স্বদেশ রায়
মি. মিশ্র দক্ষিণ ভারতীয় ব্রাহ্মণ হলেও জাতপাতের ঊর্ধ্বে। খাবারের বিষয়েও সেই সত্যজিত রায়ের আগুন্তুকের মামার মতোই সর্বভুক। শিক্ষকতার পাশাপাশি বাম- সেক্যুলার রাজনীতি করতেন। সমাজ ও রাষ্ট্র কাঠামো পরিবর্তনের স্বপ্ন নিয়ে কাটিয়েছেন দীর্ঘদিন।
দশ বছর আগেও রাজনীতি, সমাজ পরিবর্তন, রাষ্ট্রীয় চরিত্র পরিবর্তন এগুলো নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল। ওনার সব সময়ই ধারণা ছিল তার থেকে আমি স্বপ্ন কম দেখি। কম স্বাপ্নিক আমি। কোভিডের কারণে টেলিফোনে কথা হলেও দুই বছরের বেশি সময় সামনা সামনি আড্ডা দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি একটা চমৎকার সময় কাটালাম। ওনার মতো আর যারা বিভিন্ন কাজের ভেতর দিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন তারাও ছিলেন। বিয়ের সময় দেখা যায় নিজের বা কাছাকাছি কাস্টকে খোঁজে। সেখানে যুক্তি থাকে, এ না হলে পারিবারিক কালচারের সঙ্গে একটা সংঘাত হবে। পরিবারের সঙ্গে এমনকি তার কালচারের সঙ্গে মিলবে না। কারণ, বাড়ির গানের পছন্দ, চায়ের পছন্দ, সামাজিকতার আচরণের একটা বিষয় তো আছে। এই সব চমৎকার যুক্তির ফাঁদেই বিষয়গুলো টিকে থাকে। যৌবন ও প্রৌঢ়ত্বের মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। যৌবনে স্বপ্নগুলো বিনা জলেই সতেজ থাকে। আর প্রৌঢ়ত্বে হাজার জল ঢেলেও স্বপ্ন সতেজ রাখা বড়ই কষ্ট। আর তা শুধু তৃতীয় বিশ্বের প্রৌঢ়দের ক্ষেত্রে নয়, উন্নত দেশেরও। যেমন ট্রাম্প আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরে পল ক্রগম্যানের কলামগুলোর মধ্যে কেমন যেন একটা হতাশার সুর পেতাম। এখনও তিনি নানান পথ দেখালেও কোথায় যেন একটা হতাশা আছে। মানুষের এই হতাশা স্বাভাবিক। মানুষ সব সময়ই চায় তার জীবনেই তার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন পৃথিবীতে হবে। কিন্তু মানুষ যতই জ্ঞানী হোক, অভিজ্ঞ হোক, বার বার ভুলে যায় পড়ার রুমে রাখা পিতলের গে¬াবটার ওপরে একটা পিঁপড়ে উঠলে তাকে অন্তত চোখে দেখা যায় কিন্তু পৃথিবীর আয়তনের তুলনায় মানুষ পৃথিবী পৃষ্টে পড়ার রুমের গে¬াবের ওপরের ওই পিঁপড়ের চেয়েও ক্ষুদ্র। তাই পৃথিবীর গতির সঙ্গে একটি ব্যক্তি জীবনের গতি কখনই মিলবে না। এই ব্যক্তি জীবনের ক্ষুদ্রতা খুব কম মানুষই বুঝতে পারে। মি. মিশ্রের আথিত্যে আমরা যারা আড্ডা দিচ্ছিলাম আমরা কেউই ব্যক্তি জীবনের ক্ষুদ্রতাকে বোঝার মানুষ নই। জানলেও উপলব্ধি করতে পারব না। বাস্তবে আমাদের এই উপমহাদেশে, গৌতম বুদ্ধ, রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউই এ সত্য সত্যি অর্থে জীবনের মর্মে উপলব্ধি করতে পারেননি। যেমন ওই আড্ডায় বেশ কয়েকবার একট কথা ঘুরে ফিরে এলো, ইংরেজের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করতে গিয়ে কেন এই রিফিউজি বা উদ্বাস্তু বা মোহাজের নামক একটা জনগোষ্ঠী তৈরি হলো?
