Search
Close this search box.

রাজনৈতিক সংকট সমাধানে জাতিসংঘের সহায়তা চায় বিএনপি

স্টাফ রিপোর্টার- অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রশ্নে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সহায়তা চেয়ে শিগগির জাতিসংঘকে চিঠি দেবে বিএনপি। শেষ দুই জাতীয় নির্বাচনে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করার পাশাপাশি আগামী সংসদের ভোটও একতরফা করতে সরকার নানামুখী ষড়যন্ত্র করছে বলে জাতিসংঘকে জানাবে দলটি। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার যৌক্তিকতাও চিঠিতে উল্লেখ করা হবে। এ ছাড়া বিরোধী দলের ওপর সরকারের দমনপীড়ন, সভা-সমাবেশে বাধা, গ্রেপ্তার, হামলা-মামলার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরবে বিএনপি। দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনের সুরক্ষায় জাতিসংঘকে ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হবে। জাতিসংঘের পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), কমনওয়েলথকেও একই বিষয়ে চিঠি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। বিএনপির নীতিনির্ধারক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগেও জাতিসংঘ, ইইউ ও কমনওয়েলথকে সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। আর ২০১৪ সালের ভোটের আগে নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য জাতিসংঘের মধ্যস্থতা চেয়েছিল দলটি।

সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক উইংসহ দলটির দায়িত্বশীল নেতারা চিঠির খসড়া তৈরি করছেন। শিগগির দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সইয়ে চিঠি সংস্থাগুলোর কাছে পাঠানো হবে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘মিথ্যা মামলায়’ সাজা দিয়ে আগামী নির্বাচনও তাঁকে ছাড়াই সরকার করতে চায় বলে উল্লেখ করবে বিএনপি। চিঠিতে দুর্নীতি ও মানি লন্ডারিংয়ের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের মাধ্যমে সরকারদলীয় নেতারা টাকার পাহাড় গড়ছেন বলেও অভিযোগ করবে দলটি।

সূত্র আরও জানায়, চিঠিতে সার্বিকভাবে আগামী নির্বাচন সামনে রেখে সৃষ্ট রাজনৈতিক সংকট সমাধানে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির আহ্বান জানাবে রাজপথের বিরোধী দলটি। চিঠিতে জাতিসংঘকে বিশ্বের অভিভাবক হিসেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালনের আহ্বান জানানো হবে। একই সঙ্গে সংকট নিরসনে নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিতে সরকারকে চাপ দেওয়া এবং একজন প্রতিনিধি পাঠানোর অনুরোধ করবে দলটি। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও আন্তর্জাতিকবিষয়ক উইংয়ের প্রধান আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সমকালকে বলেন, বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির বিষয়ে বিদেশিরা অবগত। বন্ধুপ্রতিম সব দেশ ও সংস্থার প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। ঢাকা থেকেও সংস্থাগুলোর আবাসিক প্রতিনিধি ও রাষ্ট্রদূতরা নিয়মিত তাঁদের হেডকোয়ার্টারে প্রতিবেদন পাঠান। আমাদের কাছেও তাঁরা পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চান। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় তাঁরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

জাতিসংঘকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি এড়িয়ে যান। বলেন, আমরা বাংলাদেশের মানুষকে নিয়ে রাজনীতি করি। শুধু বৈশ্বিক বিষয়ে বিদেশিদের সঙ্গে কথা বলি।

বিএনপি সূত্র জানায়, নির্দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে সমমনা দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়েও জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। এর অংশ হিসেবেই জাতিসংঘকে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে চিঠি দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। এ ছাড়া দলের আন্তর্জাতিক উইংকে আরও শক্তিশালী করতে আন্তর্জাতিক যোগাযোগে অভিজ্ঞ নেতাদের কমিটিতে যুক্ত করার বিষয়টিও আলোচনা হয় ওই বৈঠকে। বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরূকরণের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে নেতাদের তাগাদা দেওয়া হয়।

সম্প্রতি রাজনৈতিক সংকট সমাধানে বিরোধী দলের সঙ্গে সম্ভাব্য সংলাপ নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অন্যদিকে, সরকারের সঙ্গে কোনো সংলাপে বসবেন না বলেও পাল্টা জানিয়ে দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

