নিজস্ব প্রতিবেদক
নামসর্বস্ব অনুমোদনহীন অনলাইন পোর্টালের কার্ড ঝুলিয়ে নারায়ণগঞ্জ শহর ও শহরতলীর বাইরে কথিত সাংবাদিকদের অপকর্মের খবর বেশ পুরনো। সাম্প্রতিক সময়ে সেই অপরাধের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বহুগুনে। বর্তমানে ভুয়া কার্ড ব্যবহার করে সাংবাদিক পরিচয়ে রীতিমতো ডাকাতির ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে গুটিকয়েক কথিত সাংবাদিক। যার একটি ভিডিও ফুটেজ এসে পৌছেছে গণমাধ্যমের কাছে। যেখানে দেখা যায়, সামনে থেকে চক্রটির নেতৃত্ব দিচ্ছে ফতুল্লার কায়েমপুর এলাকার মুসা মিয়ার পুত্র সুমন ওরফে ফরমা সুমন (২৮)। যার নামে ফতুল্লা মডেল থানায় মাদক, ছিনতাই, নারী নির্যাতন এমনকি হত্যা মামলা পর্যন্ত রয়েছে। যদিও খুনের মামলাটি বর্তমানে নিষ্পত্তি অবস্থায় আছে। চক্রটির বাকি সদস্যদের মধ্যে আরও আছেন- তন্ময় (মাদক মামলার আসামী), জান্নাত ও প্রশান্তসহ আরও বেশ ক’জন কথিত সাংবাদিক। যাদের নামে নগরীর সচেতন নাগরিকদের অভিযোগের অন্ত নেই। তবুও যেনো ধরাছোয়ার বাইরে এই চক্রের সদস্যরা। বরং আশ্চর্য্যজনকভাবে এই চক্রের প্রত্যেক সদস্য নারায়ণগঞ্জ পুলিশ মিডিয়া গ্রুপের সক্রিয় সদস্য হিসেবে কাজ করছে! যেখানে সংযুক্ত রয়েছেন নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাগণ।
গণমাধ্যমের কাছে আসা ওই ডাকাতির ভিডিওতে দেখা যায়, অসামাজিক কার্যকলাপ হয় এমন একাধিক ফ্লাটে সাংবাদিক পরিচয়ে দল বেধে হানা দেয় সুমন ওরফে ফরমা সুমনের নেতৃত্বাধীন অসাধু চক্রটি। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে সুমনকে বলতে দেখা যায়, দরজা খোলেন না হয় পানিসম্যান্ট (সাজা) আরও বেশি হবে। এরপর ভেতরে প্রবেশ করে দাবিকৃত টাকা না পেয়ে দেহ ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বেধড়ক পেটাতে দেখা যায় সুমন ওরফে ফরমা সুমনকে। আর তাকে সহযোগীতা করতে দেখা যায়- তন্ময়, জান্নাত ও প্রশান্তসহ বেশ ক’জনকে। যাদের প্রত্যেকের কাছে ছিল নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টালের প্রেস কার্ড ও সাংবাদিকতার বিভিন্ন সরঞ্জাম। যেসকল প্রেস কার্ড তারা নিজেরাই প্রিন্ট করে ব্যবহার করছে। অন্য আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি পরিবারকে ব্লাকমেইলিং করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সুমন ওরফে ফরমা সুমন।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এই অপরাধ চক্রের মূলহোতা সুমন ওরফে ফরমা সুমনের নামে ফতুল্লা মডেল থানায় রয়েছে বেশ ক’টি মামলা। যার মধ্যে ২০১৩ সালে ফতুল্লার ইসদাইর এলাকায় চাঞ্চল্যকর ফুটবলার রাসেল হত্যা মামলার প্রধান আসামী ছিল সুমন। এ মামলায় সেসময় আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয় সে। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর মামলার বাদির সাথে আপোষ হলে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০২০ সালে স্ত্রীর দায়েরকৃত নারী নির্যাতন মামলায় দীর্ঘদিন কারাভোগ করে সুমন। এরপর ২০২১ সালের ১২ মে ফতুল্লার পশ্চিম তল্লা এলাকা থেকে ১২০০ পিস ইয়াবাসহ সুমন ওরফে ফরমা সুমন ও মাদক কারবারী তন্ময়কে গ্রেপ্তার করে জেলা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। প্রায় ৬ মাস কারাভোগের পর জামিনে এসে পরেরবছর ১২ মে ফতুল্লার ইসদাইরে দাবিকৃত চাঁদা না পেয়ে দুই নিরাপত্তাকর্মীকে মারধর ও রক্তাক্ত জখমের ঘটনায় আবারও পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার হয় সুমন।
অপরদিকে, সূত্রের খবরানুযায়ী- শীতলক্ষ্যা নামক এক অনুমোদনহীন নামসর্বস্ব অনলাইন পোর্টাল খুলে নিজেরাই নিজেদেও প্রেস কার্ড বানিয়ে শহরময় দাবড়ে বেড়াচ্ছে সুমন ওরফে ফরমা সুমন, তন্ময়সহ সংঘবদ্ধ ওই চক্রটি। সাংবাদিক পরিচয়ে চাঁদাবজি, ছিনতাই, ব্ল্যাকমেইলিং এমনকি ডাকাতির ঘটনা ঘটাতেও দু’বার চিন্তা করে না এই চক্রের সদস্যরা। অভিযোগ আছে, চক্রটিকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে আড়াল থেকে শেল্টার দিচ্ছে নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় একটি পত্রিকার সম্পাদক!
এমতাবস্থায় নারায়ণগঞ্জের পেশাদার সাংবাদিকরা বলছেন, সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ আর সাংবাদিক জাতির বিবেক ও সমাজের আয়না। আর তাই পেশাটিকে অনেক গুরুত্ব ও সম্মানের সহিত দেখা হয়। মূল্যবান এই পেশা বিতর্কিত হচ্ছে স্বঘোষিত ধান্দাবাজদের ‘সাংবাদিক’ হয়ে গড়ে ওঠাকে কেন্দ্র করে। পাড়া মহল্লায় যেকোন নামে অনলাইন খুলে কিংবা এক পাতার কিছু একটা ছাপিয়েই অনেকে স্বঘোষিত সাংবাদিক হয়ে পরছে। যেনতেন প্রকারে আন্ডারগ্রাউন্ড একটি পত্রিকা বের করে কিংবা অনলাইন পোর্টাল চালু করে চলছে ব্ল্যাকমেইলিং আর চাঁদাবাজির উৎসব। সর্বোপরি, ভুয়া সাংবাদিকে ছেয়ে গেছে পুরো নারায়ণগঞ্জ। এসব কথিত সাংবাদিকদের দায় নিতে হচ্ছে প্রকৃত সাংবাদিকদেরকে। নারায়ণগঞ্জে সাংবাদিক পরিচয়ের আড়ালে ভয়ঙ্কর অপরাধীর সংখ্যা বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশের জরুরী হস্তক্ষেপ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
এ বিষয়ে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূরে আজম মিয়া বলেন, আইশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যাতিত কারও কোথাও অভিযান পরিচালনা করার এখতিয়ার নেই। যদি কেউ এমনটা করে থাকে সেক্ষেত্রে তারা বে-আইনী কাজ করেছে। এ বিষয়ে খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।