স্টাফ রিপোর্টার – জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী ও প্রধান নির্বাচন কমিশন (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের সঙ্গে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে মঙ্গলবার বৈঠকে অনুষ্ঠিত হবে। সোমবার নির্বাচন কমিশন সচিব মো. জাহাংগীর আলম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য আমরা সংসদ সচিবালয়ের কাছে বৈঠকের সময় চেয়েছিলাম। মঙ্গলবার দুপুর ২টায় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, সোমবার নির্বাচনের সময় গণনা শুরু হয়ে গেছে। স্পিকারের সঙ্গে বৈঠকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সবকিছু নির্ধারণ হবে। এক্ষেত্রে এক ফেব্রুয়ারি ছয় উপ-নির্বাচনের পর ভোটার তালিকা করা হবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে আগামী ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে। দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ক্ষণগণনা শুরু হয়ে গেছে। বর্তমান রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ২৩ এপ্রিল। সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান রয়েছে। এতে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা রয়েছে। তবে যে সংসদ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করেছে, ওই সংসদের মেয়াদে রাষ্ট্রপতির মেয়াদ শেষ হলে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনের প্রয়োজন পড়বে না। সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রথম বৈঠকের দিন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাষ্ট্রপতির মৃত্যু, পদত্যাগ বা অপসারণের ফলে পদ শূন্য হলে শূন্য হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে।
২০১৮ সালে সর্বশেষ এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছিল ওই বছর ২৫ জানুয়ারি। মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ সময় ছিল ৫ ফেব্রুয়ারি, মনোনয়নপত্র বাছাই ছিল ৭ ফেব্রুয়ারি। আর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় ছিল ১০ ফেব্রুয়ারি এবং ভোট গ্রহণের সময় রাখা হয়েছি ১৮ ফেব্রুয়ারি। সে সময় ২২ দিনের মধ্যে পুরো কার্যক্রম সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল নির্বাচন কমিশন। তবে সে সময় বর্তমান রাষ্ট্রপতি একক প্রার্থী থাকায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন।
সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন থাকাকালে ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ থেকে মো. আবদুল হামিদ ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। ওই বছর ২০ মার্চ রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করলে মো. আবদুল হামিদ সেদিন থেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে ২২ এপ্রিল তিনি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ২৪ এপ্রিল বাংলাদেশের ২০তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
এরপর মো. আবদুল হামিদ ২০১৮ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় মেয়াদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন এবং ওই বছর ২৪ এপ্রিল ২১তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। সংবিধান অনুযায়ী, দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতি পদে অধিষ্ঠিত হওয়ায় তিনি আর এ পদে প্রার্থী হতে পারবেন না। ২০১৮ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় গণনা শুরু হয় ওই বছর ২৪ জানুয়ারি। পরদিন ২৫ জানুয়ারিই তফসিল ঘোষণা হয়েছিল। তখন ভোটের তারিখ নির্ধারণ করা হয়েছিল ১৮ ফেব্রুয়ারি।
দেশের সংবিধানের বিধান অনুযায়ী প্রণীত ১৯৯১ সালের আইন ও বিধিমালার আলোকে দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। মেয়াদ পূর্ণ, মৃত্যু কিংবা পদত্যাগ ও অপসারণের কারণে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন হয়ে থাকে। এর আগে প্রত্যক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হলেও ১৯৯১ সালের ২ জুলাই সংবিধানের ১২তম সংশোধনীতে পরোক্ষ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান করা হয়। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৪৮ অনুসারে সংসদ-সদস্যদের ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।
সংবিধান অনুযায়ী ৩৫ বছর তা তারও বেশি বয়সী এবং সংসদ সদস্য নির্বাচনের যোগ্য যেকোনও ব্যক্তিই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। তবে তার মনোনয়নপত্রে প্রস্তাবক ও সমর্থক হিসেবে সংসদ সদস্য থাকতে হবে। মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করার সময়ও তার সঙ্গে একজন সংসদ সদস্যকে উপস্থিত থাকতে হবে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ‘নির্বাচনি কর্তা’ হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পরিচালনা করেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হলে স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে সিডিউল ঘোষণা করেন। নির্বাচনি সিডিউল ঘোষণার আগে কমিশন সংসদ সদস্যদের বিভক্তি সংখ্যা [সংসদের কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের জন্য বরাদ্দকৃত বিভক্তি সংখ্যা (সংসদীয় আসনক্রম ১-৩৫০ নম্বর)], নাম ও নির্বাচনি এলাকা উল্লেখ করে ভোটার তালিকা প্রস্তুত ও প্রকাশ করবে। এক্ষেত্রে কোনও সংসদীয় আসন শূন্য হলে ওই আসনের অনুকূলে বরাদ্দকৃত বিভক্তি নম্বরটি ভোটার ক্রমিকে বাদ থাকবে।