এ নিয়ে ওই আড্ডায় নানান মতামত এলো। অনেক রিফিউজি বা মোহাজেরের দুর্ভোগের জীবন ও সংগ্রামের কাহিনি যার যার অভিজ্ঞতা থেকে বললেন। এবং সবারই মতামতের ভেতর দিয়ে একটি কথাই বার বার সামনে আসতে থাকে, মানুষের আত্মত্যাগকে পুঁজি করে রাজনীতিবিদদের রাষ্ট্র ক্ষমতা পাওয়ার লোভ ও কুটিলতাই এর মূল কারণ। অথচ কি আশ্চর্য ওই মানুষরাই এখনও ওই সব রাজনীতিবিদেরই সমাজের হিরো হিসেবে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। ক্ষমতার মঞ্চ থেকে তাদের নিয়ে এমনই প্রচার হয়েছে, যার ফলে রবীন্দ্রনাথ, রামমোহনকে তো আর মানুষ চেনেই না বরং উদ্বাস্তু শিশুরাই ফুলের মালা দেয় সেই সব রাজনীতিকের গলায় যারা ক্ষমতার লোভে ধর্মের নামে তাদের চৌদ্দ পুরুষের ভিটে মাটি ছাড়া করেছে। আর ইউনিভার্সিটিতে তাদের আদর্শই পড়ে জ্ঞানী হতে হচ্ছে এই ভূখণ্ডের সন্তানদের। এভাবে আড্ডায় আমাদের উপমহাদেশের রাজনীতি ও সমাজের নানান বৈপরিত্য নিয়ে আলোচনা হয়। যেমন একটা অদ্ভুত বিষয় এই উপমহাদেশের সমাজে যারা নিজেদের প্রগতিশীল মনে করি বা দীর্ঘ সময় থেকে করে আসছে তাদের ভেতর দেখা যায়। তাদের খুব কম অংশই নিজস্ব সংস্কার বলুন আর কু সংস্কার বলুন তার থেকে সবটুকু বের হতে পারে না।
যেমন যাদের খাদ্য নিয়ে সংস্কার বা কুসংস্কার যাই বলুন না কেন আছে তারা প্রগতিশীল হলেও সেখান থেকে বের হতে পারেন না। উন্নত বিশ্বের আধুনিক সমাজে বাস করেও দেখা যায় তারা আধুনিক পেইন্টিং নিয়ে লেখার সময় যে কথা বলছেন সেই কথার চরিত্রের সঙ্গে রেস্তোরাঁয় গিয়ে খাবার সময় তার সঙ্গে নিজের মিল রাখতে পারছেন না। তেমনি যাদের জাত পাত বা কাস্ট নিয়ে কুসংস্কার আছে তাদের ক্ষেত্রেও। বিয়ের সময় দেখা যায় নিজের বা কাছাকাছি কাস্টকে খোঁজে। সেখানে যুক্তি থাকে, এ না হলে পারিবারিক কালচারের সঙ্গে একটা সংঘাত হবে। পরিবারের সঙ্গে এমনকি তার কালচারের সঙ্গে মিলবে না। কারণ, বাড়ির গানের পছন্দ, চায়ের পছন্দ, সামাজিকতার আচরণের একটা বিষয় তো আছে। এসব চমৎকার যুক্তির ফাঁদেই বিষয়গুলো টিকে থাকে। তাই যে সমাজের প্রতিটি মানুষের চরিত্রে বৈপরিত্য আছে সে সমাজের রাজনীতিবিদদের চরিত্রে বৈপরিত্য থাকবে এ তো স্বাভাবিক। তারা যা বলবে আর তাদের বাস্তব জীবনের মধ্যে অবশ্যই পার্থক্য থাকবে। আড্ডার যা প্রকৃতি এখানেও তাই ঘটতে থাকে। কখন যে এক প্রসঙ্গ থেকে আরেক প্রসঙ্গে আলোচনা চলে যাচ্ছে তা কেউই টের পাই না। এমনি করে আলোচনার শেষ প্রান্তে