একই সঙ্গে কিছুদিন ধরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ভারত, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকের সঙ্গে দেনদরবার করছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এতে পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ করেন প্রধান দু’দলের নেতারা। অবশ্য কূটনীতিকরা অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। সর্বশেষ নির্বাচন কমিশন বিএনপিকে সংলাপে বসার আহ্বান জানালে দলটি তা প্রত্যাখ্যান করে। বিএনপি এ প্রসঙ্গে বলেছে, এটি সরকারের নতুন কূটকৌশল। এ পরিস্থিতির মধ্যেই জাতিসংঘকে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় দলটি।

বিএনপির আন্তর্জাতিক উইংয়ের এক সদস্য বলেন, জাতিসংঘসহ বিদেশি সংস্থা ও রাষ্ট্রগুলো একটি দেশের নির্বাচন ঘিরে পরিস্থিতি ধাপে ধাপে গভীর পর্যবেক্ষণ করে। এ জন্য তারা নির্বাচনের আগে, নির্বাচনকালীন ও নির্বাচন-পরবর্তী সময়কে ভাগ করে নেয়। সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বিএনপি  বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে সহায়তা চাইবে। এর আগেও আন্তর্জাতিক মহল বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে সহায়তা করেছে। আশা করি, বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার ও মানবাধিকার রক্ষায় তারা ভূমিকা রাখবে।

বিএনপির নীতিনির্ধারক এক নেতা সমকালকে বলেন, জাতিসংঘে আমাদের বেশ কিছু অঙ্গীকার রয়েছে। সেগুলো হলো– গণতন্ত্র, আইনের শাসন, ভোটাধিকার ও মানবাধিকার। বাংলাদেশে এখন এ অঙ্গীকারগুলোর চরম লঙ্ঘন হচ্ছে। কমনওয়েলথের মূল্যবোধেরও পরিপন্থি কাজ হচ্ছে। একটি কর্তৃত্ববাদী সরকারের হাতে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার আজ ভূলুণ্ঠিত। মার্কিন প্রতিবেদনসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার প্রতিবেদনেও তা উঠে এসেছে। এমনকি মানবাধিকার হরণ করায় র‍্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। বিএনপির চিঠিতে এ বিষয়গুলো থাকবে।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এর পরও প্রশ্নবিদ্ধ ভোটের মাধ্যমে আবার ক্ষমতায় যায় আওয়ামী লীগ। এখন বিএনপিকে রাজপথে কোনো কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া হচ্ছে না। হোটেল-রেস্তোরাঁর মতো জায়গায় সামাজিক অনুষ্ঠান থেকেও বিরোধী নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ে হাজার হাজার নেতাকর্মীকে মিথ্যা ও ষড়যন্ত্রমূলক মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে– এসব কিছুই জাতিসংঘে পাঠানো চিঠিতে উল্লেখ করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।

এ পরিস্থিতিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসাতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ প্রয়োজন বলে মনে করে বিএনপি।

২০১৪ সালে দশম সংসদ নির্বাচনের আগে নিরপেক্ষ ভোটের জন্য জাতিসংঘের মধ্যস্থতা চেয়েছিল বিএনপি। বিএনপির আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব বান কি মুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেছিলেন। সমঝোতা করতে জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ দূত ও সহকারী মহাসচিব অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো ঢাকা এসেছিলেন। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নিয়ে বৈঠকও করেছিলেন। পরে সমঝোতায় ব্যর্থ হয়ে ফিরে যান তারানকো। পরে ওই নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি।

২০১৮ সালের ভোটের আগেও জাতিসংঘ, ইইউ, কমনওয়েলথকে সুষ্ঠু নির্বাচনের সহায়তা চেয়ে চিঠি দিয়েছিল বিএনপি। সংস্থাগুলো অংশগ্রহণমূলক অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যাপারে সরকারকে আহ্বানও জানিয়েছিল। এ প্রেক্ষাপটে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে সংলাপে বসেন। সুষ্ঠু নির্বাচনের আশ্বাস দিয়ে বিরোধী দলকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিরোধী দল তাঁর আশ্বাসে সাড়া দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেয়। অবশ্য ওই নির্বাচনে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মাত্র ছয়টি আসন পায়। ভোট কারচুপির অভিযোগ তুলে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করলেও পরে শপথ নেন বিএনপির এমপিরা। তবে গত ১০ ডিসেম্বর আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা জানিয়ে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তাঁরা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