সংসদ অধিবেশনের সময় এই নির্বাচনের ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। তবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রয়োজনীয় সময়ে যদি অধিবেশন না থাকে, তাহলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে ভোটগ্রহণের কমপক্ষে সাতদিন আগে অধিবেশন আহ্বান করবেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে স্বাভাবিক সময়ের মতো রাষ্ট্রপতিকে অধিবেশন ডাকতে হবে না।
নির্বাচনি কর্তা (নির্বাচন কমিশন) ভোটগ্রহণের দিনের বৈঠকের সভাপতিত্ব করবেন। কমিশন কর্তৃক নিযুক্ত কর্মচারীদের সহায়তায় ভোট গ্রহণ পরিচালনা করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের জন্য সংসদ-সদস্যদের বৈঠক সংসদ কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। সংসদে স্পিকার সংসদ অধিবেশন চলার সময় শৃঙ্খলার স্বার্থে যে ব্যবস্থা নেবেন, ভোটের দিন নির্বাচনি কর্তা সেই ব্যবস্থা নেওয়ার অধিকারী হবেন। যেকোনও ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষ তাকে সহযোগিতা করতে বাধ্য থাকবে।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের দিনে নির্বাচন ছাড়া সংসদের অন্য কোনও কার্যক্রম চলতে পারবে না। নির্বাচনে একাধিক প্রার্থী থাকলে নির্বাচনি কর্তা নির্বাচনের দিন দুপুর ১২টার পর সংসদ কক্ষে প্রার্থীদের প্রস্তাবক ও সমর্থকের নাম ঘোষণা করবেন। রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আইন ও বিধিমালা অনুযায়ী, একাধিক প্রার্থী হলে সংসদের অধিবেশন কক্ষে নির্বাচনি কর্মকর্তার সামনে নির্ধারিত ব্যালট পেপারে পছন্দের প্রার্থীর নাম ও নিজের স্বাক্ষর দিয়ে তা জমা দিতে হবে। এর মুড়ি অংশে স্বাক্ষর দিয়ে ভোটারদের ব্যালট পেপার সংগ্রহ করতে হবে। ভোট দেওয়ার পর সংসদ কক্ষে স্থাপিত এক বা একাধিক ব্যালট বাক্সে তা জমা দিতে হবে।
প্রত্যেক সংসদ সদস্যের একটি মাত্র ভোট থাকবে। সংসদ সদস্য হিসেবে স্পিকারও এই নির্বাচনে একজন ভোটার। ভোটের দিন গ্যালারিসহ সংসদ কক্ষে প্রার্থী, ভোটার, ভোট নেওয়ায় সহায়তাকারী কর্মকর্তা ছাড়া সবার প্রবেশাধিকার নিয়ন্ত্রণ করবেন নির্বাচনি কর্মকর্তা। ভোট শেষে নির্বাচন কমিশনার প্রকাশ্যে ভোট গণনা করবেন। সর্বাধিক সংখ্যক ভোটপ্রাপ্তকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আর সমান ভোট পেলে প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে ফল নির্ধারণ করা হবে।
১৯৯১ সালে পরোক্ষ ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত সাত বার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র একবার রাষ্ট্রপতি পদে একাধিক প্রার্থী থাকায় সংসদে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯১ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি আব্দুর রহমান বিশ্বাসকে রাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন দিয়েছিলেন। আর ওই সময়ে বিরোধী দল ও বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছিল বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরীকে। ওই নির্বাচনে আব্দুর রহমান বিশ্বাস বিজয়ী হন। এছাড়া প্রত্যেক বার একক প্রার্থী হিসেবে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। ফলে এর কোনও ক্ষেত্রেই সংসদ কক্ষে ভোটগ্রহণের প্রয়োজন পড়েনি।
সংবিধানের ৪৮ (১) অনুচ্ছেদে বলা আছে, আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্য কর্তৃক রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হবেন। কারও বয়স ৩৫ বছরের কম ও সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য না হলে কেউ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হতে পারবেন না। রাষ্ট্রপতির মেয়াদ কার্যভার গ্রহণের সময় থেকে পাঁচ বছর। তবে মেয়াদ শেষ হলেও তার পরবর্তী রাষ্ট্রপতি দায়িত্ব গ্রহণ না করা পর্যন্ত স্বীয় পদে অধিষ্ঠিত থাকবেন। একাদিক্রমে হোক না হোক দুই মেয়াদের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারবেন না।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময়সীমা সম্পর্কে সংবিধানের ১২৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ১২৩ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি-পদের মেয়াদ অবসানের কারণে ওই পদ শূন্য হইলে মেয়াদ সমাপ্তির তারিখের পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে শূন্য পদ পূরণের জন্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। অর্থাৎ ক্ষণগণনা শুরুর ৩০ দিনের মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সম্পন্ন করতে হবে।