রেজানুর রহমান
সবচেয়ে বড় কথা করোনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ হঠাৎ একটা ধাক্কা খায়। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে জনজীবনে ধাক্কা দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দেশের সাধারণ মানুষ দারুণ একটা অস্থির সময় পার করছে। এমন একটা নাজুক সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনগণ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে এমন কর্মসূচি ঘোষণা করা। আরেকটি বিষয় সবার বিবেচনায় রাখা দরকার তাহলো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা। অনেকেই হয়তো স্বীকারই করতে চাইবেন না দেশের কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। আগামীতেও ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি টানেল সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ময়কর কিছু প্রজেক্ট চালু হবে। কাজেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। জাতীয় নির্বাচন সামনে।
জনগণের ভাগ্য বদলের জন্য যদি এই নির্বাচন হয় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এমন কোনো কর্মসূচি না দেয়া যাতে জনগণই ভোগান্তিতে পড়ে । বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই বলে একটা কথা আছে। আমাদের দেশে এই কথাটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কথাটি বেশ আলোচিত। আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য স্লোগানটিকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ। যৌক্তিক আন্দোলনে বাধা দিলে শেষ পর্যন্ত পরিণতি কি দাঁড়ায় সে কথা সবার জানা। কখনো কখনো রাজনৈতিক আন্দোলনকে যৌক্তিক পর্যায়ে দাঁড় করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ নিজেরাই বাধা দিলে বাঁধবে লড়াইয়ের মতো কৌশলী পরিবেশ সৃষ্টি করে। এটা আন্দোলনের মাঠ গরম করার এক ধরনের কৌশল। গায়ে পড়ে ঝগড়া বাঁধানোর মতো। ঝগড়া শব্দটাই বেশ আতঙ্কের। দেশে অনেকদিন রাজনৈতিক ঝগড়া ছিল না। হরতাল, অবরোধ, ভীতিকর সমাবেশ, আতঙ্ক ছড়ানো মিছিল, রাজনৈতিক রেষারেষি, জ্বালাও পোড়াও, ভাঙচুরের অরাজকতা থেকে মুক্ত ছিল দেশের মানুষ। হঠাৎ করে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের নানামুখী তৎপরতা শুরু হয়েছে। সামনে জাতীয় নির্বাচন। সঙ্গত কারণেই রাজনীতির মাঠ গরম হবে। দেশের সাধারণ মানুষ এ জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত। কিন্তু তারা প্রস্তুত নয় রাজনীতির নোংরা কৌশল ‘বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই’ স্লোগানের সঙ্গে।
কিছুদিন ধরে দেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাপ বাড়তে শুরু করেছে। জাতীয় নির্বাচনের দিনক্ষণ যতই ঘনিয়ে আসবে রাজনৈতিক আন্দোলনের উত্তাপ ততই বাড়বে। এব্যাপারে দেশের সাধারণ মানুষ ভেতরে ভেতরে নিজেদের মানসিক ভাবে প্রস্তুত করতে শুরু করেছে। তবে দেশের সাধারণ মানুষ রাজনৈতিক উত্তাপের বর্তমান পরিবেশ দেখে ইতিমধ্যেই ভয় পেতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক আন্দোলনের নামে অযৌক্তিক অবরোধ, হরতাল, জ্বালাও পোড়াও সহ নাগরিক জীবন দুর্বিষহ করার ভয়। একটু খেয়াল করলেই দেখবেন করোনার আগের পৃথিবী আর করোনা পরবর্তী পৃথিবীর মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। বৃটেনের মতো উন্নত দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ব পরিস্থিতি বেশ টানমাটাল। বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীকে এ ব্যাপারে প্রায় প্রতিদিনই সতর্ক করছেন। করোনা বিশ্বকে নানা ভাবে বদলে দিয়েছে। এখন বেঁচে থাকার পথ খুঁজতেই বিশ্ববাসী ব্যস্ত। বাংলাদেশও কঠিন সময়ের মুখোমুখি। এমন বাস্তবতায় রাজনৈতিক আন্দোলনের চিত্র কেমন হবে তা নিয়ে বোধকরি সবার ভাবা উচিত।
বলছিলাম বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই স্লোগানটির কথা। