স্টাফ রিপোর্টার: খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি জেলার সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনায় মিথ্যা তথ্য ও ভুয়া সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যা পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। এসব ভুয়া ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর পেছনে ছিল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের সমর্থক এবং ভারতীয় নাগরিক-রাজনীতিকরা। অনলাইন ভেরিফিকেশন ও মিডিয়া গবেষণা প্লাটফর্ম ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে এসব তথ্য।
তাদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, গত ১৮ সেপ্টেম্বর খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় চুরির অভিযোগে এক যুবককে গণপিটুনিতে হত্যা করা হয়। পরদিন পাহাড়ি ও বাঙালি সেটলারদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এই সহিংসতায় অন্তত ৮৬টি দোকান পুড়ে যায়, যার বেশিরভাগই পাহাড়িদের মালিকানাধীন ছিল। সংঘাত দ্রুত রাঙামাটিতেও ছড়িয়ে পড়ে এবং এতে চারজন পাহাড়ি মারা যান। অন্তত ৮০ জন আহত হন। পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটে খাগড়াছড়ির ‘স্বনির্ভর’ এলাকায়, যেখানে সেনাবাহিনীর গুলিতে দুই পাহাড়ি নিহত হন। সেনাবাহিনী জানায়, সশস্ত্র গ্রুপের আক্রমণের পর তারা আত্মরক্ষায় গুলি চালায়।
বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, এই সংঘাতের মধ্যে, পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ বাড়তে থাকলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কিছু ভারতীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও সংগঠনের মাধ্যমে এই তথ্য প্রচারিত হয়। এর ফলে পার্বত্য চট্টগ্রামের সহিংসতা একটি রাজনৈতিক প্রচারণায় রূপ নেয়, যা উভয় দেশের জনমনে আতঙ্ক ছড়ায়।
ডিসমিসল্যাব বলছে, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ির ‘স্বনির্ভর’ এলাকায় গুলির ঘটনার পর প্রথমবারের মতো মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে শুরু করে। ‘জুম্মো’ নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রথমে ৩২ জনের মৃত্যুর খবর দেয়া হয়। এই পেজটি ১৮ সেপ্টেম্বর তৈরি করা হয়। আর এর সাথে ত্রিপুরার একটি অনলাইন পোর্টাল ‘দ্য জুম্মো টাইমস’ এর লোগো যুক্ত ছিল। এর পরপরই বিভিন্ন ফেসবুক প্রোফাইল ও পেজ থেকে একই তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এর এক ঘণ্টার মধ্যেই ৩২ জনের মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে ৩৫ জনে পৌঁছে যায়। কিছু পোস্টে সেনাবাহিনী গুলি চালিয়েছে এবং এতে ৩৫ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছে দাবি করা হলেও কোনো মৃতদেহ দেখানো হয়নি। রাত ৩টার দিকে এই সংখ্যা আবার ৩৬ জনে পৌঁছায়। বিভিন্ন প্রোফাইল থেকে বলা হয়, ৩৬ জন নিহত হয়েছে এবং ২০০টি বাড়িঘর পুড়ে গেছে।
এ সময়কার বিভিন্ন পোস্ট বিশ্লেষণ করে ডিসমিসল্যাব দেখতে পায়, বেশ কিছু পোস্টের সাথে আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং ছাত্রলীগের সদস্যরা জড়িত। মোহাম্মদ জাকারিয়া ইসলাম নামে একজনের প্রোফাইলে দেখা গেছে, তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং ছাত্রলীগের একজন কর্মী।
এরপর ২০ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে ত্রিপুরাভিত্তিক ‘দ্য জুম্মো টাইমস’ একটি ভিডিও পোস্ট করে দাবি করে, সেনাবাহিনীর গুলিতে এবং বাঙালি সেটলারদের আগুনে ৩৩ জন চাকমা মারা গেছেন। পরদিন মৃত্যুর সংখ্যা ৬৭ এবং পরে ৭৯ জন দাবি করা হয়। এই মিথ্যা তথ্যের প্রথম পোস্ট পাওয়া যায় ‘আতুল চাকমা’ নামে এক ব্যক্তির প্রোফাইলে। তিনি দাবি করেন, ‘৬৭টি মৃতদেহ পাওয়া গেছে এবং আহতদের সংখ্যা অনেক।’ আতুল চাকমা নিজেকে ভারতের বাসিন্দা হিসেবে পরিচয় দেন।
এই তথ্য ছড়াতে আরও কিছু ভারতীয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়। তাদেরই একজন রাইটস অ্যান্ড রিস্কস অ্যানালাইসিস গ্রুপের পরিচালক সুহাস চাকমা। তিনি দাবি করেন, ৯ জন পাহাড়ি নিহত হয়েছেন এবং বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের অবনতি হওয়া উচিত। ভুয়া মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে প্রচারণা ভারত ও বাংলাদেশের উভয় পক্ষেই রাজনৈতিক প্রচারণায় রূপ নেয়। ভারতীয় বিজেপি সমর্থক ও নেতাদের পাশাপাশি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমর্থকরাও এই মিথ্যা তথ্য প্রচারণায় যুক্ত ছিলেন। একপর্যায়ে, বিভিন্ন পোস্টে ঘটনাটি গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয় এবং জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দাবি করা হয়।
ডিসমিসল্যাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, খাগড়াছড়ির সহিংসতার প্রকৃত মৃত্যুর সংখ্যা ছিল চারজন, কিন্তু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে তা ১০০ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল। ডিসমিসল্যাব এসব মিথ্যা তথ্য প্রচারকারীদের চিহ্নিত করে এবং দেখায় কীভাবে এক প্রান্তিক ঘটনা একটি বড় রাজনৈতিক প্রচারণায় পরিণত হয়েছিল। এদের মধ্যে কিছু ভারতীয় রাজনৈতিক গোষ্ঠী ও গণমাধ্যমের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য।