান চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আবুল ফজল। সে সময়টাতে লেখক জিয়াউর রহমানের শিক্ষা উপদেষ্টা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা অনেকগুলো বই বেরিয়েছে। একটি বই এর নাম ‘শেখ মুজিব আমার পিতা ’। এ বইতে ১০টি প্রবন্ধ সংযোজিত হয়েছে। ‘ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড ’ শিরোনামে লেখাটিতে বঙ্গবন্ধু হত্যান্ডের বিষয়টা স্পষ্টভাবে বিবৃত হয়েছে । কথা সাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন লেখা গল্প ‘যে রাতে নেতা নিহত হলেন ’ পাঠকরা জাগ্রত হয়েছিল। লেখকের আরো দু’টো গল্প ‘রাজার চিঠি ’ এবং ‘মানুষ কাঁদছে ’ পাঠকদের মনে সাড়া জাগিয়েছিল। কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক ‘ আলো আধাঁরের যাত্রী ’, ‘এই আলো জে¦লে ’ ধারাবাহিক উপন্যাস লিখে চলেছেন। কথাসাহিত্যিক মোস্তফা কামালের বঙ্গবন্ধু’কে নিয়ে এবং শেখ রাসেল’কে দুটো উপন্যাস পাঠকদের জাগিয়ে তোলার কাজ করেছে। পশ্চিম বঙ্গের প্রধানতম কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় কবিতা অত্যন্ত ব্যথিত চিত্তে কবিতা লিখেছিলেন, কবিতার নাম ‘শিশুরক্ত’। প্রথম কবিতা সংকলন ছিল ‘এই লাশ আমরা রাখবো কোথায়?’। খ: মোহাম্মদ ইলিয়াস বঙ্গবন্ধুকে বড় একটা বই লিখেছিলেন। বই এর নাম দিয়েছিলেন নাম ছিল ‘মুজিববাদ’। বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকা অবস্থায় ১৯৭৪ সালে ড: মযহারুল ইসলাম একটা বেশ মোটা বই লিখেছিলেন। বই এর নাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব’। মহান মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন সাবেক কুটনীতিক এস এ করিম। তিনি ১৯৫০ সালে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেছিলেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের ডেপুটি পারমানেন্ট রিপ্রেজেন্টিটিভ ছিলেন। বঙ্গবন্ধু’র ডাকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। তিনি একটা অসাধারণ বই লিখেছিলেন, এ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু নিয়ে যত বই বেরিয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বই এর একটি। Sheikh Mujib, Triumph and tragedy. কবি মহাদেব সাহা তাঁর কবিতায় লিখেছেন এভাবে, তাঁকে বার্লিনের এক ভায়োলিন বাদক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তোমার পরিচয় কি? কবি তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে একটা দশ টাকার নোট বের করে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা দেখিয়ে বলেছিলেন, এই আমার পরিচয়, এর চেয়ে বেশি কিছু আমি জানি না।

বাংলা সাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘ লালসালু ’ এক অনন সাধারণ সৃষ্টি। একজন দেশপ্রেমিক কূটনীতিক মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছেন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের ওপর অগাধ আস্থা ছিল তা ড. আব্দুল মতিন এর গ্রন্থ ‘জেনেভায় বঙ্গবন্ধু’ তে ফুঁটে উঠেছে। আমাদের মানতে হবে, ‘তথ্য’ আর ‘ফ্যাক্ট’ অনেকটাই কাছাকাছি কিন্তু ‘ইনফর্মেশন’ এর ক্ষেত্র ব্যাপকতর। ইনফর্মেশনের রূপ শতসহস্র। এই ইনফর্মেশনের যথার্থতা পাওয়া যায় ড. আব্দুল মতিনের লেখা থেকে। ড. আব্দুল মতিন বঙ্গবন্ধু’র হত্যাকান্ডের পর বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। র‌্যাডিক্যাল প্যাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বইগুলো তথ্য সমৃদ্ধ। যেমন, বঙ্গবন্ধু হত্যা: জাতির বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব: কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বিষয়, জেনেভায় বঙ্গবন্ধু ঃ লেখকের স্মৃতিচারণ-পাঁচ অধ্যায় ,‘বিজয় দিবসের পর বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ’, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : কয়েকটি ঐতিহাসিক দলিল’, ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-মুক্তিযুদ্ধের পরে’, ‘বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র শেষ হয়নি এখনও’। ড. আব্দুল মতিন তাঁর ‘জেনেভায় বঙ্গবন্ধু ’ বইতে উল্লেখ করেছেন কিভাবে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বঙ্গবন্ধু’র বিরুদ্ধে চক্রান্ত করেছিলেন। কি আশ্চর্যজনকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিয়েছিলেন, “শেখ মুজিব, আমি তোমাকে আশ^াস দিচ্ছি, তুমি যদি আমার সঙ্গে রাওয়ালপিন্ডি ও পিকিং (বেইজিং) যাও, তা’হলে আমরা শুধু পাকিস্তান ও চীনের স্বীকৃতি নয়, উদরপূর্তির জন্য চালও পাবো। ভারত ও রাশিয়া তোমাকে বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে পারবে না।” এই বইতে লেখক তথ্য প্রমাণসহ দেখিয়েছেন মওলানা ভাসানী পাকিস্তানের ভুট্টো’র সাথে যোগাযোগ রাখতেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভূট্টোর সঙ্গে মওলানা ভাসানীর পত্র-যোগাযোগের কথা বাংলাদেশ সরকারের অজানা ছিল না। পাকিস্তান থেকে লন্ডন হয়ে প্রায় এক ডজন চিঠি বিশেষ পত্রবাহকের মারফৎ সন্তোষে তাঁর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হয়। চিঠির মাধ্যমে ভূট্টো “মুসলিম বাংলা” র ব্যাপারে মওলানা ভাসানীর সাহায্য চায়। এর বিনিময়ে “তাঁর আশা পূর্ণ করা হবে” বলে ভূট্টো কথা দেয়।

বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা গ্রন্থ দুটো বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখা ডায়েরী থেকে প্রকাশিত। অবিভক্ত ভারতে জওহরলাল নেহরু জেলখানায় বসে লিখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা। মার্টিন লুথার কিং কারাগারে বসে লিখেছিলেন ‘বামিংহাম জেল ’। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রকাশক ইউপিএল ও ‘ কারাগারের রোজনামচা ’ এর প্রকাশক বাংলা একাডেমি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থ দুটো বঙ্গবন্ধুর নিজের হাতের লেখা ডায়েরী থেকে প্রকাশিত। নেতাজি সুভাষ বসুও জেলখানায় বসে একটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী লিখেছিলেন; ‘এক ভারতীয় তীর্থযাত্রী’ আমাদের পাঠকদের হাতে তা পৌঁছানোর কথা না। সেখানেও নেতাজি সুভাষ বসু ‘বুকে বল তেজে ভরা প্রাণ’ কথা স্পষ্ট করে বলেছিলেন। ১৯৭১ সালে ‘বঙ্গবন্ধু ও রক্তাক্ত বাংলা’ শীর্ষক এক নিবন্ধে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা লেখক নিরঞ্জন মজুমদার লিখেছিলেন, দেশে দেশে নেতা অনেকেই জন্মান। কেও ইতিহাসের একটি পঙ্ক্তি, কেউ একটি পাতা, কেউ বা এক অধ্যায়। কিন্তু কেউ আবার সমগ্র ইতিহাস। শেখ মুজিব এই সমগ্র ইতিহাস। সারা বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের পলিমাটিতে তাঁর জন্ম। ধ্বংস, বিভীষিকা, বিরাট বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই পলিমাটিকে সাড়ে সাত কোটি মানুষের চেতনায় শক্ত ও জমাট করে একটি ভূখন্ডকে শুধু তাদের মানুষে নয়, অস্তিত্বের বাস্তবতায় সত্য করে তোলা এক মহা ঐতিহাসিক দায়িত্ব। মুজিব মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে মৃৃত্যুঞ্জয় নেতার মতো এই ঐতিহাসিক ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, দায়িত্ব পালন করেছেন। ইতিহাসের সন্তান ইতিহাসকে পুনর্নির্মাণ করেছেন। এখানেই তাঁর নেতৃত্বের ঐতিহাসিকতা। কবি নির্মলেন্দু গুণ যখন বাংলা একাডেমীতে ১৯৭৭ সালে ২১ ফেব্রুয়ারিতে ‘আমি আজ কারো রক্ত চাইতে আসিনি’ কবিতার লাইনগুলো উচ্চারণ করেছিলেন তখন সমবেত সকলে প্রতিধ্বনি করেছিল। এই কবিতা আজ অনেকের কাছে হয়ত অতি পরিচিত, কিন্তু ওই সময়ে কবির কণ্ঠের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ ছিল সেসময়ের প্রেক্ষাপটে এক একটি শব্দব্রহ্মসম।
“সমবেত সকলের মতো আমারো স্বপ্নের প্রতি পক্ষপাত আছে, ভালবাসা আছে, শেষ রাতে দেখা একটি সাহসী স্বপ্ন গতকাল আমাকে বলেছে, আমি যেন কবিতায় শেখ মুজিবের কথা বলি। আমি তাঁর কথা বলতে এসেছি।”

এত লড়াই বৃথা যায়নি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানুষের হ্রদয়ে চির জাগরুক হয়ে আছে। ২০০৪ সালে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি ২০০৪ সালে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি ’ এই শিরোনামে জরিপের আয়োজন করে । ১১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২২ মার্চ পর্যন্ত জরিপে বাংলাদেশ ও ভারতের পূর্বাঞ্চলসহ সারা বিশ্বের ২ কোটি ৫০ লক্ষ শ্রোতা অংশ নেন। এর মধ্যে বাংলাদেশের শ্রোতা ছিল ১ কোটি ২০ লক্ষ। বিবিসি তাদের জরিপ ২০০৪ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস থেকে ২০তম নাম প্রচার করে। এভাবে পর্যায়ক্রমে শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের নাম প্রচার করতে থাকে। পহেলা বৈশাখ সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হিসেবে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে নাম প্রচার করা হয় ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