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলÑ বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেমেছে। তাদের মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন করা হোক। সরকার যদি বিএনপি’র দাবি মেনে নেয় তাহলে সরকারকে নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করতে হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার কোনো সাংবিধানিক সুযোগ নাই। কাজেই বর্তমান সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কথা মোটামুটি পরিষ্কার। কিন্তু রাজনীতির সচতুর কৌশল কথাটাকে অস্থির করে তুলেছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে সরকার ও বিরোধী দল দুই পক্ষই অতীতের মারমুখী রাজনৈতিক চর্চাকে সুকৌশলে প্রয়োগ করছে। কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। মাঝখানে চরম ভোগান্তির মুখোমুখি দেশের সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছে সাধারণ মানুষের মনে, ভয়টা হলো জাতীয় নির্বাচনের এখনো এক বছরেরও বেশি সময় বাকি। এখনই যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি এতটা ভয়ঙ্কর হয় তাহলে সামনের দিনগুলোর অবস্থা কেমন দাঁড়াবে? এমনিতে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দেশের সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা। সেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি আতঙ্কের বিষয় হয়ে দাঁড়ায় তাহলে দেশের সাধারণ মানুষ কোন ভরসায় আগামীকালের নতুন সূর্যের জন্য অপেক্ষা করবে।
মিছিল, সমাবেশ করা সবারই গণতান্ত্রিক অধিকার। তবে তা হওয়া উচিত অহিংস। কারও যেন ক্ষতি না হয়। অর্থাৎ জনগণের যেন ভোগান্তি না হয়। এই যে বিএনপি অব্যাহত ভাবে গণসমাবেশের আয়োজন করছে, পাশাপাশি সমাবেশ ঠেকাতে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে শাসক দল, দুই দলের কেউই কী সাধারণ মানুষের কথা ভেবেছেন? বিএনপি ভাবছে যেকোনো মূল্যে তারা গণসমাবেশ করবে। সরকার পক্ষের লোকজন বাধা দিলে বরং তাদেরই লাভ। আন্দোলন আরও জোরদার হবে। অন্যদিকে সরকার পক্ষ হয়তো ভাবছেন তথাকথিত আন্দোলনের নামে বিরোধী দলকে সভা-সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। যদিও সভা-সমাবেশের ক্ষেত্রে দেশের কোথাও কোনো নিষেধাজ্ঞা নাই। তবে গণ-সমাবেশ আয়োজনকারীরা অভিযোগ তুলেছেন একে তো পরিবহন বন্ধ করা হয়েছে, উপরন্তু পথে পথে তাদের কর্মীদের নানান কায়দায় সমাবেশে আসতে বাধা দেয়া হয়েছে। মুখে এ ব্যাপারে ক্ষোভ প্রকাশ করলেও বিরোধী পক্ষ ভেতরে ভেতরে বোধকরি বেশ খুশি। ওই যে কথায় আছে ‘বাধা দিলে বাঁধবে লড়াই’। যত বাধা- আন্দোলন ততই জোরদার। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের ভোগান্তি উভয় পক্ষেরই বিবেচ্য নয়।
গত কয়েকদিনে দেশের রাজনীতির পরিবেশ দেখে একটা কথাই মনে হয়েছে তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর যুগে রাজনৈতিক আন্দোলনের অতীতের সেই ধারা বদলে ফেলা উচিত। ঢাকা শহরের কথাই ধরা যাক। অতীতকালে ঢাকা শহরে লোকসংখ্যা কম ছিল। তখন শহরের ভেতর রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ করলে নগরবাসীর তেমন দুর্ভোগ হতো না। কিন্তু বর্তমান সময়ে কোনো রাজনৈতিক দল যদি রাজধানীতে সমাবেশ ডাকে তাহলে গোটা রাজধানী শহরের পরিবেশ অস্থির হয়ে ওঠে। যানজটে নাকাল হয় মানুষ। একই ভাবে অন্যান্য শহরের কথাও প্রযোজ্য। তাই সময় বিবেচনায় আমরা কী রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে পারি না? মানুষের কল্যাণেই যদি কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষিত হয় তখন মানুষ যেন ভোগান্তিতে না পড়ে সেটাই তো মূল বিবেচ্য হওয়া দরকার। একটি সমাবেশের খরচ অনেক। সেখানে যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করা যায় তাহলে তো খরচের পাশাপাশি জনদুর্ভোগ কমানো সম্ভব।
সবচেয়ে বড় কথা করোনার কারণে দেশের সাধারণ মানুষ হঠাৎ একটা ধাক্কা খায়। সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই নতুন করে জনজীবনে ধাক্কা দেয় রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে জীবন-জীবিকার প্রশ্নে দেশের সাধারণ মানুষ দারুণ একটা অস্থির সময় পার করছে। এমন একটা নাজুক সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনগণ যাতে ভোগান্তিতে না পড়ে এমন কর্মসূচি ঘোষণা করা। আরেকটি বিষয় সবার বিবেচনায় রাখা দরকার তাহলো দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা। অনেকেই হয়তো স্বীকারই করতে চাইবেন না দেশের কিছুটা হলেও উন্নতি হয়েছে। পদ্মা সেতু চালু হয়েছে। আগামীতেও ঢাকায় মেট্রোরেল, চট্টগ্রামে কর্ণফুলি টানেল সহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিস্ময়কর কিছু প্রজেক্ট চালু হবে। কাজেই রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা জরুরি। জাতীয় নির্বাচন সামনে। জনগণের ভাগ্য বদলের জন্য যদি এই নির্বাচন হয় তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত এমন কোনো কর্মসূচি না দেয়া যাতে জনগণই ভোগান্তিতে পড়ে। সবার জন্য রইলো নিরন্তর শুভ কামনা।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো