Search
Close this search box.
ডিএসসিসি’র তদন্ত প্রতিবেদন

 বঙ্গবাজারে ভয়াবহ ক্ষয়ক্ষতির জন্য দায়ী ব্যবসায়ীরা

স্টাফ রিপোর্টার-বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষয়ক্ষতির জন্য পরোক্ষভাবে দায়ী করা হয়েছে ব্যবসায়ীদের। একইসঙ্গে আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা প্রহরীদের ফেলে দেওয়া সিগারেটের আগুন কিংবা মশার কয়েলের আগুন থেকে এ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়ে থাকতে পারে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। পাশাপাশি ডিএসসিসি’র আওতাভুক্ত এলাকায় থাকা কাঠের বা টিনের মার্কেটগুলোকে দ্রুত পাকা করার ব্যবস্থা নেওয়া, পানির রিজার্ভার রাখা এবং জলাধারগুলোকে সংরক্ষণসহ ১০টি সুপারিশ করা হয়েছে তদন্ত প্রতিবেদনে।

প্রতিবেদনটি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা প্রহরীদের একজন হোসেন পাটোয়ারী। তার সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস ছিল। যদিও তিনি তদন্তকারীদের জানিয়েছিলেন ১৫ থেকে ১৬ বছর আগেই তিনি ধূমপান ছেড়ে দিয়েছেন। কিন্তু অন্যান্য প্রহরীদের থেকে জানা যায়, ধূমপানের অভ্যাসের জন্য এক বছর আগেও মার্কেট কমিটি তাকে সতর্ক করেছিলো। তদন্ত কমিটির ধারণা, হোসেন রাতের ডিউটি শেষে ইউনিফর্ম পরিবর্তনের জন্য প্রহরীদের কক্ষে যান। তারপর মসজিদে নামাজ পরে সেখানেই ঘুমিয়ে যান তিনি। সেহরি খাওয়ার পর যদি তিনি লুকিয়ে সিগেরেট খেয়ে থাকেন এবং চতুর্থ তলায় পোশাক পরিবর্তনের সময় সেটি পা দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করে থাকেন, তাহলে কাঠের তক্তার ফাঁকা অংশ দিয়ে তা সরাসরি তৃতীয় তলায় পড়ে আগুন লাগার শঙ্কা থাকতে পারে। এছাড়া সাক্ষীদের ভাষ্যমতে বঙ্গবাজার মার্কেটে মশার উপদ্রব ছিলো। যার কারণে নিরাপত্তা প্রহরীরা মশার কয়েল ব্যবহার করে থাকতে পারেনে। সেই কয়েল থেকেও তৃতীয় তলার এমব্রয়ডারি টেইলার্সের দোকানে আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে। আগুন লাগার আর কোনও কারণ পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করা হয়।

আগুনের ভয়াবহতা নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটগুলোতে প্যান্ট, গেঞ্জি, লুঙ্গি, শাড়ি, জ্যাকেট, শীতের পোশাকসহ নানা রকমের তৈরি পোশাক বিক্রি করা হতো। এসব মালামাল রাখার জন্য অনেকগুলো গোডাউন ছিল। মার্কেটের সব আইটেমই ছিল সহজেই পুড়ে যাবে এমন দাহ্য। মার্কেটগুলো অগ্নিকাণ্ডের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও সেখানে আগুন নেভানোর পর্যাপ্ত ব্যবস্থা ছিল না। অগ্নিকাণ্ডের জন্য মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনায় বিদ্যমান কাঠামো ভেঙে পাকা ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০১৭ সালের জুলাইতে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কেটগুলোর নেতাদের বরাবর চিঠি দেওয়া ছাড়াও একাধিকবার তাগিদপত্র দেয়। কিন্তু দোকান মালিকরা ও সমিতির নেতারা এসবে কর্ণপাত করেননি। না করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে তিনটি রীট পিটিশন দায়ের করেন, যা এখনও চলমান।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের সময় চৈত্রের খরতাপ ও বাতাসের প্রবাহ বেশি থাকায় আগুন খুব দ্রুত ছড়িয়ে পরে। এতে কোনও প্রাণহানি না ঘটলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মালিকানাধীন টিন, কাঠ ও লোহার কাঠামো দিয়ে তৈরি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেট ও মহানগর শপিং কমপ্লেক্স সম্পূর্ণ ছাই হয়ে যায়। সাত তলা বিশিষ্ট এনেক্সকো টাওয়ারের দোকানগুলোর ব্যাপক ক্ষতি হয়। এছাড়াও রাস্তার পশ্চিম পাশের বঙ্গ ইসলামিয়া সুপার মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও কমপ্লেক্সেরও কিছু ক্ষতি হয়।

বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে বাঁচতে তদন্ত কমিটি ১০ সুপারিশ করেছে। সেগুলো হচ্ছে– ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকায় কাঠের বা  টিনের মার্কেট থাকলে সেগুলোকে দ্রুত পাকা করার ব্যবস্থা নিতে হবে। মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত ফায়ার এক্সটিংগুইশারসহ অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখার জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। এগুলো ব্যবহারের জন্য কর্মরত কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। নিয়মিত উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ পরিদর্শন করে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা সচল আছে কিনা যাচাই করে সনদ দেবে। সেই সনদ দৃশ্যমান স্থানে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। মার্কেটের আন্ডারগ্রাউন্ডে ওয়াটার রিজার্ভার থাকতে হবে। এটা থেকে পাইপের মাধ্যমে যুক্ত করে মার্কেটের চারটি স্থানে ওয়াটার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

মার্কেটগুলোর ভেতরের চলাচলের গলি বা রাস্তাগুলো পর্যাপ্ত জায়গা রেখে করতে হবে। মার্কেটগুলোতে বৈদ্যুতিক সংযোগ, ভোল্ট ক্যাপাসিটি ও ব্যবহারের মধ্যে সামঞ্জস্য সঠিক বা পর্যাপ্ত রয়েছে কি-না তা সবসময় পরীক্ষা করার ব্যবস্থা রাখতে হবে। খাবারের দোকান, রেস্টুরেন্ট, মসজিদ, থাকার স্থান এগুলো মার্কেটের বাইরে বা এক পাশে থাকা সমীচীন। মার্কেটগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাকর্মী, বিদ্যুৎকর্মী, সচেতনতা ও দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা থাকা প্রয়োজন। বৈদ্যুতিক সংযোগের জন্য মানসম্মত তার ব্যবহার করতে হবে। সিটি করপোরেশনের মধ্যে থাকা সব জলাধার সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিতে হবে।

বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে আগুনের ঘটনায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এরমধ্যে রাজস্ব বিভাগ ও মার্কেট নির্মাণ সেল থেকে পাওয়া তথ্য এবং প্রকৌশলীদের হিসাব অনুযায়ী মার্কেটগুলোর কাঠামোগত দিক বিবেচনায় আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১৪ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

ডিএসসিসি’র মালিকানাধীন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটে দুই হাজার ৯৬১টি দোকান ছিল। প্রতিটি দোকান প্রায় সাড়ে ১৭ থেকে ২০ বর্গফুট বিশিষ্ট ছিল। এসব দোকানে বেশিরভাগ গেঞ্জির কাপড়, শার্ট, প্যান্ট ও গার্মেন্ট সামগ্রীর দোকান ছিল। মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান ছোট সাইজের হলেও কিছু দোকান একসঙ্গে সংযুক্ত করে নির্মাণ করা হয়েছিল। যা গুদামঘর হিসেবে ব্যবহার করা হতো।

ব্যবসায়ীরা জানান, দোকান ভেদে চার লাখ থেকে প্রায় ১৫ লাখ টাকার মালামাল ছিল। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স মার্কেটে প্রায় আনুমানিক ২২২ কোটি টাকার মালামাল আগুনে পুড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেটের বেশিরভাগ দোকান গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হতো। মহানগর শপিং কমপ্লেক্স মার্কেটটির ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের আর্থিক মূল্য প্রায় ৫৯ কোটি ৩ লাখ টাকা। বঙ্গ ইসলামিয়া মার্কেট ও বঙ্গ হোমিও মার্কেটের আনুমানিক ক্ষতিগ্রস্ত মালামালের আর্থিক মূল্য প্রায় ছয় কোটি ৯৭ লাখ টাকা। মার্কেটগুলোর দোকান প্রতি আনুমানিক গড়ে সাড়ে ৭ লাখ টাকার মালামালের ক্ষতি হিসেবে গণনা করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির প্রধান ও ডিএসসিসির আঞ্চলিক-১ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মেরীনা নাজনীন গণমাধ্যমকে বলেন, অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ থাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকেও বঙ্গবাজার মার্কেটের ব্যবসায়ীদের ছয় বার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল উঠে যাওয়ার জন্য। এর আগে ১৯৯৫ সালে অগ্নিকাণ্ডের পরে ওখানে ভবন নির্মাণের জন্য প্ল্যান পাস হয়ে ঠিকাদারও নিয়োগ করা হয়েছিল। কিন্তু ব্যবসায়ীরা হাইকোটে রিট করায় কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ঈদের আগে নিম্নআয়ের ছোট ব্যবসায়ীদের ভ্রাম্যমাণ হিসেবে বসার সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু ঈদের পরে সিদ্ধান্ত হবে বঙ্গবাজার মার্কেট আর এভাবে চালু করা হবে কিনা।

সংবাদটি শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও সংবাদ >

সর্বশেষঃ