এসে মি. মিশ্র অনেকটা হতাশার সুরে বলেন, বাস্তবে তিনি রাজনীতি নিয়ে একদিনে হতাশ হননি। রাজনীতি নিয়ে তিনি হতাশ হয়েছেন ধীরে ধীরে। আর সে ক্ষেত্রে একটি বিষয় তার মনে প্রথম ধাক্কা দেয়। মঞ্চে বসে একদিন তিনি খুব ভালো করে জনসভার লোকগুলোকে পর্যবেক্ষণ করেন। এখানে প্রকৃত প্রকাশ ‘সিংহাবলোকন’ শব্দটি হতে পারে। অর্থাৎ সিংহ যেমন উঁচু পাহাড়ে উঠে জঙ্গলের সব কিছুকে জরিপ করে তেমনি মি. মিশ্রও উঁচু মঞ্চে বসে গোটা জনসভাকে সিংহের ওই তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে দেখতে থাকেন। আর ওই দিন শুধু তার চোখের দৃষ্টি নয়, প্রকৃত দৃষ্টিশক্তিটি চোখে এসে ভর করে। তিনি চমকে ওঠেন।
আসলে যারা এই জনসভায় এসেছে বা যাদের আনা হয়েছে তাদের কাপড় চোপড় এত দীন হীন! অন্তত তার নিজের কাপড় চোপড় আর ওই সাধারণ মানুষের কাপড় তো এক মানের নয়। তারপর দশ বছরেও তিনি তার কোনো পরিবর্তন দেখেননি। অথচ এর বিপরীতে নেতাদের বড় বাড়ি হয়েছে। গাড়ি বড় হয়েছে। নেতাদের বাড়ির সামনে অবধি পাঁকা রাস্তা গেছে। আর দেশের কয়েক ব্যক্তি পৃথিবীরি ধনীর তালিকা নিজেদের অবস্থান নিয়ে প্রতিযোগীতায় যেতে পারছে। এই কথাগুলো মি. মিশ্র তার মিষ্টি নরম স্বরে ও চমৎকার শব্দ চয়নের ভাষা দিয়ে বলা শেষ করেই কেন যেন আমার দিকে একটা প্রশ্ন ছুড়ে দেন। তিনি বলেন, আমি আমার চার দশকের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা দিয়ে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি কিনা? কেন এমনটি ঘটছে? তার উত্তরে, বিনয়ের সঙ্গে বলি, দেখুন, পৃথিবীর খুব কম সাংবাদিকই সমাজ ও রাষ্ট্রের গভীরে নিয়ে যেতে পেরেছেন তার চিন্তা। বেশিরভাগই পারে না। আমি ওই না পারাদের দলে। তবে আপনার এই প্রশ্নের উত্তর রমাপদ চৌধুরী তাঁর একটা গল্পে অনেক আগেই দিয়ে গেছেন। তাঁর গল্পের নায়ক একজন রেল কর্মচারী। সে তার চাকরকে ডাকার পরেও চাকর আসতে কিছুটা সময় নেয়। এই দেরি হওয়ায় রেল কর্মচারী একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বলেন, এই ডাকার সঙ্গে সঙ্গে আসিস না কেন?
চাকর বলে, সে ‘ভোজন’ করছিল। রেল কর্মচারী উত্তরে বলে, তুই ভোজন করবি কেন? ‘ভোজন’ করবে বর্ধমানের রাজা, আমি করবো ‘আহার’ আর তুই বেটা ‘খাবি’।
মি. মিশ্র একটু বড় ধরনের একটা শ্বাস ফেলে বলেন, আসলে ভোজন করবে সরকারের আনুকূল্যে কয়েকজন ব্যবসায়ী।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, কলামিস্ট।